আটলান্টিকে অশনি সঙ্কেত! পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে মেক্সিকো উপসাগর পর্যন্ত জাল বিছিয়ে ফেলেছে রহস্যময় বাদামি চওড়া ফিতের মতো জলজ বস্তু। মহাকাশ থেকে উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়া ছবি দেখলে মনে হবে অতিকায় কোনও সাপ নিমজ্জিত রয়েছে সাগরের নীল জলে। ধীরে ধীরে নিজের কলেবর আরও বৃদ্ধি করছে সেই রহস্যময় বাদামি ফিতে।
একসময় কেবল সারগাসো সাগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বিচিত্র বস্তুটি। মে মাসে তোলা উপগ্রহচিত্রগুলি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ৮ হাজার ৮৫০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ভাসমান বাদামি পদার্থটি। ২০১৮ সালের জুন মাসে সমুদ্র গবেষকেরা জানিয়েছিলেন এটি আসলে একটি সামুদ্রিক শৈবাল।
‘গ্রেট আটলান্টিক সারগাসাম বেল্ট’ নামে পরিচিত এই দানবাকৃতির শৈবালটি। ২০১১ সালে এটিকে প্রথম শনাক্ত করেন বিজ্ঞানীরা। সারগাসাম হল এক ধরনের বাদামি সামুদ্রিক শৈবাল, যা সমুদ্রে ভেসে থাকে। দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শৈবালটি আটলান্টিকের চেহারা পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য খাদ্য, আশ্রয় ও প্রজননক্ষেত্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এটি। সাধারণত সারগাসো সাগরে পাওয়া যেত বলে এর নামকরণ করা হয়েছে সারগাসাম। সেই শৈবালই বর্তমানে নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেতে পেতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক শৈবালে পরিণত হয়েছে। এই বেল্টের ওজন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টনে।
২০১১ সাল থেকে আটলান্টিকে এই দানবাকৃতির সারগাসামের দৌরাত্ম্য প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন গোটা আমেরিকা মহাদেশের প্রস্থের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে সমুদ্রে বিরাজ করছে শৈবালটি। শৈবালটি জলের ওপর ভেসে থেকে ছোট মাছ, জলজ প্রাণীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন এই শৈবালটি নিজের মূল বাসস্থান ছেড়ে বেরিয়ে এসে আটলান্টিক জুড়ে বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে।
কঙ্গো, আমাজন এবং মিসিসিপিতে অনিয়ন্ত্রিত কৃষি বর্জ্য, শিল্প কারখানার রাসায়নিক নির্গমন ও নিকাশি নালার মাধ্যমে প্রচুর নাইট্রোজ়েন ও ফসফরাস মিশ্রিত জল এসে পড়ছে। আর এই রাসায়নিক থেকে পুষ্টি টেনে নিয়ে চড়চড় করে বেড়ে চলেছে শৈবালের আকার।
ফ্লরিডা-আটলান্টিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হারবার ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটের হার্মফুল অ্যালগি নামে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা পাওয়া গিয়েছে ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, সারগাসাম টিস্যুর মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইট্রোজ়েন ও ফসফরাসের অনুপাত ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফ্লরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ মেরিন সায়েন্সের ডঃ চুয়ানমিন হু জানিয়েছেন, সাগরের জলে রাসায়নিকের উপস্থিতির হেরফের হওয়ার ফলে শৈবালগুলি দানবাকৃতির হয়ে উঠছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে বেল্টটি। অতিরিক্ত সামুদ্রিক শৈবালের উপস্থিতি প্রবালের বাড়বৃদ্ধি রুখে দেয় এবং সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদের জন্মকে দমিয়ে রাখতে পারে।
প্রবালপ্রাচীরের জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যালোককে সমুদ্রের গভীরে প্রবেশে বাধা দেয় বাদামি বেল্টটি। প্রবালের সালোকসংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান না পেলে সেগুলির ধ্বংস অনিবার্য। কার্বন সিঙ্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। শৈবালের পচনের ফলে হাইড্রোজ়েন সালফাইড, মিথেন এবং অন্যান্য গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়। যখন এটি তীরে ভেসে যায়, তখন এটি উপকূল অঞ্চলের ক্ষতি করে। পর্যটন, মৎস্য এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
আবহাওয়ার ধরন এবং জলবায়ু পরিবর্তন শৈবালের বিস্তারকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখে বলে বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন। শৈবালের বাড়বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে আমাজন নদী। বন্যার মরসুমে নদীর স্রোতের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজ়েন ও ফসফরাস গিয়ে পড়ে নদীতে। পুষ্টিতে ভরপুর হয়ে যায় সারগাসাম শৈবাল।
বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে সমুদ্র উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারগাসাম বেল্ট আরও দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাতাস এবং স্রোতের বদল ঘটে সারগাসো সাগরের উত্তরে এর পরিসর প্রসারিত হতে পারে। এটি কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যাই নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
১৯৯১ সালে ফ্লরিডা উপকূল জুড়ে সারগাসাম জমা হওয়ার ফলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আটলান্টিক মহাসাগরের এই বিশাল বাদামি ফিতেটি এখন আর কেবল দ্রষ্টব্য বস্তু হয়েই থাকছে না। বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত এটি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাব কমানোর উপায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন।
পরিবেশগত প্রভাবের বাইরেও, সারগাসামের ফুল উপকূলীয় অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনছে। সৈকতে শৈবালের ব্যাপক উপস্থিতি পর্যটন, মাছ ধরার শিল্প এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একসময় যে সৈকতগুলি পরিচ্ছন্ন ও নির্মল ছিল সেগুলি এখন পচা শৈবালে ভরে উঠছে। স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটক উভয়ের জন্যই অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে এই বিপদটি।
উৎসস্থল থেকে বাড়তে বাড়তে এগুলি সৈকতে গিয়ে জমা হয়। ফলে পচা ডিমের মতো গন্ধযুক্ত গ্যাস নির্গত হতে শুরু করে। ক্ষতিকর এই শৈবালটির জন্য বছরে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্রসৈকত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ এই বস্তুটির অপসারণ সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং সব সময় কার্যকরী হয় না।