মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অহং ভেঙে দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। কড়া জবাব দিয়েছেন ‘ট্রাম্পীয় অসভ্যতা’র! চিনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রুশ প্রেসিডেন্ট নিজের গাড়িতে বসিয়ে পার্শ্ববৈঠক করতে যাওয়ার পর অন্তত তেমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ।
তিয়ানজ়িনে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
এসসিও বৈঠকে বক্তব্য পেশ করার পরেই মোদীর সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকের জন্য রওনা দেন পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্টের নিজস্ব গাড়িতে সওয়ার হয়ে বৈঠক করতে যান দুই রাষ্ট্রপ্রধান। ভারতীয় সময় বেলা ১২টার কিছু পরে মোদী এবং পুতিনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শুরু হয়।
সূত্রের খবর, এসসিও শীর্ষ সম্মেলনস্থল থেকে রিটজ়-কার্লটন হোটেলে অনুষ্ঠিত ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গ চেয়েছিলেন পুতিন। চেয়েছিলেন মোদীর সঙ্গে একসঙ্গে একই গাড়িতে যেতে।
তাই শীর্ষ সম্মেলনের পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর জন্য প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করেন পুতিন। এর পর মোদীকে নিয়ে রওনা দেন বৈঠকস্থলের উদ্দেশে। কিন্তু কেন প্রধানমন্ত্রী মোদীকে রুশ প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত গাড়ি ‘অরাস সেনাট লিমুজ়িন’-এ চাপিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পুতিন?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ভারত-রুশ বন্ধুত্ব দেখিয়ে ট্রাম্পের দম্ভ ভাঙতেই ওই পদক্ষেপ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট, যার সূত্রপাত আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের সময় থেকে।
গত ১৫ অগস্ট আলাস্কার অ্যাঙ্কোরেজ় শহরের অদূরে মার্কিন সেনাঘাঁটি ‘জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন’-এ ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। আলাস্কায় অবতরণের পর পুতিনকে তাঁর গাড়ি করে বৈঠকস্থলের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প যখন পুতিনকে নিয়ে আলাস্কা বিমানবন্দর থেকে রওনা দেন তখন রাস্তার দু’পাশে সজ্জিত ছিল আমেরিকার বিভিন্ন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং সমর হেলিকপ্টার। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতা দেখাতেই পুতিনকে নিজের গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্রাম্প। রাস্তার ধারে সাজিয়েছিলেন সামরিক বিমান এবং কপ্টার।
সেই অপমান হজম করে নিয়েছিলেন পুতিন। জবাব দিলেন ১৭ দিন পর, সোমবার। প্রধানমন্ত্রী মোদীকে পাশে বসিয়ে আমেরিকাকে দিলেন ভারত-রাশিয়া বন্ধুত্বের বার্তা। দিলেন আমেরিকার শুল্ক-হুমকির বিরুদ্ধে মস্কোর সঙ্গে নয়াদিল্লির তেল বাণিজ্যের দৃশ্যমান বিবৃতি। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞরা।
মোদীকে পার্শ্ববৈঠকের জন্য পুতিন যে গাড়িতে চড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই গাড়ির মাহাত্ম্যও কম নয়। অরাস সেনাট লিমুজ়িন গাড়িটি রুশ প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত গাড়ি। পুতিনের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে গাড়িটি।
১৯৪৫ সালে তৈরি সোভিয়েত যুগের লিমুজ়িন জ়েডআইএস-১১০-এর অনুকরণে তৈরি গাড়িটি রাশিয়ার অটোমোবাইল সংস্থা অরাস-এর নকশা করা। গাড়িটি তৈরি করেছে রাশিয়ার অটোমোটিভ প্রযুক্তি উন্নয়ন সংস্থা ‘সেন্ট্রাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ অটোমোবাইল অ্যান্ড অটোমোটিভ ইঞ্জিন ইনস্টিটিউট’ ওরফে ‘নমি’।
এর আগে মার্সিডিজ-বেঞ্জ এস ৬০০ গার্ড পুলম্যান ব্যবহার করতেন পুতিন। ২০১৮ সাল থেকে সেনাট লিমুজ়িন গাড়িটি ব্যবহার করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিনকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে গাড়িটি। একই সঙ্গে গাড়িটি রুশ সরকারের ক্ষমতা, মর্যাদা এবং শক্তির প্রতীক হিসাবেও চিহ্নিত।
লিমুজ়িন গাড়িতে ৪.৪ লিটার ভি৮ পেট্রল ইঞ্জিন রয়েছে। রয়েছে একটি বৈদ্যুতিক মোটরও। এর ইঞ্জিন প্রায় ৬০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতা উৎপাদনে সক্ষম, যা গাড়িটিকে মসৃণ ভাবে চলার জন্য যথেষ্ট গতি এবং শক্তি দেয়।
অরাসের সেনাট লিমুজ়িন গাড়িটির ওজন প্রায় ৬,২০০ কিলোগ্রাম। মাত্র ছ’সেকেন্ডে ঘণ্টায় ১০০ কিমি গতি তুলতে পারে গাড়িটি! পরবর্তী কয়েক সেকেন্ডে সেটি ২৫০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে ছুটতে পারে।
মনে করা হয় পুতিনের সেনাট লিমুজ়িনটি একটি ‘চলমান দুর্গ’। এতে শক্তিশালী বুলেটপ্রুফ কাচ এবং পুরু সাঁজোয়া দরজা রয়েছে। গাড়ির মেঝে এবং ছাদের নীচেও সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যা অতর্কিত আক্রমণের সময় গুলি এবং বিস্ফোরণ থেকে যাত্রীদের নিরাপদ রাখে।
শত্রুদের আক্রমণের পরেও গাড়িটি যাতে ছোটা বন্ধ না করে, তার জন্য সেটিতে একটি বিশেষ জ্বালানি ট্যাঙ্ক রয়েছে। রয়েছে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এবং ক্ষতিকারক গ্যাস থেকে যাত্রীদের সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থাও।
লিমুজ়িনের পিছনের জানলা দিয়ে জরুরি বহির্গমন পথ রয়েছে। এতে একটি নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থাও রয়েছে। পুতিনের গাড়িটি চালানোর দায়িত্ব থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়া বাহিনীর সদস্যদের উপর।
সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়িটির সাধারণ মডেলের দাম তিন কোটি টাকারও বেশি। কয়েকটি মডেলের দাম আট কোটি পর্যন্ত হতে পারে। শোনা যায় উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনকেও বিলাসবহুল গাড়িটি উপহার দিয়েছেন পুতিন। সোমবার সেই গাড়িতে চড়িয়েই মোদীর সঙ্গে পার্শ্ববৈঠক করতে যান রুশ প্রেসিডেন্ট।
উল্লেখ্য, ট্রাম্পের শুল্কনীতি রাশিয়া, ভারত এবং চিনকে আরও কাছাকাছি এনে নয়া ত্রিদেশীয় অক্ষ গঠনের সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। আমেরিকার আপত্তি সত্ত্বেও রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর জরিমানা-সহ ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
সেই আবহে আগামী রবি ও সোমবার (৩১ অগস্ট-১ সেপ্টেম্বর) চিনের বন্দর শহর তিয়ানজ়িনে এসসিও (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন)-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। রবিবার জিনপিং এবং সোমবার পুতিনের সঙ্গে পার্শ্ববৈঠকও করেন তিনি।
অন্য দিকে, পুতিন-মোদী বৈঠকের পরই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পরস্পরবিরোধী দুই বার্তা এসেছে ওয়াশিংটন থেকে। প্রথমটি, মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়োর তরফে। দ্বিতীয়টি, সে দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
রুবিয়োর দাবি ছিল, ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী। এই সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে। কিন্তু ট্রাম্প সরাসরি শুল্কবিবাদের আবহে ভারতের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে অভিযোগ করেন, দশকের পর দশক ধরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে একতরফা ফয়দা লুটেছে ভারত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত ও রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমি দেশগুলি মস্কো থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে দিয়ে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে।
অন্য দিকে, নয়াদিল্লি বর্তমানে মস্কোর বৃহত্তম তেল ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক জটিলতার মধ্যে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে দুই দেশ রুপি-রুবেল বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ করারও চেষ্টা করছে।