শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ছাড়া ডিজিটাল দুনিয়ায় পা রাখা মানে চোরকে আমন্ত্রণ জানানো। সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্ট, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ইমেল অ্যাকাউন্ট কিংবা ফোন বা ল্যাপটপ, যা-ই হোক না কেন, তার জন্য পাসওয়ার্ড দেওয়া আবশ্যক। সাইবার জালিয়াতেরা ওত পেতে বসে আছে ডিজিটাল অ্যাকাউন্টে সিঁদ কাটার জন্য। পাসওয়ার্ড নির্বাচন সঠিক না হলে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে যেতে পারে হ্যাকারদের দখলে।
পাসওয়ার্ড যত কঠিন হবে ততই সুরক্ষিত হবে আপনার ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট। কঠিন পাসওয়ার্ডের বর্ম ভেদ করতে বেগ পেতে হবে সাইবার জালিয়াতদের। ডিজিটাল দুনিয়ার যত অগ্রগতি হয়েছে, তার ফাঁকফোকরগুলিও ততই প্রকট হচ্ছে। শক্তিশালী পাসওয়ার্ডের সুরক্ষাকবচও ভেঙে ফেলছে হ্যাকার বা সাইবার অপরাধীরা। আর সহজ পাসওয়ার্ড তো তাদের কাছে জলভাত।
অফিসের ইমেল চালাচালি থেকে টাকাপয়সার লেনদেন, সবই এখন হয় বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। আর এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিরাপদ রাখতে ভরসা পাসওয়ার্ড। তাই পাসওয়ার্ড হাতাতে পারলে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে যেতে পারে হ্যাকারদের দখলে।
সামান্য ভুলচুকে কারও অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে যাচ্ছে, তো কারও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে পাসওয়ার্ড দিলেই যে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন এমনটাও নয়। তাই পাসওয়ার্ড এমনই দেওয়া উচিত, যা হ্যাক করা কঠিন।
বিশ্বের অধিকাংশ নাগরিকের মধ্যেই পাসওয়ার্ড নিয়ে হেলাফেলা করার প্রবণতা রয়েছে। শুধুমাত্র আলসেমি করে সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার ফলে তাঁদের ডিজিটাল অ্যাকাউন্টগুলি মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন। ২০২৫ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, পাসওয়ার্ডের কারণে গোটা বিশ্বেই সাইবার স্বাস্থ্যের হাল বেজায় করুণ।
বিশ্বব্যাপী পাসওয়ার্ড নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে ‘কমপ্যারিটেক’ নামের একটি সংস্থা। তাদের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পাসওয়ার্ড ব্যবহারের নমুনা। চলতি বছরে তথ্য ফাঁস হয়েছে এমন ২০০ কোটি অ্যাকাউন্টের উপর সমীক্ষা চালিয়ে যে ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে তা চমকে দেওয়ার মতো। বিপুল সংখ্যক রিয়্যাল অ্যাকাউন্ট পাসওয়ার্ড খতিয়ে দেখে সংস্থাটি বহুল ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডের তালিকা প্রকাশ করেছে।
সাধারণত মনে রাখার সুবিধার জন্য অনেকেই সহজ পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে থাকেন। ‘কমপ্যারিটেক’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০টি এমন পাসওয়ার্ড রয়েছে যেগুলি ব্যবহারকারীরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন।
পাসওয়ার্ড সংক্রান্ত গবেষণায় ‘কমপ্যারিটেক’ জানিয়েছে, বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত পাসওয়ার্ড হল ১২৩৪৫৬। অ্যাকাউন্টগুলি পরীক্ষা করতে গিয়ে ১২৩৪৫৬ পাসওয়ার্ডটি তাঁদের কাছে ৭৬ লক্ষ বার ফিরে এসেছে। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে ১২৩৪৫৬৭৮৯, ১২৩৪৫৬৭৮।
তার পরে রয়েছে ‘অ্যাডমিন’ শব্দটি। তার পর রয়েছে মাত্র চারটি অক্ষরের পাসওয়ার্ড ১২৩৪। এ ছাড়া ‘পাসওয়ার্ড’ নামের শব্দটি পাসওয়ার্ড হিসাবে পছন্দ করেছেন বহু ব্যবহারকারী। ‘অ্যাডমিন’ শব্দটিকে পাসওয়ার্ড হিসাবে ব্যবহার করেছেন ১৯ লক্ষেরও বেশি মানুষ।
তালিকায় রয়েছে ‘কোয়ার্টি ১২৩’, ‘কোয়ার্টি ১’, ‘১১১১১১’, ‘সিক্রেট’ এবং ‘১২৩১২৩’। এ ছাড়াও একটি মাত্র সংখ্যা দিয়ে তৈরি ‘১১১১১’ সর্বাধিক ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তালিকার ১০০তম স্থানে রয়েছে ‘মাইনক্রাফ্ট’ শব্দবন্ধটি। ৭০ হাজার জন ব্যবহার করেছেন এটি। ১০০টি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডের তালিকায় ৫৩ নম্বর স্থানে রয়েছে ‘ইন্ডিয়া@১২৩২’।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ২০০ কোটি পাসওয়ার্ডের মধ্যে ৬৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ১২টির কম অক্ষর ছিল। ৬.৯ শতাংশ ব্যবহারকারী ৮টিরও কম অক্ষর দিয়ে তাঁদের পাসওয়ার্ড সাজিয়েছিলেন। মাত্র তিন শতাংশ অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডে ১৬টি অক্ষর ও সংখ্যার সম্মিলিত ব্যবহার খুঁজে পেয়েছে সমীক্ষক সংস্থাটি।
সাধারণত মনে রাখার সুবিধার জন্য অনেকেই নিজের বা প্রিয়জনের নামের অদ্যক্ষর, ফোন নম্বর কিংবা জন্মতারিখ, সাল দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতি সহজে চুরি হয়ে যায় এ ধরনের পাসওয়ার্ড। কারণ পাসওয়ার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই খুব সাধারণ পাসওয়ার্ড দেওয়ার দিকে ঝোঁকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘পাসওয়ার্ড ক্র্যাকিং প্রোগ্রাম’-এর বদান্যতায় সহজ কোনও পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করতে হ্যাকারদের লাগে গড়ে এক সেকেন্ডেরও কম সময়। ব্যতিক্রম ‘ইন্ডিয়া১২৩’। এই পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করতে সময় লাগবে ১৭ মিনিটের মতো। সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, নিজের নাম যেমন দেওয়া যাবে না, তেমনই ব্যবহার করা যাবে না অন্য কোনও সহজবোধ্য নাম।
পাসওয়ার্ড হতে হবে জটিল থেকে জটিলতর। কারণ সরল পাসওয়ার্ডে বেড়ে যায় সাইবার প্রতারণার শিকার হওয়ার আশঙ্কা। শক্তিশালী পাসওয়ার্ডগুলি কমপক্ষে ১২ অক্ষর দীর্ঘ হওয়া উচিত। এগুলি ছোট এবং বড় হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং প্রতীকের সংমিশ্রণে তৈরি করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
হ্যাকার হানা থেকে বাঁচতে প্রতিটি অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড আলাদা করে দিতে হবে। তিন মাস বা ছ’মাস অন্তর পাসওয়ার্ড বদল করা জরুরি। অত্যন্ত দুর্বল পাসওয়ার্ড এবং খুব সাধারণ মানের পাসওয়ার্ড নৈব নৈব চ। একই পাসওয়ার্ড বার বার ব্যবহার করা যাবে না। একাধিক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করার সুবিধা থাকলে গ্রহণ করতে হবে সেই সুবিধা।