রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে মার্কিন-চিন শুল্ক সংঘাত। কিংবা পশ্চিম এশিয়ায় প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইজ়রায়েলের লড়াই। গত কয়েক বছরে একের পর এক ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে অস্থিরতা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বার বার উঠছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ইতিমধ্যেই তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বিশ্বের তাবড় শক্তিশালী দেশ।
সাবেক সেনাকর্তা হোক বা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, অনেকেরই ধারণা, জমিতে নয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হবে সমুদ্রে। এর জন্য মোট আটটি ‘চোক পয়েন্ট’-এর কথা বলেছেন তাঁরা। এই জায়গাগুলি এক বা একাধিক দেশের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। আর এই বিবাদকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হওয়ার আশঙ্কা সর্বাধিক।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই ‘চোক পয়েন্ট’? এটি মূলত সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ চলাচলের প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি সরু রাস্তা। উদাহরণ হিসাবে মলাক্কা প্রণালী বা হরমুজ় প্রণালীর কথা বলা যেতে পারে। আবার সুয়েজ় বা পানামা খালকেও বিশ্লেষকেরা ‘চোক পয়েন্ট’ বলেন। দুই সমুদ্রকে যুক্ত করার কাজ করে থাকে এই দুই খাল।
বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ বাণিজ্যই হয় সমুদ্রপথে। ফলে ‘চোক পয়েন্ট’ দিয়ে অহরহ জাহাজ চলাচল করে থাকে। তবে সেখান দিয়ে পণ্যবাহী জলযান নিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। কিছু কিছু জায়গায় ‘চোক পয়েন্ট’গুলি বেশ বিপজ্জনক। কিন্তু খরচ ও সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে এই রাস্তা ব্যবহার করে থাকে বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশ।
উদাহরণ হিসাবে পানামা খালের কথা বলা যেতে পারে। মানুষের তৈরি এই সামুদ্রিক রাস্তা প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। এর ফলে দুই মহাসাগরের মধ্যে দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে ৮,৩০০ কিলোমিটার। পানামা খাল না থাকলে বা বন্ধ হলে, প্রশান্ত থেকে আটলান্টিকে যেতে পণ্যবাহী জাহাজকে পুরো দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে পাড়ি দিতে হবে ২০ হাজার ৯০০ কিলোমিটার রাস্তা। এতে যেমন এক দিকে বাড়বে খরচ, অন্য দিকে তেমন সময়ও লাগবে বেশি।
সাবেক নৌসেনা অফিসারদের একাংশের দাবি, সমুদ্রের এই সমস্ত ‘চোক পয়েন্ট’ আটকে গেলে একসঙ্গে অনেকগুলি রাষ্ট্রের অর্থনীতি রাতারাতি ধ্বংস হতে পারে। এরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম দু’টি বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ টেনে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এতে এক দিকে ছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মিত্রপক্ষ। অপর দিকে থাকা জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং অটোমান তুরস্কের অক্ষশক্তিকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে ফেলে তারা। লড়াই থামার পর ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তিতে সই করতে জার্মানিকে বাধ্য করা হয়। সেখানে লড়াইয়ের যাবতীয় দোষ বার্লিনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয় বিজয়ী ব্রিটেন ও ফ্রান্স।
ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী, ১৯২১ সালের মধ্যে যুদ্ধের জন্য জার্মানিকে ৩,৩০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। বর্তমান হিসাবে এই অঙ্ক ৪২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। পাশাপাশি, মধ্য ইউরোপের দেশটির উত্তর দিকে সামুদ্রিক রাস্তার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে যায় মিত্রপক্ষের হাতে। এই জোড়া ধাক্কায় আর্থিক ভাবে একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়ে বার্লিন। মারাত্মক ভাবে মার খায় উৎপাদন, বাড়তে থাকে বেকারত্ব।
ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, এই আর্থিক ধাক্কার জেরে উগ্র জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে পরবর্তী বছরগুলিতে জার্মানিতে রকেটের গতিতে উত্থান হয় অ্যাডলফ হিটলারের। ১৯৩৩ সালের মধ্যে ক্ষমতা দখল করে তাঁর দল ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ বা নাৎসি পার্টি। ফলে চ্যান্সেলরের কুর্সিতে বসেন ‘ফ্যুয়েরার’ হিটলার। এর পর বার্লিন ইউরোপের একের পর এক দেশ দখল করতে থাকলে ছ’বছরের মাথায় বেঁধে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫)।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ২১ শতকেও একই রকমের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। সামুদ্রিক রাস্তা আটকে এক দেশ অপরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে প্রথমেই হরমুজ় প্রণালীর কথা বলা যেতে পারে। এই ‘চোক পয়েন্ট’কে কেন্দ্র করে ২০২০ সালে বড় আকারের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আটকানো সম্ভব হয়েছিল।
২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় প্রাণ হারান ইরানের পদস্থ সেনা অফিসার কাসেম সুলেমানি। প্রতিশোধ নিতে কয়েক দিনের মধ্যেই ইরাকের আল আসাদ মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুকটির মধ্যে বড় আকারের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন ওই সময়ে তেহরান ও ওয়াশিংটন সরাসরি লড়াইতে গেলে নিরপেক্ষ থাকত না রাশিয়া ও চিন। মহাশক্তিধর এই দুই দেশের সঙ্গে শিয়া মুলুকটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। অন্য দিকে ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ানের পূর্ণ সমর্থন থাকত আমেরিকার দিকে। ফলে বাড়ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা। আর এ সব কিছুর জন্য হরমুজ় প্রণালীকে দায়ী করে থাকেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
অবস্থানগত দিক থেকে হরমুজ় প্রণালীর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া ‘চোক পয়েন্ট’টি রয়েছে পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরের ঠিক মাঝখানে। শুধু তা-ই নয়, এই দুই উপসাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে হরমুজ় প্রণালী। এই সামুদ্রিক রাস্তা দিয়ে দৈনিক ৩৩০ কোটি লিটার অপরিশোধিত তেল পরিবহণ করে থাকে পণ্যবাহী জাহাজ। আর তাই ‘চোক পয়েন্ট’টির উপর সব সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ চায় আমেরিকা। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদের সূত্রপাত এখানেই।
একই কথা মলাক্কা প্রণালীর ক্ষেত্রেও সত্যি। চিনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ ওই সামুদ্রিক রাস্তার উপর নির্ভরশীল। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে এটিকে কব্জা করার ফন্দিফিকির খুঁজে চলেছে ড্রাগন সরকার। অন্য দিকে মলাক্কা প্রণালী বেজিঙের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ঢোকা বন্ধ হবে মার্কিন পণ্যবাহী জাহাজের। ফলে জায়গাটির উপর প্রভুত্বকে কেন্দ্র করে সংঘাত তীব্র হচ্ছে।
গত শতকের গোড়ায় প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগরক্ষাকারী পানামা খাল খনন করে আমেরিকা। প্রথম দিকে এর নিয়ন্ত্রণ ছিল ওয়াশিংটনের হাতে। পরে ১৯৯৯ সালে মধ্য আমেরিকার দেশ পানামার হাতে খালটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৭ সালে ডেমোক্র্যাট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে সই হওয়া চুক্তির ভিত্তিতেই ওই পদক্ষেপ করা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে পানামা খাল পরিচালনার ক্ষেত্রে চিনের ‘প্রভাব’ বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছেন। অন্য দিকে খাল ছাড়তে নারাজ পানামা সরকার। ফলে এ ব্যাপারে ‘সামরিক বিকল্প’ পর্যালোচনা করার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্পের দফতর।
লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগকারী বাব এল-মান্দেব প্রণালীকেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের হটস্পট বলে মনে করা হয়। অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই জায়গাটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লোহিত সাগরকে আবার ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে সুয়েজ খাল। আর তাই এই সামুদ্রিক রাস্তার উপর সর্ব ক্ষণের নিয়ন্ত্রণ চায় বিশ্বের তাবড় শক্তিধর দেশগুলি।
তবে শুধুমাত্র ‘চোক পয়েন্ট’-এর জন্য বড় আকারের যুদ্ধ বাধার তত্ত্ব মানতে রাজি নন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস নেভাল ওয়ার কলেজ’-এর অধ্যাপক মিলান ভিগো। তিনি বলেছেন, আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি এতটাই উন্নত যে খোলা সমুদ্র থেকেও সরু সামুদ্রিক রাস্তায় হামলা চালানো সম্ভব। তবে সমুদ্রের উপর নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি যে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইতে নামবে না, তা জোর দিয়ে বলতে পারেননি তিনি।