জলদস্যু বলতেই যে ছবি মাথায় আসে, তা হল বড় নৌকার উপর দাঁড়িয়ে ভয়ঙ্কর একদল মানুষ। তাঁদের হাতে-কোমরে ততোধিক ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র, মাথায় টুপি, এক চোখ ঢাকা কালো কাপড়ে। অনেকের আবার মনে পড়তে পারে হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ অভিনীত ‘পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’ সিনেমার কথা।
কিন্তু ছোটবেলা থেকে শোনা বা সিনেমার পর্দায় দেখা জলদস্যুদের গল্প পুরুষপ্রধান। কিন্তু অনেকেই জানেন না, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন এক ভয়ঙ্কর জলদস্যু ছিলেন, যিনি মহিলা! বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত তাঁর নাম শুনলে। সমুদ্র ব্যবসায়ীরাও ভয়ে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে নিতেন।
ভয়ঙ্কর সেই জলদস্যুর নাম চেং শি ওরফে জেং ই সাও। অন্যতম এক জন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জলদস্যু। দস্যুবৃত্তিতে সাফল্যের নজির তৈরি করেছিলেন চেং।
তবে প্রথম জীবনে জলদস্যু ছিলেন না চেং। ছিলেন এক জন সাধারণ যৌনকর্মী। সেখান থেকেই অষ্টাদশ শতকে দক্ষিণ চিন সাগরের ত্রাস হয়ে ওঠেন তিনি। জলদস্যু হিসাবে কার্যত সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
চিনা উপকূল এলাকা গংডং-এ ১৭৭৫ সালে জন্ম হয় চেং-এর। গৃহযুদ্ধ এবং চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি।
তীব্র আর্থিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে গংডং উপকূলবর্তী এলাকার মানুষেরা বিভিন্ন বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়তেন। সে সব অপরাধমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল নারী পাচার।
আবার গংডং-এর অনেক মেয়ে অভাব-অনটনের মুখে জীবনধারণের জন্য নিজে থেকেই সমুদ্রে ভাসমান যৌনপল্লিতে নাম লেখাতেন। ১৮০১ সালে তেমনই এক যৌনপল্লিতে নাম লিখিয়েছিলেন চেং।
নিজের ব্যবসায়িক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সেই সময় প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করতে সক্ষম হন চেং। সেই ভাসমান যৌনপল্লিতেই একদিন হাজির হন সেই সময়কার কুখ্যাত জলদস্যু জেং শি জেং।
প্রথম দেখাতেই চেং-এর প্রেমে পড়ে যান জেং। বিয়ের প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেন। চেং-এর শর্ত ছিল বিয়ে করতে হলে জেংকে তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি চেংকে দিয়ে দিতে হবে।
শর্ত মেনে নেন জেং। চেং-ও বিয়েতে রাজি হয়ে যান। বিয়ের পর চেং পরিচিত হন জেং ই সাও হিসাবে, যার অর্থ হল জেং-এর স্ত্রী। জলদস্যু মহলে ওই নামেই পরিচিতি তৈরি হয় তাঁর।
সেই সময় দক্ষিণ চিন সাগরে জলদস্যুদের ছোট ছোট দল তাদের নিজেদের মতো করে লুটপাট চালাত। স্বামীর সঙ্গে তাঁদের একত্রিত করার উদ্যোগী হন চেং। জলদস্যুদের একটি মহাজোট তৈরি করেন। সেই জোটে শামিল হয়েছিলেন প্রায় ৭০ হাজার জলদস্যু।
জেং এবং চেং সে সময় জেন বো শাই নামে এক বালককে শিক্ষানবিশ হিসাবে রেখেছিলেন। পরবর্তী কালে তাকে দত্তকও নেন জলদস্যু দম্পতি।
১৮০৭ সালে চেং-এর স্বামী মারা যান। তখন থেকে জলদস্যু সাম্রজ্যের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন চেং। একা হাতে সামলাতে থাকেন সবটা।
সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য দত্তক ছেলেকে স্বামীর পুরনো বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব দেন চেং। দত্তক পুত্র যাতে কোনও ভাবে বিশ্বাসভঙ্গ করতে না পারেন, তার জন্য সেই ছেলেকে বিয়েও করে নেন চেং।
এর পর দু’জনে মিলে মন দেন সাম্রাজ্য বিস্তারে। ধীরে ধীরে সমুদ্রের ‘মুকুটহীন রানি’ হয়ে ওঠেন। জলদস্যুদের জন্য নানা আইন-কানুনও তৈরি করেন। কেউ যদি বিশ্বাসভঙ্গ বা চুরি করে তবে তার মাথা কেটে নেওয়ার নিদান ছিল ওই আইনে। অনুমতি না নিয়ে গরহাজির হলে কান কেটে নেওয়ার কথাও বলা হয় আইনে।
সেই সময় গংডং-এ নুনের জাহাজের উপর হামলা শুরু করেন চেং। একটা সময় দেখা যায়, তাঁর দখলে চলে এসেছে ২৭০টি নুনের জাহাজ। নুন ব্যবসায়ীদের জন্য পাসপোর্ট ব্যবস্থাও চালু করেন তিনি। যাঁরা গংডং দিয়ে নুন অন্যত্র নিয়ে যাবেন তাঁদের চেং-এর থেকে পাসপোর্ট নিতে হবে, এই ছিল নিয়ম।
কিন্তু কী সেই পাসপোর্ট ব্যবস্থা? চেং নিয়ম করেন, জলদস্যুদের আক্রমণ বাঁচিয়ে নুন অন্যত্র নিয়ে যেতে গেলে, ব্যবসায়ীদের টাকা দিয়ে পাসপোর্ট কিনতে হবে তাঁর কাছ থেকে। ওই পাসপোর্ট দেখালে জলদস্যুরা আর আক্রমণ করবে না জাহাজে।
পরবর্তী কালে মাছ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য হয়। তাঁদেরও নিরাপদে চলাচলের জন্য পাসপোর্ট কিনতে হত চেং-এর কাছ থেকে।
কর আদায়ের জন্য গংডং এলাকায় একাধিক অফিস তৈরি করিয়েছিলেন চেং। সেই অফিস থেকে কর আদায় করা হত সমুদ্রে নিরাপদে চলাচলের জন্য। কার্যত সমান্তরাল রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন চেং।
যেহেতু খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের জন্য জলদস্যুরা মূলত গ্রামবাসীদের উপর নির্ভর করতেন, তাই চেং-এর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, পাসপোর্ট নেওয়া গ্রামবাসীদের নৌকায় জলদস্যুরা হামলা চালালে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
চেং-এর নেতৃত্বে জলদস্যুদের বাড়বাড়ন্ত চিন সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। তাদের রুখতে সেই সময় ব্রিটিশ এবং পর্তুগিজ নৌসেনাকে সাহায্যের আবেদন জানায় সে দেশের সরকার। একাধিক লড়াইয়ের পরও চেং-কে পরাস্ত করা যায়নি।
শেষ পর্যন্ত ১৮১০ সালে উপযুক্ত পেনশন এবং শাস্তি না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চেং এবং তাঁর সঙ্গীদের এই পথ থেকে সরে আসার আবেদন জানিয়েছিল চিন সরকার। সেই প্রস্তাব মেনে নেন চেং এবং তাঁর সঙ্গীরা। জলদস্যুবৃত্তির পথ থেকে সরে আসেন।
এর পর দীর্ঘ দিন আর কোনও খোঁজ মেলেনি চেং-এর। ১৮২২ সালে দ্বিতীয় স্বামী তথা দত্তক পুত্র মারা গেলে চেং ফের গংডং-এ ফিরে আসেন। সেখানে তাঁর সন্তানদের মানুষ করতে থাকেন।
শোনা যায় গংডং-এ একটি ক্যাসিনোও খুলেছিলেন চেং। সেই ক্যাসিনো থেকে বিপুল আয়ও করতেন। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালকিন চেং মারা যান ৬৯ বছর বয়সে।