প্রথমে আয়তনে ছোট এবং দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলিকে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলা। তার পর সেখানকার জমি, বাজার, এমনকি ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নাক গলানো। দীর্ঘ দিন ধরেই এই চেনা ছকে দুনিয়া জুড়ে প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে চিন। এ-হেন ‘ধারের কূটনীতি’ আন্দাজ করে এত দিন সকলকে সাবধান করছিল আমেরিকা। কিন্তু সেই ‘জ্ঞানপাপী’ যুক্তরাষ্ট্রই কি এ বার জড়িয়ে পড়ল ড্রাগনের ঋণের জালে? এই ইস্যুতে সে দেশেরই একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এইডডেটা’ গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি, চিনা অর্থনীতির উপর একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা। সেখানে বলা হয়েছে, আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থাকে ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণ দিয়ে রেখেছে বেজিঙের একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান। ড্রাগনের অর্থানুকূল্যে চলছে ওয়াশিংটনের প্রায় আড়াই হাজার প্রকল্প।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন ‘এইডডেটা’র এক্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর ব্র্যাড পার্কস। এই তথ্যকে আশ্চর্যজনক বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ওয়াশিংটন এক দিকে অন্যদের চিনের থেকে টাকা ধার নিতে বারণ করছে। অথচ নিজে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়ে বসে আছে। এটা তো দ্বিচারিতা। আপনি সার্বভৌমত্বের ঝুঁকির কথা বলে বেজিঙের পুঁজির সঙ্গে সহবাস করতে পারেন না। সেটা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক।’’
‘এইডডেটা’র দাবি, বর্তমানে চিনের সরকারি ঋণের একক বৃহত্তম গ্রহীতা হল যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার ডেটা সেন্টার, বিমানবন্দরের টার্মিনাল, শিল্পের পরিকাঠামো, প্রযুক্তি এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নের মতো কৌশলগত ক্ষেত্রে ঋণের নামে টাকার জোগান দিয়ে যাচ্ছে বেজিং। এর জন্য মার্কিন সংস্থাগুলি ড্রাগনের ক্রেডিট পুল ব্যবহার করছে বলে জানা গিয়েছে।
ভার্জিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় মূলধন ব্যবহার করে চিনা সংস্থাগুলি ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর, অটোমেশন, রোবোটিক্স এবং বৈদ্যুতিন সর়ঞ্জাম প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলিকে অধিগ্রহণ করছে। তাদের এই পদক্ষেপ ড্রাগন সরকারের ‘মেড ইন চায়না’ পরিকল্পনার নীলনকশার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গবেষকদের অনুমান, ২০২০-’২১ আর্থিক বছর থেকে আমেরিকার বাজারে ঋণের পরিমাণ বাড়াতে শুরু করে চিন। কারণ, ওই সময় কোভিড অতিমারির জেরে নুইয়ে পড়ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বেজিং। টাকা ধার দেওয়ার নিরিখে বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মরিটারি ফান্ড) এবং জি-৭-ভুক্ত দেশগুলির উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে যায় ড্রাগন।
‘এইডডেটা’র রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই সময় মান্দারিনভাষীদের থেকে ঋণ নেওয়ার লোভ সামলাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা। বেজিঙের দেওয়া ধারের বেশির ভাগটাই এসেছে কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, বারমুডা এবং ডেলাওয়্যারের বেশ কিছু ‘শেল কোম্পানি’র মাধ্যম, যাদের বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। ফলে আমেরিকার মাথায় মোট কত কোটি ডলারের ঋণ রয়েছে, সেই তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন।
প্রথম দিকে আমেরিকার মাটিতে লজ়িস্টিক হাব বা শিল্পবান্ধব পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য টাকা ধার দিচ্ছিল চিন। কিন্তু পরে সেই নীতি বদল করে বেজিং। সূত্রের খবর, গত তিন-চার বছরে শুধুমাত্র জ্বালানি পরিকাঠামো, মহাকাশ গবেষণা বা সেমিকন্ডাক্টরের মতো প্রযুক্তি ক্ষেত্রগুলিতে ঋণের মাধ্যমে টাকা ঢালতে দেখা গিয়েছে ড্রাগনকে। বিষয়টি নিয়ে কোনও রকমের উচ্চবাচ্য করেনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
চিনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের দ্বিতীয় জায়গাটি হল মার্কিন বন্ড। এর অন্যতম বড় ক্রেতা হল বেজিং। গত বছরের (২০২৪ সালের) মাঝামাঝি পর্যন্ত আমেরিকার ৭৭ হাজার কোটি ডলারের ট্রেজ়ারি সিকিউরিটি হস্তগত করে ফেলে বেজিং। এর বিনিময়েও ওয়াশিংটনকে ঋণ দিয়েছে মান্দারিনভাষীরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জাপানের পর মার্কিন বন্ডের বিনিময়ে আমেরিকাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণপ্রদানকারী দেশ হল ড্রাগন।
গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, মোট বিদেশি ঋণের ১১ শতাংশ চিন থেকে নিয়েছে আমেরিকা, যা মোট জাতীয় ঋণের ২ শতাংশ। মার্কিন বন্ডের বিনিময়ে ২০১১ সালে আমেরিকাকে ১.৩ লক্ষ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল বেজিং। সম্প্রতি অবশ্য সেই প্রবণতা কিছুটা কমেছে। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে মার্কিন বন্ড কেনা কমিয়েছে ড্রাগন সরকার।
চলতি বছরে অবশ্য আমেরিকার জাতীয় ধারের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠে গিয়েছে। ফলে নজিরবিহীন ভাবে এই ইস্যুতে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেছে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দাবি, গত ১০০ বছরে এই প্রথম বার ঋণের নিরিখে ইটালি এবং গ্রিসকে ছাপিয়ে যেতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ, এককথায় খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশিংটনের অর্থনীতি।
আইএমএফের পদস্থ কর্তাদের অনুমান, ২০৩৫ সালের মধ্যে ‘মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ১৪৩.৪ শতাংশে পৌঁছোবে মার্কিন ঋণের অঙ্ক। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) এর সূচক দাঁড়িয়েছিল ১২৩ শতাংশে। সে ক্ষেত্রে ধারের নিরিখে গ্রিস এবং ইটালিকে পিছনে ফেলবে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে বিশ্বের ‘সর্বাধিক শক্তিশালী’ রাষ্ট্র। কারণ এক দশক পর আথেন্স এবং রোমের জাতীয় ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির ১৩০ এবং ১৩৭ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ৩৮ লক্ষ কোটি ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে আমেরিকার জাতীয় ঋণ। বিশ্লেষকেরা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ধারের সূচক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের কথায়, বছরের পর বছর ধরে প্রতিরক্ষা বা মহাকাশ গবেষণার মতো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। ফলে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে বাজেট ঘাটতি।
দ্বিতীয়ত, শেষ কয়েক দশকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ একেবারেই বাড়াতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। উল্টে সংশ্লিষ্ট সময়সীমায় ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে সুদের অঙ্ক। এর জেরে মূল ধারের টাকা দিতেই পারছে না মার্কিন সরকার। কেবলমাত্র সুদ পরিশোধ করে চলেছে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো বর্তমানে রাজস্বের তুলনায় ঋণের সুদবাবদ অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে আমেরিকাকে। এটাই দেশটির জাতীয় ধারকে ৩৮ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে গিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডারের অনুমান, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার বাজেট ঘাটতি ফি বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হারের সাত শতাংশের উপরে থাকবে। এর জেরে আগামী এক দশকে ঋণ পরিশোধ ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বছরে সুদ পরিশোধের অঙ্ক গত তিন বছরে আমেরিকার দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর সূচক পরিবহণ এবং শিক্ষাখাতের ব্যয়বরাদ্দকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার প্রতি বছর এক শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একটি অর্থবর্ষ শেষ হলেই মোট জাতীয় ঋণে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত ৩৮ হাজার কোটি ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর বহু ক্ষেত্রে সরকারি খরচ কাটছাঁট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সে কথা বলা যাবে না।
বিশ্লেষকদের দাবি, জাতীয় ঋণ বৃদ্ধি এবং চিনা ধারের ফাঁদ— জোড়া ফলায় আগামী দিনে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে আমেরিকার অর্থনীতি। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা বা মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত একাধিক জটিল প্রযুক্তি ড্রাগনের হাতে চলে আসার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই বিরল খনিজের ব্যাপারে বেজিঙের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল যুক্তরাষ্ট্র। একই ছবি অর্থনীতিতেও দেখা গেলে ‘সুপার পাওয়ার’-এর তকমা খোয়াতে হতে পারে ওয়াশিংটনকে। সেই জায়গায় উঠে আসবে ড্রাগন।
ঋণের জাল ছড়িয়ে দিতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে ‘গরিব’ দেশগুলিকে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়েছিল চিন। এতে বেশ সাফল্য পায় বেজিং। এর মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার একাধিক রাষ্ট্রকে পুরোপুরি কব্জা করে ফেলতে পেরেছে ড্রাগন। পরে উচ্চ আয়ের দেশগুলিকে নিশানা করে তারা। যদিও আমেরিকাকে বিপদে ফেলা তাঁদের পক্ষে বেশ কঠিন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্প জমানায় গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক বার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সংঘাতে জড়াতে দেখা গিয়েছে বেজিংকে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি জটিল হলে ফের নতুন করে ট্রেজ়ারি বন্ড বাজারে ছাড়তে পারে আমেরিকা। তখন ড্রাগনের হাতে থাকা পুরনো বন্ডের দাম হু-হু করে কমবে। তা ছাড়া আর্থিক ঘাটতি মেটাতে ডলার ছাপানোর নির্দেশও দিতে পারেন বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
চিনকে পর্যুদস্ত করতে ইতিমধ্যেই বিরল খনিজ়ের বিকল্প সন্ধানে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে আমেরিকা। অন্য দিকে রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলির জন্য একটি সাধারণ মুদ্রা চালু করার রাস্তায় হাঁটতে পারে বেজিং। তবে সেখানে ভারতের একাধিক শর্ত মানতে হবে তাদের। অর্থনীতির মগজাস্ত্রের খেলায় শেষ পর্যন্ত কার চালে কে মাত হয়, সেটাই এখন দেখার।