Rabindra Jayanti Special

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন পরমতসহিষ্ণু সমাজ

অচলায়তন নাটকের মূল ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ইস্কুলে পালন করতে চেয়েছিলেন। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়অচলায়তন নাটকের মূল ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ইস্কুলে পালন করতে চেয়েছিলেন। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৭ ১৪:০৫
Share:

অনেকেই ভাবেন রাবীন্দ্রিকতা মানে নরম-সরম বিষয়-আশয়, পেলবতা । নাচ-গান-ফুল-পাখি । এ ভাবনা ভুল ।

Advertisement

এমনকী রবীন্দ্রনাথের লেখায় কুসমির দাদামশাইয়ের যে ভদ্রলোকপনা, ভালোমানুষগিরির কথা আছে, রবীন্দ্রনাথ তেমনও নন। কুসমির দাদামশাই ছিলেন বেজায় ভদ্রলোক, অত্যন্ত ভালমানুষ। ছোটবেলার বন্ধু পাঁচকড়ি দাদামশাইয়ের সোনার কলম আর সিল্কের ছাতা তাঁর চোখের সামনেই নিয়ে পালিয়ে গেল। দাদামশাই ভদ্রলোক বলে চুপটি করে রইলেন। দাদামশাইয়ের আরেক বন্ধু তাঁর প্রিয় ব্রাউনিংয়ের কবিতার বই নিয়ে চলে গেল। বইখানি সেই গুণধরবন্ধু বাজারে বিক্রিও করে দিল। দাদামশাই তাঁর নিজের বই আবার পয়সা দিয়ে কিনে লুকিয়ে রাখলেন লাইব্রেরিতে, পাছে তাঁর সেই গুণধর বন্ধু টের পায় দাদামশাই জেনেছেন তাঁর কীর্তি। দাদামশাই এমনই ভালমানুষ যে সহ্য করেন চুরি-জোচ্চুরি। যাঁরা চোর তাঁদের ভদ্রতাবশত কিচ্ছুটি বলেন না।

বাস্তবে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এই কুসমির দাদামশাইয়ের মতো ভালমানুষীতে বিশ্বাসী নন। ফুল-লতা-পাতার কাল্পনিক জগতেও তিনি বুঁদ হয়ে ডুবে থাকেন না। বরং বলেন, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে তাঁর মতে দু’পক্ষই সমান অপরাধী। অন্যায় সহ্য করাকে সহনশীলতা বলে না, সহিষ্ণুতাও বলা চলে না। নিজের কাজ দিয়েই সে কথা তিনি বুঝিয়ে দেন। ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করছেন, দুই বাঙালিকে তাঁরা আলাদা করে দিতে চান। রবীন্দ্রনাথ পথে নামেন। গান গাইতে গাইতে রাখী পরিয়ে দেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে ভারতীয়দের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হল। পঞ্জাবি ভাইদের সেই দুঃখের দিনে রবীন্দ্রনাথ সরব। নাইটহুড ত্যাগ করে চিঠি পাঠালেন। সাহেব মাস্টারমশাই নেটিভ ছাত্রদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছেন। উত্তেজিত ছাত্ররা প্রতিক্রিয়াবশত কিছু করলে আবার ছাত্রদেরই দোষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভারতীয় ছাত্রদের বহিষ্কার করার কথা ওঠে। তরুণ সুভাষচন্দ্রের উপর নেমে আসে শাস্তির খড়্গ। রবীন্দ্রনাথ তা সইবেন কেন? সুভাষের পক্ষ নেন তিনি, ছাত্রদের পক্ষ নেন। মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক সখ্য ও শ্রদ্ধার। তবু মহাত্মার সব কথা নির্বিচারে সহ্য করার পাত্র কবি নন। মহাত্মা চরকা কাটার কথা বলেন, কবি মনে করেন এ নিছক যান্ত্রিকতা। নিজের মত স্পষ্ট করে বলেন। কবি ও মহাত্মার তর্ক চলে চরকা নিয়ে।

Advertisement

এই যে নিজের মত স্পষ্ট করে বলছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন রবীন্দ্রনাথ, এর মানে এই নয় যে ক্রমাগত তর্ক-বিতর্কের আলো নিজের দিকে টেনে আনাই তাঁর অভিরুচি। মোটেই নয় তা। বঙ্গভঙ্গের সময় প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে কিছু দিন সম্পর্ক ছিল তাঁর, তারপর নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। রাজনৈতিক প্রতিবাদ প্রয়োজনে তিনি করেন, তবে বিশ্বাস করেন রাজনীতি তাঁর পথ নয়, রাষ্ট্রনির্মাণ তাঁর উদ্দেশ্য নয়। তিনি মনে করেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের দুটি ধারা। একটি বাইরের। সেই বাইরের ইতিহাসে বিদেশির অংশ বেশি, তারা রাজ্যশাসন করেছে, যুদ্ধ-বিগ্রহ করেছে। মাঝে মাঝে ভারতীয়রা মাথা নাড়া দিয়ে সেই বিদেশি শক্তিকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কয়েক বার সফলও হয়েছে। তবু সেই বাইরের ইতিহাস যা ‘রাষ্ট্রিক সাধনা’ তা ভারতের সাধারণ মানুষের সাধনা নয়। ইতিহাসের ভেতরের আরেক রূপ আছে। সেই রূপ রাষ্ট্রের থেকে সমাজকে গুরুত্ব দেয় বেশি। সেই সমাজে নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ মিলেমিশে গেছে। এই মিলমিশের কাণ্ড সাহেবরা, ছোট রাজনৈতিক মতলববাজ ইংরেজরা, এ দেশে আসার আগেই ঘটেছিল। সেই মিলমিশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও রাজন্যবর্গের ভূমিকা তেমন ছিল না বললেই চলে। এই মিলমিশের ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিল জনসাধারণের সমাজ। ইংরেজরা এ দেশে এসে তাই যখনই রাজনীতির মতলব থেকে এই মিলমিশের সমাজে বিভেদ তৈরি করতে চান তখনই সেই পলিটিক্যাল মতলবের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ সরব হন। আর উনিশ-বিশ শতকের আধুনিক ভারতবাসীকে এই মিলমিশের সামাজিকতা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলেন। এই সমাজ কী ভাবে গড়া যায় সে কথা ভাবেন।

এই সামাজিক মিলমিশ কী ভাবে সম্ভব? কবি মনে করেন মিলমিশের জন্য একে অপরকে জানা চাই। একের সঙ্গে অপরের কথা বলা চাই। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন একের সঙ্গে অপরের সংলাপে গড়ে উঠুক পরমতসহিষ্ণু সমাজ। এক মানুষ অন্য মানুষকে গ্রহণ করুক। একদিনে তো এমন মিল হবে না, সাধনা করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের গোরা সে তো জীবনের প্রথম পর্বে উগ্র হিন্দু, জাত-পাত মেনে উগ্র ভঙ্গিতে সনাতন ধর্মের পক্ষে কথা বলে সে। কী একরোখা! তারপর এক অন্য সময় এল গোরার জীবনে। কলকাতার উচ্চবিত্ত আশ্রয় ছেড়ে সে গ্রামের পথে দেশ চিনতে গেল। আর সেখানে সে দেখল হিন্দু বিত্তশালীরা দরিদ্র মুসলমানদের নির্যাতন করছে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা গোরার হিন্দুয়ানি কবলিত মনকে বদলে দিল। তার হিঁদুয়ানির উগ্রতা উধাও হল। উদার সহনশীলতায় দীক্ষা নিল সে। তার সমাজে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানের আর ভেদ রইল না। পাঁচিল ঘেরা যে ইস্কুলে ছাত্র-শিক্ষকেরা পাঁচিলের বাইরের লোকদের ব্রাত্য বলে মনে করত, একদিন সেই ইস্কুলের আচার্যই দলবল নিয়ে পাঁচিল দিলেন ভেঙে। অচলায়তন নাটকের এই মূল ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ইস্কুলে পালন করতে চেয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ব্রতীবালকদের দল। এই বালকেরা গ্রামে গ্রামে যেত, গ্রামকে চিনত। রবীন্দ্রনাথের এই সামাজিকতার সাধনায় অর্থনীতির ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করতেন যক্ষের মতো কেউ যদি বিপুল সম্পদ জমিয়ে রাখে তা হলে সামাজিক অসাম্য তৈরি হবে। তাই চাইতেন তিনি সম্পদের সামাজিকতা— লক্ষ্মীর ধন যেমন সবাইকে শ্রীমন্ত করে তেমনই ব্যক্তিমানুষ, গোষ্ঠীগত মানুষ স্বীকার করে নেবেন সম্পদের সামাজিক দায়িত্ব। যক্ষের মতো ধন না আগলে সামাজিক ভাবে তা কাজে লাগাবেন। নিজেদের জীবনযাত্রায় প্রতিদিনের থাকা-খাওয়া-পরায় শ্রী থাকবে, বিত্তের আস্ফালন থাকবে না। শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রায়, শ্রীনিকেতনের কাজে-কর্মে এই পরিকল্পনা বড় হয়ে উঠেছিল।

রবীন্দ্রনাথের এই সামাজিক সহিষ্ণুতার, মিলমিশের স্বপ্ন সফল হয়নি। ভাঙা দেশ, টুকরো সমাজ বুঝিয়ে দেয় সমস্যা প্রবল। তবে সফল হয়নি বলে পরিকল্পনা অর্থহীন তা বলা যাবে না। রাষ্ট্রিকতা ও রাজনৈতিকতা সংকীর্ণ মতলব মানুষকে অসহিষ্ণু করে তুলতে চায়। রাষ্ট্র ও রাজনীতির সেই বেলেল্লাপনার মধ্যে সামাজিক মানুষের অন্তরের ইতিহাসেই ভরসা রাখতে ইচ্ছে করে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের বাইরে নাগরিক সমাজের মানুষদের সবসময়েই সচেতন থাকা চাই।

অলঙ্করণ: অর্ঘ্য মান্না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন