সম্প্রতি ভারত-সহ রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যবসায়িক সঙ্গীর উপর শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে রুশ ঘনিষ্ঠতার জন্য একটি জরিমানার (পেনাল্টি) কথাও উল্লেখ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সোমবার ট্রাম্প ফের মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে নয়াদিল্লিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছেন, ভারতের উপর শুল্কের হার আরও বৃদ্ধি করবে আমেরিকা।
ট্রাম্পের অভিযোগ, ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ থেকে নাকি বিপুল পরিমাণে তেল কিনে মুনাফার জন্য খোলা বাজারে বেচছে ভারত। সেই ‘অপরাধে’ এ বার ভারতীয় পণ্যের উপর আরও শুল্ক চাপানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
যদিও ট্রাম্পের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। ভারতকে এ ভাবে ‘নিশানা’ করা অন্যায় এবং অযৌক্তিক বলেও দাবি করা হয়েছে বিদেশ মন্ত্রকের তরফে।
একটি বিবৃতি জারি করে মন্ত্রক বলেছে, ‘‘যে কোনও বৃহৎ অর্থনীতির মতো, ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’’
ভারতের তরফে বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “তেল বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করে ভারতের উপর ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কেবল অযৌক্তিকই নয়, এটি বাজারের বাস্তবতাও উপেক্ষা করে। বাণিজ্যতথ্যও ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং বিষয়টি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদারিও দুর্বল করে।”
একই সঙ্গে ট্রাম্পের দাবি উড়িয়ে ভারতের পাল্টা দাবি, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নই বরং রাশিয়ার থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস, ইউরেনিয়াম, সার এবং প্যালাডিয়ামের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানি করে চলেছে।
অন্য দিকে, রাশিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকিকে বর্তমান সময়ের এক ‘দুঃখজনক বাস্তব’ বলে উল্লেখ করেছে মস্কো। এর ফলে গোটা বিশ্ব প্রভাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে রুশ বিদেশ মন্ত্রক।
রাশিয়ার অভিযোগ, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে এই নয়া ঔপনিবেশিক নীতিতে এগোচ্ছে আমেরিকা। যারা এই নীতি মানছে না, তাদের উপর আমেরিকা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে চাপ তৈরির চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ মস্কোর।
রুশ বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র স্পষ্ট করেছেন, এই ‘অবৈধ একতরফা নিষেধাজ্ঞা’র মোকাবিলা করতে বন্ধুরাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করতে প্রস্তুত রাশিয়া। তিনি জানান, রাশিয়া চায় প্রকৃত অর্থে একটি বহুপাক্ষিক এবং ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থা চালু হোক।
ট্রাম্পের শুল্ক হুঁশিয়ারির এই আবহের মধ্যেই আরও একটি খবর বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর তা হল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মস্কো যাত্রা।
রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের সফরে মঙ্গলবার মস্কো সফরে যাচ্ছেন ডোভাল। এই সফর পূর্বপরিকল্পিত ছিল। কিন্তু ট্রাম্প সোমবার ভারতের বিরুদ্ধে নতুন করে শুল্ক আরোপের হুমকি ঘোষণা করার পর এই সফরের তাৎপর্য আরও বেড়ে গিয়েছে।
ভারত নিয়ে ট্রাম্পের সর্বশেষ বিবৃতির আগে পরিকল্পনা করা ডোভালের মস্কো সফর ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ডোভালের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সঙ্কেত বলে মনে করছেন অনেকে।
সরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী, রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতা সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন ডোভাল।
একই সঙ্গে, ডোভাল রাশিয়ায় থাকাকালীন মস্কোর কাছ থেকে আরও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করা নিয়েও দু’পক্ষের আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। আলোচনা হতে পারে উচ্চ প্রযুক্তি খাতে সম্ভাব্য সহযোগিতা অন্বেষণ নিয়েও।
আবার ডোভালের মস্কো সফরের পর বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করও চলতি মাসের শেষের দিকে রাশিয়া সফরে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর সেই সফরও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
যদিও সূত্রের খবর, মস্কো সফরে গিয়ে ভারতীয় পণ্যের রফতানি বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলে সহযোগিতা এবং বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন জয়শঙ্কর। রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ডেনিস মান্টুরভের সঙ্গেও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার কথা রয়েছে তাঁর।
পাশাপাশি মনে করা হচ্ছে, ডোভাল এবং জয়শঙ্করের রাশিয়া সফরের সময় এসইউ-৫৭ যুদ্ধবিমান কেনা নিয়েও দু’পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে আলোচনা হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশ আবার মনে করছেন, ডোভাল বা জয়শঙ্করের মস্কো সফরের সঙ্গে ট্রাম্পের শুল্ক হুঁশিয়ারির কোনও যোগ নেই। এ বছরের শেষের দিকে বার্ষিক ভারত-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের কথা রয়েছে নয়াদিল্লির। সে সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভারতে আসার কথা। এর আগে ২০২১ সালে শেষ নয়াদিল্লি সফরে এসেছিলেন পুতিন।
সেই সম্মেলনে জ্বালানি নিরাপত্তা, খাদ্য সরবরাহ এবং রাশিয়ান শিল্পে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই তার আগে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতেই ডোভাল এবং জয়শঙ্কর রাশিয়া যাচ্ছেন বলেই অনেকে মনে করছেন।