Adhir Chowdhury

বহরমপুরে ‘কর্ণ’ অধীর, একার লড়াইয়ে ষষ্ঠ বার জিততে পারবেন মোদীর ‘ফাইটার’?

প্রথম জীবনে নকশাল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। জেলে গিয়েছেন নিতান্তই কিশোর বয়সে। কিছুটা বেপরোয়া ভাব। হাঁটার মধ্যে ‘কংগ্রেসি চাল’। কথা বলার সময় দু’হাত নেড়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্যে থাকে প্রতিপক্ষকে যুক্তিতে উড়িয়ে দেওয়ার তুরীয় মেজাজ।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪ ১৪:৪১
Share:
০১ ১৮

১৯৯১ সাল। নবগ্রাম বিধানসভা থেকে জাতীয় কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে লড়াই করছেন অধীর চৌধুরী। ভোট চলাকালীন একটি বুথে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সিপিএমের প্রায় ৩০০ কর্মী এবং সমর্থক দৌড়চ্ছেন অধীরের পিছনে। সে বার ভোটের লড়াইয়ে ৩৫ বছরের অধীর হেরেছিলেন ১,৪০১ ভোটে। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় নবগ্রাম থেকে বিধায়ক হন। পাঁচ বছর পর সেই একই আসনে ২০,৩২৯টি ভোটে জয়ী হন অধীর। সে বার গ্রেফতারির আশঙ্কায় প্রকাশ্যে এসে প্রচার করতে পারেননি অধীর। তাঁর রেকর্ড করা বক্তৃতা চালিয়ে এলাকায় ভোট চেয়েছিল কংগ্রেস। ভোট গণনায় দেখা যায়, প্রবল লড়াই করে জিতেছেন অধীর। কিন্তু শপথ নেবেন কী ভাবে? বিধায়ক অধীরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ! তাই সোমেন মিত্র কৌশল করে লুকিয়ে বিধানসভায় নিয়ে যান তাঁকে। শপথ নিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পথ চলা শুরু হয় অধীরের।

০২ ১৮

তিনি বরাবরের ‘যোদ্ধা’। পরের যে ঘটনার কথা বলা হবে, তখন তাঁর বয়স ৬৩। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের সময় তাঁর কেন্দ্রে ভোট কেমন চলছে দেখতে গিয়ে একটি বুথের বাইরে আচমকা দৌড় শুরু করেন বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অধীর। অভিযোগ করেন, মুখ ঢেকে বুথে ছাপ্পা দিতে এসেছিল তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। আর ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে যখন তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে গুজরাত থেকে এনে প্রার্থী করেছে, তখন অধীরের নির্ঘোষ, ‘‘আমি তো চেয়েছিলাম মমতা বা অভিষেক কেউ প্রার্থী হবেন!’’ পাশাপাশি অধীরের সংযোজন, ‘‘আমি জানি কী ভাবে লড়াই করে জিততে হয়।’’

Advertisement
০৩ ১৮

অধীরের জন্ম বহরমপুরে। ১৯৫৬ সালের ২ এপ্রিল। বাবার নাম নিরঞ্জন চৌধুরী। মা সরোজাবালা চৌধুরী। বহরমপুরের স্কুলে পড়তে পড়তেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন অধীর। পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে অধীর ছুটেছেন লাগাম দিয়ে। প্রথম জীবনে নকশাল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। জেলে গিয়েছেন নিতান্তই কিশোর বয়সে। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেও, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যুক্ত হন বামফ্রন্ট শরিক আরএসপি-তে। সেই সময় মুর্শিদাবাদ থেকে বিধায়ক হয়ে রাজ্য মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতেন আরএসপি নেতা দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। আরএসপি দলে তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন অধীর। কিন্তু ’৯০-এর দশকের গোড়ায় আরএসপি নেতৃত্বের সঙ্গে বনিবনা না হলে যোগদান করেন কংগ্রেসে। তার পর আর বাংলার রাজনীতিতে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি অধীরকে। একজন সাধারণ কর্মী থেকে পথচলা শুরু করে অধীর বর্তমানে কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা। কিছুটা বেপরোয়া ভাব। হাঁটার মধ্যে ‘কংগ্রেসি চাল’। কথা বলার সময় দু’হাত নেড়ে আক্রমণাত্মক মন্তব্যে থাকে প্রতিপক্ষকে যুক্তিতে উড়িয়ে দেওয়ার তুরীয় মেজাজ। এ হেন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ যখন-তখন রেগে যান। ঘনিষ্ঠেরা বলেন, ‘‘দাদার মেজাজটাই এমন।’’

০৪ ১৮

রাজনীতির ময়দানে বিরোধীকে কটাক্ষ এবং আক্রমণ করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই ‘বেফাঁস’ মন্তব্য করে বসেন অধীর। চলতি লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপটে যেমন। বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেস্তে যাওয়ায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরকে দায়ী করেন তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক’ও ব্রায়েন। তাঁর দাবি, বিজেপির কথায় কাজ করেন অধীর। সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠেন বহরমপুরের সাংসদ। ডেরেককে বলে বসেন ‘বিদেশি’। পরে অবশ্য মাফ চেয়েছেন। একই ভাবে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ‘রাষ্ট্রপত্নী’ বলেও বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। তখন অধীরের দাবি ছিল, তিনি এখনও হিন্দি ভাষা ঠিকঠাক আয়ত্ত করতে পারেননি। তাই ‘ভুল’ করে ফেলেছেন এবং তাঁর জন্য রাষ্ট্রপতিকে দুঃখপ্রকাশ করে চিঠিও দিয়েছেন। একটি সাক্ষাৎকারে অধীর বলেন, ‘‘আমি বাংলায় থাকি। দিল্লি এলে শুধু হিন্দি বলি। বাংলায় স্বামী-স্ত্রীকে পতি-পত্নী এই হিসাবে আমরা দেখি। আমি পুরুষ এবং স্ত্রী লিঙ্গ বোঝাতে এমনটা বলেছিলাম। যাই হোক। চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছি রাষ্ট্রপতির কাছে।’’

০৫ ১৮

অধীর সাক্ষাৎকারে স্বীকার করে নেন, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর প্রথম জেলযাত্রা হয়। সেটাও আবার খুনের মামলায়। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। বোনের বিয়ের দিন আর পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারেননি। বাড়ি গিয়েছিলেন। অগত্যা সেখান থেকে গ্রেফতার। অধীরের নিজের দাবি, অন্তত ১৬টি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে তিনি নির্দোষ। অধীরের দাবি, তিনি অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করবেনই। তা সে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের চোখে চোখ রেখে কথা বলা হোক, কিংবা সংসদে কঠিন সত্য তুলে ধরা— তিনি ভয় পান না।

০৬ ১৮

রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই! এই প্রবাদের উদাহরণ খোদ অধীর। বামফ্রন্ট জমানায় সিপিএমের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেস হয়ে ভাল ফল করেছিল। একবার তো বর্ধমানে জোড়া খুনের মামলায় সাংসদ হওয়া সত্ত্বেও অধীরকে জেলে যেতে হয়েছিল বাম জমানাতেই। পাল্টা তিনি অভিযোগ করেছিলেন, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস চক্রান্ত করে তাঁকে জেলে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করেছেন। এমনকি সেই সময় অধীর অভিযোগ করেন, সুইস ব্যাঙ্কে নিজের কালো টাকা রেখেছেন অনিল। যদিও সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি।

০৭ ১৮

অধীরকে কি তাঁর দলও ভুল বোঝে? সাংসদের বিভিন্ন ইস্যুতে মন্তব্য, ধারালো আক্রমণে কংগ্রেসই অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়ে। এমনটা কেন হয়? কখনও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমকে নিয়ে এমন টুইট করেন যে, দলের লোকজনই ঠোক্কর খান। কখনও বিরোধী সাংসদদের সংসদ থেকে সাসপেনশনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এমন কথা বলে বসেন যে, নিজের দলের সাংসদেরাই ঘনিষ্ঠ মহলে এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

০৮ ১৮

২০২০ সালের মার্চ মাস। সংসদে অধিবেশন চলাকালীন সাত সাংসদকে সাসপেন্ড করেন স্পিকার। সেই সময় স্পিকারের উদ্দেশে কংগ্রেসের লোকসভার নেতার মন্তব্য, ‘‘জেব কাটরে কো ফাঁসি কে তখ্‌তে পে নহি চড়ায়ে যা সকতা হ্যায়!’’ অধীর বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর দলের সাংসদদের লঘু ‘দোষে’ গুরু দণ্ড দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলে বসেন, ‘পকেটমারদের ফাঁসিতে লটকানো যায় না’। যে মন্তব্যের জন্য দলের সাংসদেরাই তাঁর বিরুদ্ধে সনিয়ার কাছে দরবার করেছিলেন। যদিও অধীর তা স্বীকার করেননি। তাঁর দাবি, এমনটা হয়নি। তিনি তো দলের হয়েই লড়ছিলেন।

০৯ ১৮

অধীর নিজে বলেন বহরমপুরকে তিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। মানুষের পাশে তিনি সব সময় থাকেন। তাঁদের যে কোনও প্রয়োজনে তিনি পাশে থাকেন। কিন্তু উন্নয়ন নিয়েও যুদ্ধ? চলতি বছর জানুয়ারি মাসের ঘটনা। এক রাস্তা। সাংসদ বলছেন, তিনি তৈরি করবেন। বিধায়কের দাবি রাস্তা গড়বেন তিনি। সাংসদ বনাম বিধায়কের এই উন্নয়ন-যুদ্ধে শোরগোল শুরু হয় মুর্শিদাবাদের মরাদিঘি অঞ্চলে। একই রাস্তা তৈরির জন্য শিলান্যাস করেন বহরমপুরের সাংসদ অধীর এবং রেজিনগরের তৃণমূল বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরী। বিধায়ক ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন, অধীর অন্য কোনও রাস্তার সংস্কার করুন। কিন্তু সাংসদের দাবি, তিনি ওই রাস্তাই করবেন। শেষমেশ শিলান্যাসও করেন।

১০ ১৮

তবে সব সময় তিনি ‘অ্যাংরি ওল্ড ম্যান’ নন। মাঝেমধ্যেই ধরা দেন অন্য ‘অবতারে’। পরনে ফুলশার্ট, ট্রাউজ়ার্স। চোখে চশমা। মাথায় ক্যাপ। মোটরবাইক চালাতে চালাতে দু’হাত ছেড়ে রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশে করজোড়ে প্রণাম করছেন। কখনও দু’হাত মেলে ধরছেন। কখনও বাইকের হ্যান্ডল ছেড়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠছেন নিজে। বহরমপুর জাতীয় সড়কের বাইপাসের একটি অংশের উদ্বোধন করে এমনই মেজাজে ধরা দিয়েছিলেন বহরমপুরের সাংসদ। তাই নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। এক জন প্রবীণ রাজনীতিবিদ তথা পুরনো জনপ্রতিনিধি কী ভাবে হেলমেট ছাড়া এমন ‘স্টান্ট’ করেন, তা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। কিন্তু অধীর থাকেন অধীরেই। তাঁর এলাকায় নতুন রাস্তা বলে কথা। একটু ‘সেলিব্রেশন’ হবে না? ঘটনা হল, খেলাধুলোর প্রতি বরাবরই অনুরাগ অধীরের। ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলা দেখতে ভালবাসেন তিনি। ইচ্ছে ছিল জীবনে একবার অন্তত মাঠে থেকে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখবেন। ২০০৬ সালে জার্মানির বার্লিনে আয়োজিত বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে যান অধীর। ইতালি বনাম ফ্রান্সের সেই ম্যাচ দেখতে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা এআইএফএফ-এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। কিন্তু বার্লিন পৌঁছে অধীর দেখেন, ম্যাচের টিকিট হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। খুব মনখারাপ হয়ে যায় তাঁর। সেই সময় বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে বার্লিনেই হাজির ছিলেন প্রিয়রঞ্জন। তাঁকে ফোন করে নিজের আক্ষেপের কথা জানান বহরমপুরের সাংসদ। মুশকিল আসান করে দেন প্রিয়রঞ্জন। বিকল্প টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার সুযোগ করে দেন তিনিই। মাঠে গিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার স্বপ্নপূরণ হয় অধীরের।

১১ ১৮

‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ নিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আসেন মুর্শিদাবাদে। তখনও বাংলায় তৃণমূল এবং কংগ্রেসের জোট নিয়ে আশাবাদী রাহুল নিজে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া ‘ইন্ডিয়া’র কথা তাঁরা ভাবতেই পারেন না। কিন্তু জোট নিয়ে খোদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর ঘোষণা করে দেন, ‘ইন্ডিয়া’ নিয়ে যা বলার বলবেন হাই কমান্ডে। তিনি বলেন, ‘‘জোট আমার সাবজেক্ট নয়।’’ অন্য দিকে, মমতা যখন তাঁর দল তৃণমূলকে বার্তা দিয়েছেন, বহরমপুরে অধীর কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নন, পাল্টা বহরমপুরের সাংসদের হুঁশিয়ারি, ‘‘আমি তো লড়াই করে জিতেছি। প্রতিপক্ষকে হারিয়ে বড় হয়েছি। আমি কাউকে পরোয়া করি না। আমি কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছি। কংগ্রেস চাইলে সব পারে। আমি লড়াই করতে প্রস্তুত।’’ শেষমেশ চলতি লোকসভা ভোটে জোটের সম্ভাবনায় জল ঢেলে বাংলার ৪২ আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূল। অধীরের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠান। তবে জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী অধীর।

১২ ১৮

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। সংসদে লোকসভায় জবাবি ভাষণে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টিপ্পনী কাটেন কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীরকে। প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেসকে ‘পরিবারতন্ত্র’ নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়ে বলেন, ‘‘শক্তিশালী বিপক্ষ খুব জরুরি। কিন্তু এখানে (কংগ্রেসে) পরিবারবাদ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখুন, অধীর চৌধুরীর অবস্থা।’’ হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রীর সংযোজন, ‘‘আমাদের খড়্গেজি এই সদন থেকে অন্য সদনে ‘শিফ্‌ট’ করে গিয়েছেন। গুলামজি তো পার্টি থেকেই শিফ্‌ট করে গিয়েছেন। একই প্রোডাক্ট বার বার লঞ্চ করে করে কংগ্রেসের দোকানে তালা পড়ার সময় এসে গিয়েছে।’’ কিন্তু অধীর পাল্টা দেবেন না তা কি হয়? প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা ‘কুয়োর ব্যাঙ’ বলে অধীর বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী সব কিছু হতে পারলেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রনায়ক হতে পারলেন না। এমন অশোভন বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুনব, সেটা আশা করিনি। আসলে তিনি যেখানে ছিলেন, সেখানেই রয়ে গিয়েছেন। আমরা আশা করেছিলাম, তিনি রাষ্ট্রনায়কের মতো এগোনোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু উনি কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকতে ভালবাসেন।’’

১৩ ১৮

নিয়োগ ‘দুর্নীতি’ থেকে একের পর এক মামলায় কড়া মন্তব্য এবং নির্দেশ দিয়ে তখন চর্চায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অধীর ভূয়সী প্রশংসা করেন বিচারপতির। সোজা বলে দেন, তাঁকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘আগামী দিনে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ করে একটি নির্বাচন হোক। সেই নির্বাচন যদি হয়, আমি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়কে ভোট দিতে কায়মনোবাক্যে সবার আগে লাইনে দাঁড়াব। বাংলার মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেন, তাঁর উপর ভরসা রয়েছে। এই সব ব্যক্তিত্বকে রাজনীতিতে এনে, রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিলে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।’’ তখনই তৃণমূল কটাক্ষ করে বলেছিল, যদি বিজেপিতে যোগ দেন ওই বিচারপতি? তখনও কি তাঁকে সমর্থন করবেন অধীর?

১৪ ১৮

লোকসভা ভোটের সময় হলও তাই। বিচারপতি পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে নাম লেখান অভিজিৎ। সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যাংরি’ অধীর প্রতিক্রিয়ায় অভিজিৎকে ‘কাগজের ফেলে দেওয়া ঠোঙা’ বলে কটাক্ষ করেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এ-ও বলেন, ‘‘অভিজিৎকে আর বিশেষ পাত্তা দেওয়া উচিত নয়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘গিরগিটি তার রং পাল্টেছে। এটা গিরগিটির দোষ না কি প্রকৃতির, না কি আমাদের চোখের! গাঙ্গুলি সাহেব কি গিরগিটি? না কি আমরা যা দেখি তা ভুল। কোনটা?’’ কার্যত বিস্মিত, ক্ষুব্ধ দেখায় অধীরকে।

১৫ ১৮

তৃণমূল প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পরে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের প্রতিক্রিয়া ছিল একতরফা প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করা ঠিক হয়নি তৃণমূলের। বস্তুত, শুরু থেকে বিজেপি-বিরোধী জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পাবেন বলে আশাবাদী ছিলেন জয়রাম। তৃণমূলনেত্রী মমতা যখন জানিয়েই দিয়েছেন যে বাংলায় তাঁরা একা লড়াই করবেন, তখনও জোটের আশা দেখেছেন রমেশ। অধীর আবার শুরু থেকেই মমতার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ছিলেন। তৃণমূল প্রার্থিতালিকা ঘোষণার পরে কংগ্রেস নেতা জয়রামের প্রতিক্রিয়া ছিল, একতরফা প্রার্থিতালিকা ঘোষণা করা ঠিক হয়নি। তখন আর জয়রামকে বিঁধতে ছাড়েননি অধীর। দলীয় নেতার উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘এত দিনে ওঁর দিব্যচক্ষু খুলেছে।’’

১৬ ১৮

বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেস্তে গিয়েছে। এ বার আর রয়েসয়ে নয়, সরাসরি মমতাকে আক্রমণ শুরু করেন অধীর। তিনি মন্তব্য করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয় যে উনি যদি ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে থাকেন, তবে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আর তার পরই উনি (প্রধানমন্ত্রী মোদী) বার বার ইডি-সিবিআইয়ের কাছে পাঠাবেন। এতে বিপদের মুখে পড়বে তৃণমূল। প্রধানমন্ত্রী যাতে অখুশি না হন, সেই কারণেই মমতা এই জোট থেকে নিজেকে আলাদা করে নেওয়া শ্রেয় বলে মনে করেছেন।” তাঁর বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী প্রসঙ্গে অধীরের দাবি, তাঁকে সরানোই লক্ষ্য মমতাদের। অধীরের মন্তব্য, ‘‘বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কোনও না কোনও মুসলমান প্রার্থী দাঁড় করিয়ে সংখ্যালঘু ভোটের বিভাজন ঘটাতে চাইছে। লক্ষ্য একটাই, অধীরকে হারাও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউসুফ পাঠানকে সম্মান দিতে কি জানেন আপনি? যদি চাইতেন তা হলে কেন কিছু দিন আগে যখন রাজ্যসভার ভোট হল ইউসুফকে এ বাংলা থেকে প্রার্থী করে পাঠালেন না?”

১৭ ১৮

অধীরের ব্যক্তিগত জীবনও ঘাতপ্রতিঘাতে ভরা। ১৯৮৭ সালে তিনি বিবাহ করেন অর্পিতা চৌধুরীকে। তাঁদের একটি কন্যাসন্তান ছিল। অধীরই তাঁর নাম দিয়েছিলেন শ্রেয়সী। ২০০৬ সালে কলকাতার এক বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন শ্রেয়সী। পিতা অধীর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। সতীর্থদের চেষ্টায় ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন বহরমপুরের সাংসদ। তাঁর প্রথম স্ত্রী ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রয়াত হয়েছেন।

১৮ ১৮

১৯৯৯ সাল থেকে টানা পাঁচ বারের সাংসদ অধীর। বহরমপুরের সেই ‘অপরাজেয়’কে তৃণমূলনেত্রী বলছেন কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নন। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বহরমপুর থেকে জিতে বাংলা থেকে কংগ্রেসের একমাত্র সাংসদ ছিলেন অধীর। সংসদের বাইরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই ‘মুগ্ধতা’ প্রকাশ করে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘দাদা, ফাইটার।’’ যুদ্ধেই আছেন অধীর। এবং লক্ষ্য একটাই, ষষ্ঠ বারের জয় দিয়ে ‘গড়’ রক্ষা করা।

সব ছবি: সংগৃহীত ও আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
Advertisement
আরও গ্যালারি
Advertisement