ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ লড়াকু জেট ‘এফ-৩৫বি লাইটনিং টু’র যুধিষ্ঠির দশা! টানা ২০ দিন পেরিয়ে মালাবার উপকূলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। রোদ-জল-বৃষ্টিতে পুড়লেও নট নড়নচড়ন! সূত্রের খবর, কোনও ভাবেই আর সেটিকে আকাশে ওড়াতে না পারায় এ বার লড়াকু জেটটিকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আটলান্টিকের পারের দ্বীপরাষ্ট্র। সেই প্রক্রিয়া শেষ হলে সামরিক মালবাহী বিমানে ‘এফ-৩৫বি’র খণ্ডিত টুকরোগুলি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে তারা।
কেরলের তিরুঅনন্তপুরম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ লড়াকু জেটটির মেরামতির অবশ্য কম চেষ্টা করেনি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দফতর। যুদ্ধবিমানটিকে ফের আকাশে ওড়াতে মোট ৪০ জন ইঞ্জিনিয়ারের একটি দলকে ভারতের দক্ষিণের রাজ্যটিতে পাঠান তাঁরা। জেটটিকে টেনে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার দু’টি যন্ত্রও সঙ্গে ছিল তাঁদের। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও যুদ্ধবিমানটির ঠিক কোন অংশের মেরামতির প্রয়োজন, তা বুঝতে পারেননি তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে কতকটা বাধ্য হয়েই ‘এফ-৩৫বি’কে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটিশ প্রশাসন। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেনি প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের সরকার। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কী ভাবে ‘এফ-৩৫বি’কে ভেঙে ফেলা হবে, তা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, লড়াকু জেটটির খণ্ডিত অংশগুলিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আমেরিকার তৈরি ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার থ্রি’-র মতো ভীমদর্শন সামরিক মালবাহী উড়োজাহাজ ব্যবহার করতে পারে ব্রিটিশ বায়ুসেনা।
‘এফ-৩৫বি’কে ভেঙে ফেলার বিষয়ে অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সন্দীপ উন্নিথান। তাঁর কথায়, ‘‘ভারী জিনিসকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সি-১৭ গ্লোবমাস্টারের কোনও বিকল্প নেই। এটা প্রায় ৭৭ টন পর্যন্ত পণ্য নিয়ে আকাশে উড়তে পারে। অর্থাৎ, একসঙ্গে দুটো ‘এফ-৩৫বি’কে তুলে নিতে পারবে গ্লোবমাস্টার। কিন্তু সমস্যা হল লড়াকু জেটটির ডানা, যার প্রসার প্রায় ১১ মিটার।’’
সন্দীপ জানিয়েছেন, ‘এফ-৩৫বি’র আনুমানিক দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪ মিটার। অন্য দিকে, ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’-এর ভিতরের মালবহনকারী জায়গাটি প্রায় ২৬ মিটার লম্বা। ফলে সেখানে অনায়াসেই ভরে ফেলা যাবে পঞ্চম প্রজন্মের ওই লড়াকু জেট। সমস্যা হল, পরিবহণ বিমানটির ভিতরের খোলের প্রস্থ মাত্র চার মিটার। আর তাই তিরুঅনন্তপুরমে দাঁড়িয়ে থাকা যুদ্ধবিমানটির পাখা খুলে না ফেললে সেটিকে ওর ভিতরে ভরে ফেলা অসম্ভব।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, পঞ্চম প্রজন্মের ‘এফ-৩৫বি’র ডানা আলাদা করা মোটেই সহজ কাজ নয়। এটা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। ডানা আলাদা হয়ে গেলে জেটটিকে একটি কম্প্যাক্ট ইউনিটে রূপান্তরিত করতে হবে। তার পর পরিবহনের জন্য ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’-এর খোলে একে পুরে ফেলতে পারবেন ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর অফিসার এবং ইঞ্জিনিয়ারেরা।
মার্কিন সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৈরি ‘এফ-৩৫বি’র ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা যে প্রথম বার ঘটল, এমনটা নয়। ২০১৯ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এলগিন বিমানঘাঁটিতে একটি ‘এফ-৩৫এ’ যুদ্ধবিমানের ডানা খুলতে হয়েছিল। শেষে সামরিক পরিবহণ বিমানে তাকে উটাহের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনাকে যুদ্ধের সময়ে মেরামতি প্রশিক্ষণের মহড়া বলে জানিয়েছিল আমেরিকা।
২০২২ সালের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একটি ‘এফ-৩৫এ’ যুদ্ধবিমানের জরুরি অবতরণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার বিমানবাহিনী। ওই লড়াকু জেটটিরও ডানা খুলে সড়কপথে মালবাহী গাড়িতে করে সামরিক ছাউনিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। পরে মেরামতির জন্য সোলে ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল পাঠায় ‘এফ-৩৫’র নির্মাণকারী সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’। তাঁদের চেষ্টায় ফের ওই জেটে ডানা সংযুক্ত করা হয়। পরে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটিকে আর ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
চলতি বছরের ১৪ জুন আরব সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে একটি মহড়ায় অংশ নেয় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েলস’ বিমানবাহী রণতরী। কেরল উপকূল থেকে প্রায় ১০০ নটিক্যাল মাইল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ যুদ্ধজাহাজটিতেই মোতায়েন ছিল ‘এফ-৩৫বি’। মহড়ার সময় সেটি আকাশে ওড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই জরুরি অবতরণের জন্য সাহায্য চান লড়াকু জেটের পাইলট। সঙ্গে সঙ্গে তিরুঅনন্তপুরমের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার অনুমতি দেওয়া হয় তাঁকে।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ‘এফ-৩৫বি’ লড়াকু জেটের জরুরি অবতরণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ ব্যাপারে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করে ভারতীয় বায়ুসেনা। সেখানে বলা হয়, যুদ্ধবিমানটিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে ‘ইন্টিগ্রেটেড এয়ার কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’। আর তখনই প্রশ্নের মুখে পড়ে এর ‘স্টেল্থ’ ক্ষমতা। যদিও এই ধরনের কসরতের সময় সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয় বলে জানিয়ে দেয় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
‘এফ-৩৫বি’র জরুরি অবতরণ প্রসঙ্গে দক্ষিণী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’ লেখে, সংশ্লিষ্ট জেটটি কেরল উপকূলে পৌঁছে জরুরি ট্রান্সপন্ডার কোড ‘এসকিউইউএডব্লিউকে ৭৭০০’ প্রেরণ করতে শুরু করে। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি বিপদসঙ্কেত। সেটা পেতেই তৎপর হয় তিরুঅনন্তপুরম বিমানবন্দরের শীর্ষকর্তারা। যুদ্ধবিমানটি অবতরণের পর তাকে বে ৪-এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এর নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে আধা সেনা ‘সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স’ বা সিআইএসএফ।
ভারতীয় বিমানবাহিনী সূত্রে খবর, ‘ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি’র বিমানবাহী রণতরী ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েলস’-এর শীর্ষকর্তারা ইতিমধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকা যুদ্ধবিমানটিকে পরিদর্শন করেছেন। লড়াকু জেটটির ঠিক কোথায় ত্রুটি রয়েছে, সেটা তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়। জরুরি অবতরণ করা ইস্তক লড়াকু জেটটিকে ‘হ্যাঙ্গারে’ (যেখানে বিমান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়) নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেয় ব্রিটিশ নৌসেনা। যার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এখনও দেখায়নি তাঁরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, ‘এফ-৩৫বি’কে হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের আপত্তির নেপথ্যে স্পষ্ট যুক্তি রয়েছে। কোনও অবস্থাতেই তাঁরা লড়াকু জেটটির জটিল প্রযুক্তি কাউকে জানতে দিতে চায় না। ফলে খোলা আকাশের নীচে যুদ্ধবিমানটিকে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ইংরেজ যোদ্ধা পাইলট। ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক মুখপাত্র অবশ্য বলেছেন, “আমরা বিমানটি দ্রুত মেরামতের চেষ্টা করছি এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞ।”
মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর তৈরি এই ‘এফ-৩৫বি’ প্রকৃতপক্ষে একটি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। অর্থাৎ, নিখুঁত নিশানায় শত্রুব্যূহে হামলা চালানোর পাশাপাশি নজরদারি বা ‘গুপ্তচরবৃত্তি’র কাজেও একে ব্যবহার করা যেতে পারে। লড়াকু জেটটি ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির হওয়ায় সহজে একে চিহ্নিত করতে পারে না কোনও রেডার। কেরলে জরুরি অবতরণের পর সেই মিথ ভাঙতে পারে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
‘এফ-৩৫বি’-এর আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অত্যন্ত ছোট রানওয়েতে একে ওড়ানো সম্ভব। লড়াকু জেটটি উল্লম্ব ভাবে অবতরণ করতে পারে। সদ্যসমাপ্ত ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে এর বহুল ব্যবহার করেছে ইহুদি বায়ুসেনা। তবে মার্কিন শক্তিজোট তথা ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটো-ভুক্ত (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলিকে এটি প্রচুর পরিমাণে বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। ব্রিটেন নেটো সদস্য হওয়ায় সংশ্লিষ্ট জেটটিকে তাদের বহরে শামিল করতে পেরেছে।
ব্রিটেন ছা়ড়াও নেদারল্যান্ডস এবং ইটালির কাছে রয়েছে এই মার্কিন লড়াকু জেট। যুদ্ধবিমানটির মূল ভার্সানটির নাম ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’। এর মোট তিন ধরনের মডেল রয়েছে। ‘এফ-৩৫বি’ মূলত বিমানবাহী রণতরীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। ভারত নেটোর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে তুলে দিতে ইচ্ছুক আমেরিকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই সময় তাঁর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ‘‘নয়াদিল্লিকে এফ-৩৫ লাইটনিং টু সরবরাহ করতে কোনও সমস্যা নেই ওয়াশিংটনের।’’ এর কিছু দিনের মধ্যেই বেঙ্গালুরুতে ‘অ্যারো ইন্ডিয়া শো ২০২৫’-এর আয়োজন করে ভারতীয় বিমানবাহিনী। সেখানে ‘এফ-৩৫’ যুদ্ধবিমান নিয়ে হাজির ছিল ‘লকহিড মার্টিন’ এবং মার্কিন বায়ুসেনা।
কেরলের বিমানবন্দরে ‘এফ-৩৫বি’ যুদ্ধবিমান ‘বন্দি’ থাকাকে কেন্দ্র করে সমাজমাধ্যমে ট্রোলিংয়ের শিকার হয়েছে ব্রিটিশ নৌসেনা। পঞ্চম প্রজন্মের এই লড়াকু জেটের আনুমানিক দাম ১১ কোটি ডলার বলে জানা গিয়েছে। নেটাগরিকদের কেউ কেউ এ-হেন ‘এফ-৩৫বি’কে অনলাইনে বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছেন। মজা করে লিখেছেন, ৪০ লক্ষ ডলার দিয়েই ‘জড়ভরত’কে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। তবে মূল্য নিয়ে দরদাম করা যেতেই পারে।
ভারতীয় নেটিজেনদের এই ট্রোলিংকে অবশ্য মোটেই ভাল চোখে দেখছে না ব্রিটিশ গণমাধ্যম। পাল্টা নয়াদিল্লিকে ‘শত্রু’ হিসাবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর লড়াকু জেটটি গুপ্তচরবৃত্তিতে যুক্ত ছিল বলেও অভিযোগ করেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ। তবে সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ, যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
‘এফ-৩৫’ শ্রেণির যুদ্ধবিমানগুলি পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম। ভারতে এই লড়াকু জেটের একটি ‘বন্দি’ থাকলেও সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানের উপর থেকে ভরসা হারাচ্ছে না ব্রিটিশ সরকার। আগামী দিনে আমেরিকার থেকে আরও ১২টি ‘এফ-৩৫এ’ কিনবে আটলান্টিকের পারের ওই দ্বীপরাষ্ট্র। গত ২৪ থেকে ২৫ জুন নেদারল্যান্ডসের ‘দ্য হেগ’ শহরে নেটো-র বৈঠক চলাকালীন এই ঘোষণা করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার।