চিনের উত্তর অংশে জলসঙ্কট। দক্ষিণ চিনের নদী ফুলেফেঁপে উঠলেও চিনের উত্তর অংশ জলের তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়েছে। ভৌগোলিক ও অবস্থানগত কারণে পড়শি দেশের এই অঞ্চলে জলসম্পদ সীমিত। জলবণ্টনে ভারসাম্যহীনতার সম্মুখীন হচ্ছে গোটা দেশ।
রাজধানী বেজিং, শিল্পনগরী তিয়ানজিন এবং কৃষিভিত্তিক রাজ্য হেনান ও হেবেইয়ের মতো এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলের স্তর বিপজ্জনক ভাবে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি, শিল্প এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই ঘাটতি মাত্রাছাড়া। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফল ভোগ করছে চিনের উত্তর অংশটি। তুলনায় জলসম্পদে সমৃদ্ধ দক্ষিণ চিন। অদূর ভবিষ্যতে জলের জোগান স্বাভাবিক রাখতে দক্ষিণের একটি নদী থেকে জল বয়ে নিয়ে উত্তরের ঘাটতি মেটাতে চাইছে চিন।
নদীবাঁধ প্রকল্প হোক বা সেতু, যে কোনও ধরনের পরিকাঠামোকে বিশাল আকারে ফেঁদে ফেলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে চিনের রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তেমনই একটি প্রকল্প হল দক্ষিণ-উত্তর জল স্থানান্তর প্রকল্প। দক্ষিণের নদীর জল নিয়ে তা রাজধানী-সহ দেশের উত্তরের ভূখণ্ডে বণ্টন করে দেওয়ার একটি প্রকল্প নিয়েছে শি জিনপিংয়ের দেশ। আক্ষরিক অর্থে এটি গোটা নদী সরিয়ে ফেলার শামিল।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের বসবাস চিনে। বিশ্বের মাত্র ৬ শতাংশ মিঠে জলের জোগান রয়েছে ড্রাগনভূমিতে। বিশ্বব্যাঙ্কের ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, এক জন চিনের নাগরিকের জন্য জলের বরাদ্দ প্রতি বছর মাত্র ২ হাজার ঘনমিটারের সামান্য বেশি। বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় এটি ৭০ শতাংশ কম।
হাজার হাজার বছর ধরে, ইয়াংজ়ি এবং হলুদ নদীর তীরবর্তী সভ্যতাগুলি কিংহাই-তিব্বতি মালভূমির হিমবাহগলা জলের উপর নির্ভরশীল ছিল। বিশ্ব উষ্ণায়ন গত ৫০ বছরে হিমবাহ অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩ থেকে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি করেছে। তার ফলে হিমবাহ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে শুরু করেছে।
২০১৮ সালে গ্রিনপিসের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ১৯৫০ সাল থেকে চিনের ৮২ শতাংশ হিমবাহ শেষ হয়ে গিয়েছে। এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি বরফের আচ্ছাদন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ফলস্বরূপ, ১৯৯০ সাল থেকে কেবল ইয়াংজ়িতে হিমবাহ গলা জলের প্রবাহ ১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মিষ্টি জলের পরিমাণ কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে।
ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা জলবায়ুতেও পরিবর্তন এনেছে। আর্দ্র মৌসুমি বায়ু চিনের উত্তরাঞ্চল এবং অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে পৌঁছোনো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেজিং-সহ উত্তরের শহরগুলিতে অস্বাভাবিক শুষ্ক আবহাওয়া প্রত্যক্ষ করেছেন চিনের বাসিন্দারা। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বৃষ্টিপাত এবং তুষারপাত হয়নি চিনের উত্তর অংশে। ১১৬ দিন খরাও হয়েছে সে দেশে, যা কার্যত নজিরবিহীন।
জলের প্রবাহ দক্ষিণ দিকে বেশি হলেও সমস্ত উন্নয়ন চিনের উত্তর অংশে কেন্দ্রীভূত। বেজিং, তিয়ানজিন ও হুবেই প্রদেশকে একত্রিত করে নিউ ইয়র্ক ট্রাই-স্টেট এরিয়ার আদলে গড়ে তোলা হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিশ্বমানের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে টক্কর দেওয়া। শিল্পনগরীর উন্নয়নের চাপের কারণে জলের অভাব দিন দিন তীব্র হতে থাকে তিন প্রধান শহরে।
১৯৫০ সালে দক্ষিণ-উত্তর জল স্থানান্তর প্রকল্পটির প্রস্তাবনা করা হয়েছিল। এই প্রকল্পটি চিনের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল বলে ধরা হয়ে থাকে। দক্ষিণে ইয়াংজ়ি নদী থেকে ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের ভিতর দিয়ে জল এনে উত্তর চিনের জলের ঘাটতি দূর করাই ছিল লক্ষ্য।
চিনের উত্তর অংশে ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক শোষণের ফলে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চিনের বিশাল ভূখণ্ডে জলের ভারসাম্যকে রক্ষা করার জন্য দক্ষিণের ইয়াংজ়ি নদী থেকে তিনটি ধাপে উত্তরে জল পাঠিয়ে সমস্যা মোকাবিলা করতে চায় চিন। প্রকল্পটির উপর ভর করে বছরে কয়েক কোটি ঘনমিটার জল স্থানান্তর করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
৪ হাজার ৩৪৪ কিলোমিটার উজিয়ে নদীর জলকে টেনে নিয়ে উত্তরের শুষ্ক, ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে তা ছড়িয়ে দেওয়ার নকশা তৈরি করে ফেলেছে চিন। ৭ হাজার কোটি ডলার খরচ করে হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে উত্তরের শহর এবং শিল্প এলাকায় জল পরিবহণ করার প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই চালু করে ফেলেছে বেজিং।
ইয়াংজ়ি নদী এবং জিং-হান গ্র্যান্ড খাল থেকে পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে জল তুলে পীত নদীর (হোয়াংহো নদী) নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে উত্তরে রাজধানী শহর ও তিয়ানজিনের মতো বড় শহরে জল পৌঁছে দেওয়া পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম তিন ধাপে প্রকল্পটি রূপায়ণ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে চিন সরকার। পূর্ব এবং মধ্য ধাপটি শেষ হতে ১০ বছর সময় লেগেছে।
প্রকল্পটি আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ২০০২ সালে। ২০৫০ সাল নাগাদ শেষ ধাপ অর্থাৎ পশ্চিমের রুটের কাজ সমাপ্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পূর্ব রুটের প্রকল্পটি শুরু হয়েছে জিয়াংসু প্রদেশের ইয়াংজ়ি নদী থেকে। গ্র্যান্ড ক্যানাল ব্যবহার করে পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে শানডং প্রদেশ, তিয়ানজিন শহরে জল পৌঁছে দেওয়া হয়।
মধ্য রুটে দানজিয়াংকু জলাধার থেকে জল তুলে পাহাড়, নদী ও জাতীয় সড়ক পার করে জল বয়ে আনা হয়েছে সুপরিকল্পিত টানেলের মধ্যে দিয়ে। বেজিং শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ জলের জোগান এখন এই পথ দিয়েই আসে। এর ফলে হেনান, হুবেই প্রদেশের ও তিয়ানজিন শহরের কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছেন।
পশ্চিম রুটের প্রকল্পটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তিব্বতের পার্বত্য অঞ্চলের ইয়ালুং ও ডাডু নদী থেকে পীত নদী বা হোয়াংহোতে জলের প্রবাহ বৃদ্ধি করা এই প্রকল্পের লক্ষ্য। জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিবেশগত উদ্বেগের কারণে সেটি এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়েছে।
এই প্রকল্পটির ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে উত্তর চিনের বাইয়াংডিয়ান হ্রদ। এই জলাভূমিটিকে ‘চিনের কিডনি’ বলা হয়। জীববৈচিত্রে ভরপুর এই হ্রদে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় জমায় শীতকালে। বিভিন্ন ধরনের গাছপালা, মাছ, জলজ প্রাণীদের বাস হ্রদটিতে। ক্রমাগত জল ব্যবহারের ফলে এই হ্রদটিও শুকিয়ে যাচ্ছিল। সেটির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে দক্ষিণ-উত্তর জল স্থানান্তর প্রকল্পের হাত ধরে।
প্রকল্পটির মাধ্যমে ১৫ কোটি মানুষ উপকৃত হলেও পরিবেশ ও বহু চিনা নাগরিকের বাসস্থানের উপর কোপ পড়েছে। ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষকে প্রকল্পের জন্য উচ্ছেদ করা হয়েছে। চিনের সরকার জাতীয় স্বার্থের জন্য প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদের সঙ্গে ব্যক্তিগত অধিকারকেও গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ। যদিও যে কোনও ধরনের জনবিক্ষোভকে কড়া হাতে রাশ টানার ক্ষমতা রয়েছে চিনা সরকারের।
চিনের এই প্রকল্পটি মূলত অভ্যন্তরীণ জলসঙ্কট মেটাতে তৈরি হলেও এর পশ্চিম রুটটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। মেকং নদী (যা লাওস, তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে প্রবাহিত) ব্রহ্মপুত্র নদী (ভারত ও বাংলাদেশে প্রবাহিত) নু নদী/সালউইন (মায়ানমার ও তাইল্যান্ডে প্রবাহিত) -এর মতো আন্তঃসীমান্ত নদীগুলিকে পশ্চিম রুটে অন্তর্ভুক্ত করেছে চিন। আর তা করেছে কোনও দেশের অনুমতি বা আন্তর্জাতিক জলচুক্তিকে তোয়াক্কা না করেই। এই সব নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মানেই অন্যান্য পড়শি দেশের জলের ভবিষ্যৎ অধিকার নির্ধারণে চিনের একচ্ছত্র আধিপত্য।
চিন এখনও পর্যন্ত কোনও বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক জলসম্পদ চুক্তিতে সই করেনি। ফলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সরকার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য নয়। চিনের এই প্রকল্প চিন্তায় রাখছে ভারতকেও। কারণ এর ফলে পরবর্তী কালে ব্রহ্মপুত্রের জল নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বেজিং।
এর ফলে বিপাকে পড়তে পারে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশ। চিনের বাঁধ ব্রহ্মপুত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে রুখে দিয়ে বর্ষায় উজানের দিকে আরও জল ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা। আবার শুখা মরসুমে জলের অভাবও দেখা যেতে পারে ভারত-বাংলাদেশে। তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন চিনের দক্ষিণ-উত্তর জল স্থানান্তর প্রকল্প শুধু একটি প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক উদ্যোগ নয়, এটি একটি কৌশলগত শক্তি প্রয়োগের নামান্তর।