বছরখানেক আগের কথা। মুম্বইয়ে তখন সাজ সাজ রব। দেশ-বিদেশ থেকে এসে চাঁদের হাট বসিয়েছিলেন খ্যাতনামীরা। হবে না-ই বা কেন, ভারতের বিত্তশালী ব্যবসায়ী মুকেশ অম্বানীর কনিষ্ঠ পুত্রের বিয়ে বলে কথা! সেই বিয়ে, যা উদ্যাপন হতে দেখেছিল সারা বিশ্ব। সেই বিয়ে, যা ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ভক্তি এবং বিশ্বব্যাপী উদ্যাপনের এক বিরল নিদর্শন। সেই বন্ধন, যা ভারতকে বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা জায়গা করে দিয়েছে।
এক বছর আগে সাত পাকে বাঁধা পড়েছিলেন মুকেশ অম্বানীর পুত্র অনন্ত অম্বানী এবং তাঁর দীর্ঘকালীন প্রেমিকা রাধিকা মার্চেন্ট। অনন্ত এবং রাধিকার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যে কেবল মনোমুগ্ধকর ছিল তা-ই নয়, এটি ছিল ভারতের সেই সাংস্কৃতিক মুহূর্ত, যা বিশ্ব জুড়ে প্রতিফলিত এবং প্রতিধ্বনিত হয়েছিল।
২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত অনন্ত-রাধিকার বিয়ে ছিল প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, ভারতীয় ঐতিহ্য, জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপনের এক বিরল উদাহরণ। এমন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা ভারতের আত্মা এবং বিশ্বমঞ্চে দেশের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে তুলে ধরেছিল।
বিয়ে উপলক্ষে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে অতিথি সমাগম হয়েছিল। ধর্মগুরু থেকে সাধু-সন্ন্যাসী, হলিউড থেকে বলিউড, ক্রীড়াজগৎ থেকে ব্যবসা, রাজনীতি থেকে শিল্প— নিমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন সব ক্ষেত্রেরই খ্যাতনামীরা।
রাধিকা-অনন্তের বিয়ের এক বছর পেরিয়েছে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ভারত এবং বিশ্ববাসীর মননে। ২০২৪ সালের সেই বিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানকে অতিক্রম করে ভারতীয় সাংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে।
হিন্দু সংস্কৃতিতে বিয়ে কেবল সামাজিক চুক্তি নয়, একটি পবিত্র বন্ধন। দু’টি মানুষের আত্মার মিলন। দুই পরিবারের একাত্ম হওয়ার নিদর্শন। বিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি, যা স্বামী-স্ত্রী সারা জীবন ধরে পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকেন।
বর্তমানে যেখানে ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’, আলোর রোশনাই এবং আধুনিকতার ভিড়ে ভারতীয় বিয়ের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি চাপা পড়ে গিয়েছে, সেখানে সেই ঐতিহ্য এবং রীতিনীতিতে ভর করেই এক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনন্ত-রাধিকা।
বাবা-মা, গুরুজন, আধ্যাত্মিক গুরু, সাধু-সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন নবদম্পতি। বিশ্বের কাছে পাঠিয়েছিলেন একটি শক্তিশালী বার্তা।
অনন্ত-রাধিকার বিয়ে যে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন, তা প্রমাণিত হয়েছিল তাঁদের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র দেখেও। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে গিয়ে বিয়ের প্রথম নিমন্ত্রণপত্রটি মহাদেবকে উৎসর্গ করেছিলেন নীতা। তার পর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র বিলির পালা। বিয়ের কার্ডটিও ছিল মন্দিরের ধাঁচে বানানো।
অনন্ত এবং রাধিকার বিয়ে ভারতকে বিশ্বের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসাবেও তুলে ধরেছিল সারা পৃথিবীর কাছে। ভারতের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে বিশ্বের দরবারে। বেশ কয়েক দিন ধরে চলা সেই বিবাহ উদ্যাপনের মধ্যে অসংখ্য ছোট, কিন্তু গভীর ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বিভিন্ন বৈদিক হিন্দু ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিক নেতাদের সমাবেশে চার হাত এক হয়েছিল অনন্ত-রাধিকার। অনন্ত-রাধিকার বিয়েতে আশীর্বাদ করতে উপস্থিত ছিলেন দ্বারকার শঙ্করাচার্য স্বামী সদানন্দ সরস্বতী, জোশীমঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরান্দ সরস্বতী, ইসকনের গৌরাঙ্গ দাস প্রভু, গৌর গোপাল দাস, রাধানাথ স্বামী থেকে শুরু করে পূজ্যশ্রী রমেশভাই ওজা, গৌতমভাই ওজা, পূজ্যশ্রী দেবপ্রসাদ মহারাজ, বিজুবেন রাজানি, শ্রী বালক যোগেশ্বরদাস জি মহারাজ, পূজ্যশ্রী চিদানন্দ সরস্বতী, শ্রী নম্রমুনি মহারাজ, ধীরেন্দ্রকুমার গর্গ, বাবা রামদেব, স্বামী রামভদ্রাচার্য, স্বামী কৈলাসানন্দের মতো ধর্মগুরুরা।
অম্বানী-পুত্রের বিয়েতে ভারতীয় রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, তারকারা তো ছিলেনই, একই সঙ্গে ছিলেন বিশ্বের নামীদামি ব্যক্তিত্বেরা। আমেরিকার রাজনীতিবিদ জন কেরি, ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, বরিস জনসন থেকে শুরু করে ইটালি, অস্ট্রিয়া, কানাডা, সুইডেন, মলদ্বীপ-সহ বহু দেশের রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। যেন সারা বিশ্বের পবিত্র মিলনভূমি হয়ে উঠেছিল অনন্ত-রাধিকার বিয়ে।
রাধিকা-অনন্তের বিয়েতে যেমন আমিন নাসের, মারে অচিনক্লস, রবার্ট ডাডলি, মার্ক টাকার, বার্নার্ড লুনি, মাইকেল গ্রিমস, শান্তনু নারায়ণ, এমা ওয়ালমসলি, জিম টিগের মতো খ্যাতনামী শিল্পপতিরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন কিম কার্দাশিয়ান, জাস্টিন বিবারের মতো আন্তর্জাতিক তারকারা। সকল বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং অতিথিরা ঐতিহ্যবাহী রঙিন ভারতীয় পোশাকে সেজেছিলেন, যা ভারতের বৈচিত্র এবং শিল্পের অন্যতম নিদর্শন।
‘মানবতার সেবাই ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত সেবা’— এই প্রকৃত চেতনা থেকেই অম্বানী পরিবার ৫০ দম্পতির জন্য গণবিবাহেরও আয়োজন করেছিলেন অনন্ত-রাধিকার বিয়ে উপলক্ষে। রিলায়্যান্সের কর্পোরেট পার্কে সেই বিয়ের আসর বসেছিল।
বিবাহ উদ্যাপনের পাশাপাশি তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি দিন ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষের জন্য মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন অম্বানীরা, যা মানবতার সেবার একই নীতিকে প্রতিফলিত করে।
অনন্ত-রাধিকার বিয়ে শুধু জাঁকজমকের জন্য নয়, এর নেপথ্যে থাকা মূল্যবোধের জন্যও অনন্য। সংস্কৃতি সংরক্ষণের প্রতি অম্বানী পরিবারের মনোযোগ, তাঁদের অন্তর্ভুক্তিমূলক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনহিতকর কাজের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার উদ্যাপনের নিদর্শন।