ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর নামে রাশিয়ার হয়ে ব্যাটিং? পূর্ব ইউরোপে দেশ বিভাজন করতে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? কিভকে পাঠানো তাঁর ২৮ দফা শান্তি প্রস্তাবের খবর গণমাধ্যমে ফাঁস হতেই খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অন্দরে উঠেছে এই প্রশ্ন। যদিও যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ট্রাম্পপন্থী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। অন্য দিকে এই পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মুখের হাসি যে চওড়া হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে কিভ সফর করেন মার্কিন স্থলবাহিনীর সচিব (আর্মি সেক্রেটারি) ড্যান ড্রিসকল। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে ট্রাম্পের তৈরি করা ২৮ দফা শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয় তাঁর। সূত্রের খবর, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সন্ধির শর্ত মানতে রাজি হননি পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ফলে এই ইস্যুতে ফের এক বার জ়েলেনস্কিকে খোঁচা দিয়েছেন ট্রাম্প।
কী রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের তৈরি করা ২৮ দফা শান্তি সমঝোতায়? সরকারি ভাবে এই নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেনি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউক্রেন। কিন্তু, জ়েলেনস্কি-ড্রিসকল বৈঠক শেষ হতেই রহস্যজনক ভাবে গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় ওই নথি। ট্রাম্প নির্মিত সন্ধির শর্তগুলি নিয়ে সর্বপ্রথম বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘পিবিএস নিউজ় আওয়ার’। এর পরই ইউরোপ এবং আমেরিকায় তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। তার নিরসনে ওভাল অফিসে বসে বিবৃতি দেন স্বয়ং ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস)।
‘পিবিএস নিউজ় আওয়ার’ জানিয়েছে, ট্রাম্পের তৈরি করা শান্তি সমঝোতায় রুশ অধিকৃত এলাকা ফিরে পাওয়ার আশা ইউক্রেনকে ছাড়তে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, ফৌজের আকার ছোট করতে হবে কিভকে। এ ছাড়া মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’ বা নেটোর কোনও সৈনিক দেশের মাটিতে রাখতে পারবেন না জ়েলেনস্কি। যুদ্ধ বন্ধ করতে এত দিন এই শর্তগুলির উপরেই জোর দিচ্ছিল রাশিয়া।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট অবশ্য ইউক্রেনের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে নারাজ। তাই শান্তি সমঝোতায় কিভের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সন্ধির শর্ত মানলে সর্বোচ্চ ছ’লাখ সেনার ফৌজ রাখতে পারবে পূর্ব ইউরোপের ওই দেশ, যারা কখনওই রাশিয়ার উপর আক্রমণ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে জ়েলেনস্কিকে।
শর্ত মেনে সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পাবে ইউক্রেন। নেটোর বিমানবাহিনী মোতায়েন থাকবে দেশটির প্রতিবেশী পোল্যান্ডে। তবে সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটটিতে কখনওই যোগ দিতে পারবে না কিভ। ইউক্রেনকে অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যপদ দেওয়ার কথা বলেছেন ট্রাম্প। যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব ইউরোপের দেশটির পরিকাঠামোগত উন্নয়নে একটি তহবিল তৈরির প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে ইউক্রেনকে দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ক্রিমিয়া, ডোনেৎস এবং লুহানস্ককে রুশ ভূখণ্ড হিসাবে মেনে নিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি ২০১৪ সালের সামরিক অভিযানে কব্জা করে নেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। অন্য দিকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলা লড়াইয়ে মস্কোর ফৌজের হাতে ডোনেৎস এবং লুহানস্ক হারায় কিভ। গত সাড়ে তিন বছরে তা আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি জ়েলেনস্কির বাহিনী।
এ ছাড়া চলমান যুদ্ধে খেরসন এবং জ়াপোরিজিয়ার সিংহভাগের দখল নিয়েছে রাশিয়া। ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবে সেখান থেকেও ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পিছনে সরতে বলা হয়েছে। ওই দুই এলাকায় তৈরি করা হবে একটি নিয়ন্ত্রণরেখা। অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলি একরকম পেয়ে যাবে মস্কোই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অবশ্য দাবি, সংশ্লিষ্ট সন্ধির শর্তগুলিতে সায় রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের। তাই বিষয়টি মানতে জ়েলেনস্কি বাধ্য।
ইউক্রেনের পূর্ব দিকের এই পাঁচটি এলাকা বাদ দিলে (ক্রিমিয়া, ডোনেৎস, লুহানস্ক, খেরসন ও জ়াপোরিজ়িয়া) আরও কিছু জমি বর্তমানে রয়েছে পুতিন বাহিনীর কব্জায়। শান্তি সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী, সেগুলি অবশ্য ফেরত পেতে পারে কিভ। তবে সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে দর কষাকষির সুযোগ পাবে মস্কো। এই সন্ধি মেনে নিলে কৃষ্ণ সাগরের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব পাবে রাশিয়া। অন্য দিকে আগামী দিনে সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার সুযোগ হারাতে পারে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’।
গত ২১ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট শান্তি সমঝোতাটি নিয়ে নিজের দফতরেই (পড়ুন ওভাল অফিস) গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি হন ট্রাম্প। সেখানে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো জ়েলেনস্কির হাতে কোনও তাস নেই। ফলে এই প্রস্তাব তাঁকে মানতেই হবে।’’ এর পরই লড়াইয়ের ভয়াবহতার কথা বলতে শোনা গিয়েছে ‘পোটাস’কে। যে কোনও মূল্যে লড়াই থামাতে চান বলে বিবৃতি দিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প আরও বলেন, ‘‘শীত আসতে চলেছে। তার মধ্যেই জ্বালানি উৎপাদনকারী কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করছে যুযুধান দুই পক্ষ। গত এক মাসে ২৫ হাজার সৈনিক নিহত হয়েছেন। এটা লজ্জার। এই পরিস্থিতি চলতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কখনও এত ধ্বংস দেখেনি বিশ্ব। প্রতি সপ্তাহে সাত-আট হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কোনও যুক্তিতেই লড়াই চলতে দেওয়া যেতে পারে না।’’ শান্তি সমঝোতা মেনে না নিলে জ়েলেনস্কিকে হাতিয়ার ও গোলা-বারুদের সরবরাহ বন্ধ করার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন জ়েলেনস্কি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে ইউক্রেন। হয় আমাদের আত্মসম্মান ও স্বাধীনতা হারাতে হবে, নয়তো মার্কিন বন্ধুত্ব। আমরা অবশ্যই আত্মসম্মানকে বেছে নেবো। প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথেই লুকিয়ে আছে আমার যাবতীয় উত্তর। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, এখনও সেটা করব না।’’
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করেন পুতিন। পৌনে চার বছরের মুখে দাঁড়িয়ে তা এখনও শেষ হয়নি। আর তাই ২৮ দফা শান্তি প্রস্তাবে ওই যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছেন ট্রাম্প। পূর্ব ইউরোপে লড়াই থামলে মস্কোর উপর থেকে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি। সংঘাতের গোড়াতেই সেগুলি ক্রেমলিনের উপর চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ গোটা পশ্চিমি দুনিয়া।
বর্তমানে মস্কোর উপরে রয়েছে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা। সে সব পুরোপুরি ভাবে সরিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রাস্তা খুলতে চাইছেন ট্রাম্প। অন্য দিকে চুপ করে বসে নেই জ়েলেনস্কিও। ক্রেমলিনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ক্রমাগত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন তিনি। কিভের পতন হলে পুতিন তাঁদেরও নিশানা করতে পারেন বলে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।
সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরেঁর সঙ্গে দেখা করেন জ়েলেনস্কি। তার কাছে শতাধিক রাফাল লড়াকু জেট চেয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট। এর আগে কিভের সঙ্গে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির এফ-৩৫ লাইটনিং টু-র প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহী ছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু, তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় যুদ্ধরত পূর্ব ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’, যা নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
গত ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে মুখ খোলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি জানিয়েছেন, সন্ধির শর্তগুলি নিয়ে মস্কোর সঙ্গে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করেছে ওয়াশিংটন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওই প্রস্তাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তির সবটা ক্রেমলিন মানছে কি না, তা নিয়ে অবশ্য কিছু জানাননি পুতিন।
অন্য দিকে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর উচ্চকক্ষ সেনেটের এক সদস্য বলেছেন, ‘‘প্রস্তাবিত শান্তিপ্রস্তাবে রাশিয়ার গোপন ইচ্ছাগুলি তুলে ধরা হয়েছে। আগামী দিনে নেটোয় আমাদের কতটা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে?’’ যদিও তাঁর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রক। সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবের জন্য মস্কোর সঙ্গে কোনও কথা বলা হয়নি বলে স্পষ্ট করেছে তারা।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ট্রাম্পের তৈরি করা শান্তিপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জ়েলেনস্কি যে ভাবে পরবর্তী আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাতে লড়াই থামার আশা ক্ষীণ। কারণ সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের ভয়ে কিভকে বেলাগাম হাতিয়ার সরবরাহ করতে পারে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।