মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া শান্তিপ্রস্তাবের প্রাথমিক শর্তে রাজি হয়েছে যুযুধান ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ফলে খুব দ্রুত মুক্তির স্বাদ পেতে পারেন পণবন্দিরা। শুধু তা-ই নয়, এর জেরে গত দু’বছর ধরে চলা যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত জয় এসেছে বলে মনে করছে পশ্চিম এশিয়ার একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র। কিন্তু সত্যিই কি তাই? না কি প্রদীপের নীচে থাকছে অন্ধকার? জনপ্রিয় একটি সংলাপে গোটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন সাবেক সেনাকর্তা থেকে দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ। ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায়’, বলছেন তাঁরা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ মনে করেন, হামাসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি ইজ়রায়েল। প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির কোমর ভাঙা গিয়েছে মাত্র। তেল আভিভের দাবি, গত দু’বছরের যুদ্ধে হামাসের ২৫ থেকে ৩০ হাজার লড়াকুর মধ্যে ১৭ থেকে ২৩ হাজার জনকে খতম করেছে তাদের ফৌজ। পাশাপাশি সশস্ত্র সংগঠনটির একগুচ্ছ শীর্ষনেতাকে নিকেশ করেছে তাঁরা। কিন্তু তার পরেও হামাসের গুপ্ত আড্ডা থেকে পণবন্দিদের ছাড়িয়ে আনতে ব্যর্থ হয় ইহুদি সেনা। এর জেরে সংঘর্ষে তাঁদের জয় নিয়ে সংশয় থাকছেই।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সঙ্গে যুদ্ধে কম চড়াই-উতরাই দেখেনি ইজ়রায়েল। ঝটিতি আক্রমণ শানাতে গিয়ে উল্টে বড় বাধার মুখে পড়েছে ইহুদি ফৌজ। কখনও আবার পাল্লা ভারী হয়েছে হামাসের। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সংঘর্ষের শুরুটা অবশ্য করেছিল ইরান মদতপুষ্ট এই সশস্ত্র সংগঠন। প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে ইহুদিভূমিতে ঢুকে পড়ে তারা। ওই হামলায় প্রাণ হারান প্রায় ১,২০০ জন নিরীহ নাগরিক। এ ছাড়া ২৫০-র বেশি মানুষকে পণবন্দি করে গাজ়ায় নিয়ে যায় হামাস যোদ্ধারা।
প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীটির এই হামলার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। মূলত গাজ়া সীমান্তের ইজ়রায়েলি শহরগুলিকে নিশানা করে তারা। গোটা অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় হামাসের বিশেষ ‘নুখবা’ বাহিনী। নানা দিক থেকে কয়েক হাজার রকেট ছুড়ে ইহুদিদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যতিব্যস্ত করে ফেলে তারা। সেই ধাক্কা সামলে উঠে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রত্যাঘাত শুরু করে ইজ়রায়েলের বিমান এবং স্থলবাহিনী।
হামাসের বিরুদ্ধে শুরু করা সেনা অভিযানের নাম ‘অপারেশন সোর্ড অফ আয়রন’ দেয় তেল আভিভ। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল গাজ়ার যে এলাকাগুলিকে ‘কমান্ড হাব’ হিসাবে হামাস যোদ্ধারা ব্যবহার করছে, বিমান হামলা চালিয়ে সেগুলিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে পরবর্তী তিন মাসে প্যালেস্টাইনের ওই ভূখণ্ডে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে ইহুদি বায়ুসেনা। গত বছরের গোড়ার দিকে সেখানে ‘গ্রাউন্ড অপারেশন’-এ নামে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ।
২০২৪ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি গাজ়া শহর এবং জাবালিয়ায় ঢোকে ইজ়রায়েলি ট্যাঙ্ক বাহিনী। ওই সময় থেকে খুঁজে খুঁজে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে খতম করা শুরু করে তারা। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ইহুদিদের জগদ্বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’। গত বছরের জুলাইয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েকে উড়িয়ে দেয় তেল আভিভ। সেটা ছিল এই সংঘাতে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রথম বড় সাফল্য।
হানিয়ে খতমের কিছু দিনের মধ্যেই হামাস বাহিনীর বিশেষ ‘কাসেম’ ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আল-আরৌরিকে নিকেশ করে আইডিএফ। ইজ়রায়েলের উত্তরের প্রতিবেশী লেবাননের রাজধানী বেইরুটে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। ‘মোসাদ’-এর থেকে সেই গুপ্ত ঠিকানার হদিস মিলতেই সেখানে ড্রোন হামলা চালায় ইহুদি ফৌজ। গত বছরের অক্টোবরে হামাসের আর এক বড় নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে রাফাহ্র একটি সুড়ঙ্গে খতম করে তেল আভিভ। প্যালেস্টাইনপন্থী গোষ্ঠীটির কাছে এটা ছিল অনেক বড় ধাক্কা।
ইজ়রায়েলের দাবি, ৭ অক্টোবরের হামলার মূল চক্রী ছিলেন সিনওয়ার। তাঁর মৃত্যুর পর গাজ়ায় আক্রমণের গতি বাড়ায় আইডিএফ এবং ইহুদি বিমানবাহিনী। চলতি বছরের মে মাসে সেখানকার একটি হাসপাতালে হামলা চালিয়ে ইয়াহিয়ার ভাই মহম্মদ সিনওয়ারকে পরপারে পাঠায় তেল আভিভ। মার্কিন গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই প্যালেস্টাইনভূমির মাটির গভীরে জালের মতো ছ়ড়িয়ে আছে বহু সুড়ঙ্গ। এর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন নিহত মহম্মদ সিনওয়ার।
গাজ়ার এই সুড়ঙ্গগুলিকে হামাসের দুর্গ বলা যেতে পারে। ইহুদিদের বিমান হামলা থেকে বাঁচতে সেখানে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা। এ ছাড়া হাতিয়ার, গোলা-বারুদ এবং পণবন্দিদের লুকিয়ে রাখতেও সংশ্লিষ্ট সুড়ঙ্গগুলিকে ব্যবহার করছে হামাস। এগুলি লম্বায় ৫৬০-৭২০ কিলোমিটার। সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে ৫,৭০০টির বেশি খাদের মতো জায়গা রয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর। সংশ্লিষ্ট সুড়ঙ্গগুলির কত শতাংশ ইজ়রায়েলি সেনা ধ্বংস করতে পেরেছে, তা স্পষ্ট নয়।
হামাসের সুড়ঙ্গ ধ্বংস করতে না পারলেও ইহুদিদের বোমাবর্ষণে গাজ়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ওই প্যালেস্টাইনভূমিতে মৃতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। নিহতদের অর্ধেকই নারী এবং শিশু। গাজ়ার বৃহত্তম আল-শিফা এবং নাসেরের মতো হাসপাতালকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েলি ফৌজ। তাঁদের আক্রমণে যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে তার ওজন পাঁচ কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্য দিকে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধে চুপ করে বসে থাকেনি প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটিও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রণকৌশলে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে হামাস। মার্কিন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা’র দাবি, মুখোমুখি সংঘর্ষের বদলে বর্তমানে গেরিলা যুদ্ধে আইডিএফকে নাস্তানাবুদ করতে চাইছে তারা। এর জন্য দক্ষিণ গাজ়ায় ১০ থেকে ১২ হাজার যোদ্ধার বিশেষ একটি বাহিনীকে মোতায়েন রেখেছে ওই প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী।
হামাসের দ্বিতীয় সাফল্য হল, রাজনৈতিক এবং সামরিক সংগঠনটিতে সদস্য নিয়োগ। এ বছরের জানুয়ারিতে সংবাদসংস্থা ‘রয়টার্স’ জানায়, ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর গত দু’বছরে তাদের দলে এসেছে অন্তত ১৫ হাজার নতুন যুবক। তবে সমস্যার জায়গাটি হল, প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির হাতিয়ার ও গোলা-বারুদের অধিকাংশ ডিপোকেই উড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। গাজ়া উপত্যকার প্রশাসনিক এবং পুরসভার মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে এ বার নিশানা করছে ইহুদি ফৌজ।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন গত দু’বছরের যুদ্ধে আরও একটি জায়গায় ইজ়রায়েলকে পুরোপুরি হারিয়ে দিয়েছে হামাসের মতো সশস্ত্র সংগঠন। সেটা হল, প্রচার কৌশলকে হাতিয়ার করে ইহুদিদের গণহত্যাকারী হিসাবে তুলে ধরা। ফলে ৭ অক্টোবরের হামলার কথা বার বার বলেও আন্তর্জাতিক স্তরে সে ভাবে কোনও দেশের সমর্থন পাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। উল্টে গত সেপ্টেম্বরে প্যালেস্টাইনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো পশ্চিমি দেশ, যা তেল আভিভের রক্তচাপ বাড়িয়েছে।
এ বছরের মে মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজ়াকে নিয়ে বিশেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’। সেখানে বলা হয়েছে, প্যালেস্টাইনের ওই ভূখণ্ডে হামাসবিরোধী অন্য একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে গোপনে মদত দিচ্ছে ইহুদি সরকার। মূলত কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তার পরেও হামাসের জনপ্রিয়তা যে মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেয়েছে, তা কিন্তু নয়।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শায়েল বেন। তাঁর কথায়, ‘‘হামাস কিন্তু শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বা সামরিক সত্তা নয়। স্বাধীন প্যালেস্টাইন তৈরির একটা জাতীয়তাবাদী মনোভাব রয়েছে তাদের। তা ছাড়া ঐতিহাসিক ভাবে আরব দুনিয়ার সমর্থনও সব সময় পেয়ে থাকে তারা। ফলে যুদ্ধে হারলেও নতুন রূপে নতুন ভাবে হামাসের জন্ম হওয়া আশ্চর্যের নয়।’’
শায়েলের এ-হেন মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের প্রধান জেনারেল ইয়াল জামিরের গলায়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে স্থানীয় ‘চ্যানেল ১২’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ ভাবে গাজ়া দখল করলেও হামাসকে শেষ করা মোটেই সহজ নয়। এতে ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। আন্তর্জাতিক স্তরে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে। তাই এই যুদ্ধ আমাদের অন্য ভাবে লড়তে হবে।’’
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, সেই কারণেই ‘সাপের ছুঁচো গেলা’র মতো করে ট্রাম্পের শান্তিপ্রস্তাবে সায় দিয়ে পণবন্দিদের আগে ঘরে ফেরাতে চাইছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে দেশের ভিতরে কোনও বিক্ষোভের মুখে পড়তে হবে না তাঁকে। ফলে কিছু দিন পর নতুন করে সংঘর্ষ শুরু করতে পারবেন তিনি। অন্য দিকে শান্তিপ্রস্তাবের সব শর্ত মানেনি হামাস। শুধু তা-ই নয়, ইজ়রায়েল যুদ্ধ শুরু করলে তার চরম মূল্য তেল আভিভকে দিতে হবে বলে ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে প্যালেস্টাইনপন্থী ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
গত ৮ অক্টোবর পূর্ব জেরুজ়ালেমের আল-আকসা মসজিদে ঢুকে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে প্রার্থনা সারেন ইজ়রায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গাভির। এর পরই যুদ্ধ জয়ের কথা ঘোষণা করেন তিনি। এর জেরে পশ্চিম এশিয়ায় নতুন করে চড়েছে উত্তেজনার পারদ। গাভির এই পদক্ষেপের কড়া নিন্দা করেছে সৌদি আরব ও জর্ডন-সহ আরব দুনিয়ার একাধিক দেশ। ফলে ট্রাম্পের দেওয়া শান্তিপ্রস্তাব কত ক্ষণ ইহুদি রাষ্ট্রটিতে স্থায়ী হয়, সেটাই এখন দেখার।