১৯৮৩ সালে বলিপাড়ায় পদার্পণ। তার পর চার দশক ধরে বলিউড জগতে কাজ করেছেন সতীশ কৌশিক। কখনও ক্যামেরার সামনে, কখনও বা বড় পর্দার পিছনে। বৃহস্পতিবার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সতীশ। বৃহস্পতিবার ভোরবেলা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। পরিচালক-অভিনেতার অকালপ্রয়াণে বলি তারকারা শোকস্তব্ধ।
মঙ্গলবার বলিউডের জনপ্রিয় গীতিকার জাভেদ আখতারের বাড়িতে হোলির অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সতীশ। বৃহস্পতিবার দিল্লিতেই ছিলেন তিনি। সে দিন ভোরবেলা শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পর সতীশ তাঁর গাড়ির চালককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। গাড়িতে হাসপাতাল যাওয়ার পথেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৬ বছর।
বলিপাড়ার নামকরা তারকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন সতীশ। বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রির কপূর পরিবারের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। শেখর কপূর থেকে অনিল কপূরের বন্ধুর মতো ছিলেন সতীশ।
১৯৫৬ সালের ১৩ এপ্রিল হরিয়ানার মহেন্দ্রগড়ে জন্ম সতীশের। হরিয়ানাতেই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে দিল্লিতে চলে আসেন তিনি। ১৯৭২ সালে দিল্লির কিরোরি মাল কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি।
অভিনয়ের প্রতি সতীশের আগ্রহ ছিল বরাবর। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি থিয়েটারে যোগ দেওয়ার ভাবনাচিন্তা করছিলেন তিনি। নয়াদিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা কলেজে অভিনয় শেখার জন্য ভর্তি হন তিনি। অনুপম খেরের সঙ্গে সেখানে অভিনয় শিখেছিলেন সতীশ।
থিয়েটার শিল্পী হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন সতীশ। ‘সেলসম্যান রামলাল’ নাটকের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। এমনকি, সতীশের সিনেমাজগতেও আসা থিয়েটার সূত্রেই।
মিনি মাথুরকে দেওয়া এক পুরনো সাক্ষাৎকারে সতীশ জানিয়েছিলেন যে, পৃথ্বী থিয়েটারে তাঁর নাটক দেখতে গিয়েছিলেন বলি অভিনেতা অনিল কপূর। সতীশের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন অনিল। তার পর অভিনেতা তাঁর ভাই বনিকে সতীশের ব্যাপারে জানান।
‘ওহ সাত দিন’ নামের একটি রোম্যান্টিক ড্রামা ঘরানার ছবির প্রযোজনার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সুরিন্দর কপূর এবং বনি কপূর। এই ছবিতে সতীশকে অভিনয়ের সুযোগ দেওয়ার জন্য বনিকে অনুরোধ করেছিলেন অনিল।
১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওহ সাত দিন’ ছবিতে এক ফুলবিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সতীশ। অভিনয়ের জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে বনি প্রথমে ২০১ টাকা দিতে চেয়েছিলেন সতীশকে।
কিন্তু সতীশের পারিশ্রমিক বাড়ানো নিয়ে বনির সঙ্গে কথা বলেছিলেন অনিল। তার পর অনিলের কথায় ২০১ টাকা থেকে বাড়িয়ে সতীশের পারিশ্রমিক ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
‘ওহ সাত দিন’ ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনিল কপূর। সতীশ এক সাক্ষাৎকারে অনিলের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে মুখ খোলেন। সতীশ বলেন, ‘‘অনিলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহু বছরের। এক বার ওর সঙ্গে ছবির শুটিং করছিলাম আমি। কিন্তু আমার কাছে পরবার মতো কোনও পোশাক ছিল না। কিছু ক্ষণ পর দেখলাম, অনিল কোথা থেকে আমার জন্য একটা শার্ট এনে দিল। ওই শার্টটি নাকি ‘ফুল খিলে হে গুলশন গুলশন’ ছবিতে ঋষি কপূর পরেছিলেন। তা জানার পর আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।’’
‘ওহ সাত দিন’ ছবিতে অভিনয়ের পর শেখর কপূর পরিচালিত ‘মাসুম’ ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা যায় সতীশকে। ওই ছবিতে সহ পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। শেখর কপূর এক বার টুইটারে এই ছবির শুটিংয়ের মুহূর্ত নিয়ে লিখেছিলেন।
‘মাসুম’ ছবির শুটিং চলাকালীন নাকি সতীশ এক বার শেখরকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, সেটে যদি শেখর রেগে যান, তবে কি তিনি সতীশের উপর চিৎকার করবেন?
সতীশের প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে যান শেখর। কেন তিনি এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন, তা জানতে চাওয়ায় সতীশ বলেছিলেন, ‘‘আপনি যদি আমার উপর চিৎকার না করেন, তা হলে এখানকার লোকজন জানবেন কী করে যে আমি সহ পরিচালক?’’
হিন্দি ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনায় নিজের হাত পাকাচ্ছিলেন সতীশ। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র ক্যালেন্ডার চরিত্রে হোক বা ‘দিওয়ানা মস্তানা’ ছবিতে— অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন সতীশ।
‘রাম লক্ষ্মণ’ এবং ‘সাজন চলে সসুরাল’ ছবিতে কৌতুকাভিনেতা হিসাবে অভিনয়ের জন্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন সতীশ। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ব্রিক লেন’ নামের একটি ইংরেজি ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
১৯৯৩ সালে ‘রূপ কি রানি চোরো কা রাজা’ ছবির মাধ্যমে পরিচালনায় প্রথম হাতেখড়ি হয় সতীশের। শ্রীদেবী এবং অনিল কপূর এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।
১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় সতীশ পরিচালিত ‘প্রেম’ নামের রোম্যান্টিক ঘরানার ছবি। সঞ্জয় কপূর এবং তব্বু এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু এই ছবিটি বক্স অফিসে সফল হয়নি।
‘প্রেম’ মুক্তির চার বছর পর বক্স অফিসকে হিট ছবি উপহার দেন সতীশ। ‘হম আপকে দিল মে রহতে হ্যায়’ ছবির জন্য অনিল কপূর এবং কাজলকে বেছে নিয়েছিলেন সতীশ। এই ছবিতেও নাকি অনিলের জন্য কাজ পেয়েছিলেন পরিচালক।
‘হম আপকে দিল মে রহতে হ্যায়’ ছবির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন ডি রামানাইডু। ছবির পরিচালকের জন্য সতীশকেই প্রথম পছন্দ ছিল অনিলের। কিন্তু রামানাইডু ভরসা পাচ্ছিলেন না। পরে অনিলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সতীশকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
নব্বইয়ের দশকের একাধিক ছবির পাশাপাশি ‘ভারত’, ‘বাগী ৩’, ‘খালি পিলী’, ‘ঢিশুম’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে সতীশকে। ‘থর’ ওয়েব সিরিজ়েও অভিনয় করেছেন তিনি।
চলতি বছরেই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে কঙ্গনা রানাউত পরিচালিত এবং প্রযোজিত ছবি ‘এমার্জেন্সি’। এই ছবিতে সতীশ অভিনয় করেছেন বলেও জানা যায়।
বলি অভিনেত্রী নীনা গুপ্তের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব ছিল সতীশের। কলেজে পড়ার সময় থেকে একে অপরকে চিনতেন তাঁরা। বলিপাড়ায় কানাঘুষো শোনা যায় যে, নীনাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই বিয়ে করতে চেয়েছিলেন সতীশ।
২০২১ সালে নীনার আত্মজীবনী ‘সচ কহুঁ তো’-তে অভিনেত্রী জানিয়েছেন যে, মাসাবার জন্মের আগে নীনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন সতীশ। সতীশ বলেছিলেন, ‘‘চিন্তা কোরো না, যদি সন্তানের গায়ের রং কালো হয় তুমি বোলো ও আমার সন্তান। আমরা বিয়ে করে নেব, কেউ কোনও সন্দেহ করবে না।’’ যদিও পরে নীনার সঙ্গে বিয়ে হয়নি সতীশের।
১৯৮৫ সালে শশী কৌশিককে বিয়ে করেন সতীশ। ১৯৯৬ সালে প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম দেন শশী। কিন্তু জন্মের দু’বছর পর মারা যায় তাঁদের পুত্র। ২০১২ সালে সারোগেসির মাধ্যমে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন শশী।