ভুয়ো পাসপোর্ট, জাল ভিসা, এমনকি ভুয়ো আইপিএস, আইএএস অফিসার— এত দিন এমন নানা বিষয় শোনা যেত। অভিযোগ পেয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ত জালিয়াতেরা। এ বার প্রকাশ্যে ভুয়ো দূতাবাস। গাজ়িয়াবাদে এত দিন সেই দূতাবাসের অস্তিত্ব ছিল বলে জানিয়েছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) নয়ডা ইউনিট। গ্রেফতার করা হয়েছে হর্ষবর্ধন জৈন নামে এক ব্যক্তিকে।
অভিযোগ, ‘ওয়েস্টার্কটিকা’ নামে আন্টার্কটিকা মহাদেশের এক ক্ষুদ্র দেশের ভুয়ো দূতাবাস চালাতেন হর্ষবর্ধন। জানা গিয়েছে, গাজ়িয়াবাদের কবিনগর এলাকায় একটি বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে দূতাবাস তৈরি করেছিলেন তিনি।
ওই বাড়ির বাইরে সব সময় দাঁড় করানো থাকত একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি। সেই সব গাড়ির নম্বরপ্লেটও কোনও কূটনীতিকের গাড়ির মতোই। নিজেকেও কূটনীতিক হিসাবে পরিচয় দিতেন হর্ষবর্ধন।
ওয়েস্টার্কটিকা ছাড়াও সাবোরগা, পুলভিয়া, লোডোনিয়ার মতো ছোট ছোট দেশের ‘রাষ্ট্রদূত’ বলে নিজের পরিচয় দিতেন হর্ষবর্ধন। শুধু তা-ই নয়, ওই সব দেশের ভুয়ো পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র এবং জাল সরকারি নথিও ব্যবহার করতেন।
ওই ভুয়ো দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেটযুক্ত চারটি বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার করে এসটিএফ। ১২টি কূটনৈতিক পাসপোর্টও ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়। উদ্ধার হয় ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের স্ট্যাম্প-সহ জাল নথি। এ ছাড়াও দু’টি জাল প্যান কার্ড, বিভিন্ন দেশ এবং কোম্পানির ৩৪টি রবার স্ট্যাম্পও ওই বাড়ি থেকে খুঁজে পেয়েছে পুলিশ।
একই সঙ্গে তল্লাশি অভিযানে ওই বাড়ি থেকে দু’টি জাল প্রেস আইডি কার্ড, সাড়ে ৪৪ লক্ষ টাকা নগদ, নেতাদের ছবি এবং বেশ কয়েকটি দেশের বিকৃত বৈদেশিক মুদ্রাও পেয়েছে পুলিশ।
তদন্তকারীদের অনুমান, কোনও আর্থিক জালিয়াতি বা কোনও আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে জড়িত হর্ষবর্ধন। তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে চাকরির চক্র চালানোর এবং অর্থ তছরুপ সংক্রান্ত একটি চক্রে জড়িত থাকারও অভিযোগ উঠেছে।
কিন্তু হর্ষবর্ধনের গ্রেফতারি এবং জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই জনসাধারণের মনে একটাই প্রশ্ন উঠছে— কী এই ‘ওয়েস্টার্কটিকা’?
‘ওয়েস্টার্কটিকা’ হল একটি ‘মাইক্রোনেশন’। ‘মাইক্রোনেশন’ হল এমন একটি গোষ্ঠী বা সত্তা যার প্রতিনিধিরা দাবি করেন যে, তাঁরা একটি স্বাধীন দেশ বা সার্বভৌম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। যদিও অন্য কোনও প্রতিষ্ঠিত দেশ তাদের আইনি স্বীকৃতি দেয় না।
মার্কিন নৌবাহিনীর প্রাক্তন কর্তা ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরি ২০০১ সালে ওয়েস্টার্কটিকা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে তার ‘গ্র্যান্ড ডিউক’ হিসাবে দাবি করেন।
ম্যাকহেনরি নিজেকে শাসক নিযুক্ত করার জন্য অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থার মধ্যে একটি ফাঁক খুঁজে নিয়েছিলেন। অ্যান্টার্কটিক চুক্তি অনুযায়ী, কোনও দেশ অ্যান্টার্কটিকার কিছু অংশের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না।
কিন্তু কোনও ব্যক্তি অ্যান্টার্কটিকার ওই সব অংশে কর্তৃত্ব ফলাতে পারবেন কি না তা নিয়ে ওই চুক্তিতে কিছু উল্লেখ ছিল না। আর সেই সুযোগই নিয়েছিলেন ম্যাকহেনরি।
ওয়েস্টার্কটিকার আয়তন ছ’লক্ষ ২০ হাজার বর্গমাইল এবং এটি অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত। ওয়েস্টার্কটিকা দাবি করে, তাদের ২,৩৫৬ জন নাগরিক রয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা কেউই ওয়েস্টার্কটিকায় থাকেন না।
ওয়েস্টার্কটিকার নিজস্ব পতাকা এবং মুদ্রাও রয়েছে। উল্লেখ্য, কোনও প্রতিষ্ঠিত দেশ ওয়েস্টার্কটিকাকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তার মতোই অন্য ক্ষুদ্র দেশগুলির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে ওয়েস্টার্কটিকা।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় ওয়েস্টার্কটিকা একটি অলাভজনক সংস্থা হিসাবেও কাজ করে। আগে সেটির নাম ছিল ‘গ্র্যান্ড ডাচি অফ ওয়েস্টার্কটিকা’। সংস্থাটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং অ্যান্টার্কটিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে।
ভুয়ো দূতাবাসকাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া হর্ষবর্ধন নিজেকে ওয়েস্টার্কটিকার ধনকুবের হিসাবে পরিচয় দিতেন। কূটনৈতিক নম্বর প্লেটযুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতেন।
অভিজাত মহলে সুবিধা পেতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির ছবি নিয়েও নাকি ঘুরে বেড়াতেন হর্ষবর্ধন। অভিযোগ, সেই ছবিগুলোও ছিল তাঁরই মতোই ভুয়ো। ২০১১ সালে অবৈধ ভাবে স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে।