অদ্ভুত এক বোমা। এ বোমা ফাটলে হবে না কোনও জীবনহানি। কিন্তু, পুরোপুরি বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে শত্রু দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর। সামরিক ছাউনিতে থাকবে না বিদ্যুৎ। যুদ্ধের সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পুরোপুরি পঙ্গু করার এ-হেন হাতিয়ার তৈরি করা গিয়েছে বলে সগর্বে জানাল চিন। ‘চালবাজ’ বেজিঙের ওই ঘোষণায় সবচেয়ে আতঙ্কিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান। পাশাপাশি, রক্তচাপ বেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের।
চিনের নতুন প্রজন্মের এই হাতিয়ারটির নাম ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’ দিয়েছে পশ্চিমি গণমাধ্যম। যদিও বেজিঙের তরফে সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটির নাম প্রকাশ করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ড্রাগনভূমির ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ এটি আদৌ ব্যবহার করছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়। পাশাপাশি, হাতিয়ারটির কোনও ছবি বা ভিডিয়ো চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপঙের সরকার গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে না ধরায় এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
চলতি বছরের ২৬ জুন বেজিঙের সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন’ বা সিসিটিভি-র একটি সমাজমাধ্যম চ্যানেলে প্রকাশিত হয় সংশ্লিষ্ট ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’র একটি অ্যানিমেটেড ভিডিয়ো। এর পরেই গোটা দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। অ্যানিমেটেড ভিডিয়োয় পিএলএ-কে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছে, যার থেকে বেরিয়ে আসছে একাধিক গ্রাফাইট বোমা। এরই নাম ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’ দিয়েছে পশ্চিমি গণমাধ্যম।
সিসিটিভির সমাজমাধ্যম চ্যানেলের ভিডিয়ো অনুযায়ী, একটি গাড়ির উপরে বসানো লঞ্চার থেকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ছোড়ে পিএলএ। এর পর সোজা উড়ে গিয়ে মাঝ-আকাশে ফেটে যায় ওই ক্ষেপণাস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সিলিন্ডার আকারের ৯০টি ছোট ছোট গোলা। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানার মুখে শূন্যে সেগুলিকেও ফেটে যেতে দেখা গিয়েছে। ভিডিয়োর এই দৃশ্যের সঙ্গে ‘ক্লাস্টার বোমা’র বেশ মিল রয়েছে।
বেজিঙের সরকারি গণমাধ্যমটির দাবি, সিলিন্ডার আকারের ছোট গোলাগুলি মাঝ-আকাশে বিস্ফোরণ হলে সেখান থেকে মাটিতে ঝরে পড়বে কার্বন ফিলামেন্ট। এগুলি নীচে নেমে এলে উচ্চ তড়িৎশক্তির পাওয়ার গ্রিডগুলিতে শুরু হয়ে যায় শর্ট সার্কিট। ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিদুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে শত্রু দেশের বিরাট এলাকা। ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’-এর এই অ্যানিমেটেড ভিডিয়ো ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, যুদ্ধের সময়ে মূলত শত্রুর ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই ধরনের বোমা তৈরি করেছে চিন। এর প্রয়োগে ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকা জুড়ে ব্যাপক বিদ্যুৎবিভ্রাট তৈরি করতে পারবে বেজিঙের লালফৌজ। তবে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির ক্ষমতা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেছে ড্রাগনভূমির সরকারি গণমাধ্যম সিসিটিভি। সেখানে একে ‘সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রহস্যময় ক্ষেপণাস্ত্র’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়ো দেখে ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’র পাল্লা ২৯০ কিলোমিটারের মধ্যে হবে বলে অনুমান করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের আরও দাবি, সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটি ৪৯০ কেজি বিস্ফোরক বা ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ সাবস্টেশন এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক পরিকাঠামোকে ধ্বংস করতে এর নকশা তৈরি করেছেন বেজিঙের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
সাবেক সেনা অফিসারদের দাবি, যুদ্ধের সময়ে শত্রুকে পুরোপুরি অন্ধ করে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে এই ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’-এর। এটি ব্যবহার হলে কাজ করা বন্ধ করবে রেডার স্টেশন। তখন অনায়াসেই যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় উড়িয়ে দেওয়ার রাস্তা খুলে যাবে পিএলএ-র সামনে। সেই কারণে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ‘গেমচেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
এখন প্রশ্ন হল, কী ভাবে কাজ করে এই ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’? বিশ্লেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির ওয়ারহেড পুরোপুরি গ্রাফাইটে তৈরি। এই গ্রাফাইট দিয়েই তৈরি হয় পেনসিলের শিষ। কার্বনের এই রূপটি বিদ্যুতের সুপরিবাহী। ফলে যখনই আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো কোনও বিদ্যুৎকেন্দ্র, সাবস্টেশন বা পাওয়ার গ্রিডের উপরে গ্রাফাইট ঝরে পড়বে, তখনই সেখানে শর্ট সার্কিট হতে বাধ্য। আর এক বার সেটা ঘটাতে পারলে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে বিরাট এলাকা।
এ-হেন ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’ কিন্তু চিনের আবিষ্কার নয়। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের একাধিক যুদ্ধে এই ধরনের হাতিয়ার মার্কিন বাহিনীকে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে ১৯৯১ সালের ইরাক যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ওই লড়াইয়ে বাগদাদের বাহিনীকে পঙ্গু করতে ‘টমাহক’ ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা। এতে সেখানকার ৮৫ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে আরব দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকায় বোমাবর্ষণ করতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর কোনও অসুবিধা হয়নি।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরাকের আকাশ দখল করতে ‘টমাহক’ ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রে বিএলইউ-১১৪/বি গ্রাফাইট বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় বিশেষ ধরনের এই ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’ ফেলে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। ওই আঘাতে ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎসংযোগ হারিয়ে ফেলে বেলগ্রেড। যুদ্ধে হার নিশ্চিত বুঝে নেটোর প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হয় পূর্ব ইউরোপের ওই দেশ।
চিনা গণমাধ্যমে ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’-এর অ্যানিমেটেড ভিডিয়ো প্রকাশ পেতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশের দাবি, তাইওয়ান দখলের জন্যই সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি তৈরি করেছে বেজিং। এই ক্ষেপণাস্ত্রে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে পুরোপুরি বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারলে, আগ্রাসী পিএলএ-র বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারবে না তাইপে। সে ক্ষেত্রে একরকম বিনা যুদ্ধে গোটা দেশ চলে যেতে পারে ড্রাগনের কব্জায়।
গত বছর চিনা লালফৌজের তাইওয়ান আক্রমণের সম্ভাব্য নীলনকশা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম। তাদের দাবি, দ্বীপরাষ্ট্রটির উত্তর অংশ দিয়ে আক্রমণ শুরু করা পিএলএ-র পক্ষে বেশি সহজ। বেজিঙের তৈরি ‘ব্ল্যাকআউট বম্ব’-এর পাল্লা কিন্তু বেশি নয়। ফলে আগে সেখানকার বিদ্যুৎ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে ড্রাগন ফৌজ।
তাইওয়ান তথা সাবেক ফরমোসা দ্বীপকে কখনওই পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে মান্যতা দেয়নি চিন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপটিকে বেজিং নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে। ২০২৩ সালে তৃতীয় বারের জন্য ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট হয়ে তাইওয়ানকে নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন জিনপিং। ওই সময়ে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘‘ঐক্যবদ্ধ চিন গড়ে ওঠার পথে কেউ বাধা হতে পারবে না।’’
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটিকে অবশ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে আমেরিকা। গত ২৪-২৫ জুন নেদারল্যান্ডসের ‘দ্য হেগ’ শহরে বৈঠকে বসেন নেটোভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানেরা। সেখানে চিনা আগ্রাসনের ব্যাপারে আলাদা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুট। তাঁর দাবি, যে কোনও ছুতোয় তাইওয়ানকে কব্জা করার সুযোগ খুঁজছে বেজিং। আর সেই লক্ষ্যে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছেন প্রেসিডেন্ট শি।
গত ১৬ জুন বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির আণবিক অস্ত্রের আনুমানিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে সুইডিশ প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ বা সিপ্রি। সেখানে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ১০০টি করে নতুন পরমাণু ‘ওয়ারহেড’ বাহিনীতে শামিল করছে চিন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রক্রিয়া চালু করেছে বেজিং। এর জেরে বর্তমানে ড্রাগনভূমির পিএলএ-র অস্ত্রাগারে আণবিক হাতিয়ারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, পরমাণু ‘ওয়ারহেড’-এর চেয়েও পিএলএ-র আইসিবিএম সাইলো নিয়ে বেশি মাথাব্যথা রয়েছে আমেরিকার। সিপ্রি জানিয়েছে, উত্তর চিনের মরুভূমির মধ্যে তিন জায়গা এবং পূর্বের পাহাড়ি এলাকা জুড়ে একের পর এক সাইলো তৈরি করছে বেজিঙের লালফৌজ। চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে সেই সংখ্যা ৩৫০ ছাপিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের সময় এগুলি থেকে আক্রমণ শানিয়ে ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে ড্রাগন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সাবেক সেনা অফিসারদের একাংশ অবশ্য মনে করেন, পিএলএ-র কাছে ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’ থাকলেও তাইওয়ান দখল পিএলএ-র পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কারণ, সংশ্লিষ্ট দ্বীপরাষ্ট্রে বেজিং আক্রমণ শানালে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে জাপান এবং আমেরিকা। সে ক্ষেত্রে বেজিঙের ওই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করার সক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর। পাশাপাশি, ইলেকট্রনিক যুদ্ধে ‘ব্ল্যাকআউট বোমা’ এঁটে উঠতে পারবে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয়।