এ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরী! তুমুল যুদ্ধের মধ্যে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আতঙ্ক ধরাচ্ছে অনাহার। বুলেট থেকে কোনও ক্রমে রেহাই পেলেও নিস্তার নেই। খাবার আর জলের অভাবে বেঘোরে প্রাণ যাচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদের। নিত্য দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সেই সংখ্যা। ফলে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র পালাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। এ হেন পরিস্থিতিতে দেবদূতের মতো আবির্ভাব হয়েছে এক বিদ্রোহী নেতার। ‘রবিনহুড’ ইমেজ় তাঁর। সত্যিই কি তাই, না কি পুরোটাই ‘মায়ার খেলা’? ভূমধ্যসাগরের তীরের একফালি জমির আকাশে-বাতাসে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এই প্রশ্ন।
গত দেড় বছর ধরে চলা ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধে প্যালেস্তাইনের গাজ়াকে ‘নরক কুণ্ড’ বানিয়ে ফেলেছে ইহুদি ফৌজ। তাদের অবরোধের জেরে মানবিক সাহায্যও প্রায় পাচ্ছেন না সেখানকার বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর ‘পরিত্রাতা’ হিসাবে রঙ্গমঞ্চে দেখা মিলেছে ইয়াসের আবু শাবাব নামের এক ব্যক্তির। নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে অনাহার থেকে রক্ষা করার মতো একাধিক প্রতিশ্রুতি দিতে শোনা গিয়েছে দক্ষিণ গাজ়ার রাফার এই ভূমিপুত্রকে।
গাজ়ার অপরাধ জগতের অন্যতম বড় নাম হল আবু শাবাব। মাদক পাচার থেকে শুরু করে আইসিস বা দায়েশের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই ভূখণ্ডে পৃথক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। পাশাপাশি, গাজ়ায় ক্ষমতাসীন প্যালেস্তাইনপন্থী বিদ্রোহী সংগঠন হামাসের চরম বিরোধিতা করছেন এই আবু শাবাব। ফলে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে দানা বেঁধেছে সন্দেহ।
সম্প্রতি গাজ়াবাসীকে হামাসের ‘নাগপাশ’ থেকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি ভিডিয়োবার্তা দেন আবু শাবাব। উদীয়মান বিদ্রোহী নেতাটির দাবি, পূর্ব রাফার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাঁর দল ‘অল-কুওয়াত এল-শাবেয়া’র হাতে। এই কথার অর্থ হল ‘জনপ্রিয় বাহিনী’। ওই ভিডিয়োবার্তায় বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের ফিরে আসার আহ্বান জানান শাবাব। পাশাপাশি, ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফের নজরদারিতে তৈরি অস্থায়ী শিবিরে খাদ্য, নিরাপদ আশ্রয় এবং সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
আবুর দেওয়া ভিডিয়োয় তাঁর সহযোদ্ধাদের প্যালেস্তাইনের পতাকা হাতে রাফায় তাঁবু তৈরি করতে দেখা গিয়েছে। তাঁদের গায়ে ছিল জলপাই রঙের ফৌজি উর্দি। তাতে সাঁটা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ব্যাজ। তাঁবু তৈরির পাশাপাশি ট্রাক থেকে আটা নামিয়ে তা বিতরণও করেন তাঁরা। তবে গোটাটাই হয়েছে আইডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। ভিডিয়োবার্তায় এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শাবাব বলেন, ‘‘ইজ়রায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আমাদের উপস্থিতি ইচ্ছাকৃত নয়। বাস্তুচ্যুতদের ঘরে ফেরানোর প্রয়োজনেই এটা করতে হচ্ছে।’’
গাজ়ায় হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা এই ‘জনপ্রিয় বাহিনী’র সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য রয়েছে। আবু জানিয়েছেন, সরকারি ক্ষমতায় থাকায় হামাসের ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে চান তাঁরা। প্যালেস্তিনীয় ভূখণ্ডটিতে ত্রাণ নিয়ে ঢুকলেই চলছে ব্যাপক লুটতরাজ। এর থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের রক্ষা করার ‘শপথ নিয়েছে’ শাবাবের ‘অল-কুওয়াত এল-শাবেয়া’ সশস্ত্র গোষ্ঠী।
প্যালেস্তাইনের অপর ভূখণ্ড তথা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রাজধানী রামাল্লায় রয়েছে আর একটি সরকার। এর পোশাকি নাম ‘প্যালেস্তাইন অথরিটি’ বা পিএ। গাজ়ার উদীয়মান নেতা আবুর দাবি, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ওই সরকারের অধীনে কাজ করছেন তিনি। তাদের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তাঁর। যদিও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে পিএর কর্তাব্যক্তিরা।
শাবাবের ‘জনপ্রিয় বাহিনী’ জানিয়েছে, গাজ়ার এমন অনেক জায়গায় তাঁদের পা পড়েছে যেখানে সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ওই এলাকাগুলিতে মানবতার স্বার্থে নিরন্ন আমজনতার পাশে দাঁড়িয়ে সেবামূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। অন্য দিকে হামাসের অভিযোগ, তাঁদের সংগঠনে চিড় ধরাতে চক্রান্ত করে এই গোষ্ঠীটির জন্ম দিয়েছে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’। যদিও গাজ়াবাসীর একাংশ এই যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছে বলে একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।
স্থানীয় কুদস নিউজ় ও হারেৎজ় এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলির আবার দাবি, সম্পূর্ণ ভাবে ইজ়রায়েলি সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে থেকে কাজ করছে আবু শাবাবের দল। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি, বেশ কয়েক বার লুটপাটে অংশ নিয়েছে নতুন গজিয়ে ওঠা এই ‘জনপ্রিয় বাহিনী’। গাজ়ায় ঢোকা ট্রাকচালকদের থেকে তোলা আদায়ের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই তারা। আর সবটাই হচ্ছে আইডিএফের চোখের সামনে।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ। তাঁদের কথায়, ‘‘ইজ়রায়েলি ট্যাঙ্কের থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রীর গাড়িতে গুলি চালিয়ে তা লুট করছে তথাকথিত ‘জনপ্রিয় বাহিনী’। হামাসপন্থী কয়েক জন এটাকে আটকাতে গিয়েছিলেন। পরে বিমানহানা চালিয়ে তাঁদের ভবলীলা সাঙ্গ করে ইহুদি বায়ুসেনা।’’
আবু শাবাবের উত্থান আটকাতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হামাস যে কোনও চেষ্টা করছে না, তা কিন্তু নয়। রয়টার্স জানিয়েছে, ত্রাণসামগ্রী লুট করার অভিযোগে সম্প্রতি চার জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এই প্যালেস্তাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী। অভিযুক্তেরা কেরেম শালোম এবং সালাহ আল-দিন স্ট্রিটের কাছে ত্রাণের গাড়ি আটকে ওই অপরাধ সংগঠিত করে বলে জানিয়েছে তাঁরা। তবে হামাসের আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তেরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
পশ্চিম এশিয়ার বিশ্লেষকদের দাবি, আবু শাবাবের উত্থানে প্যালেস্টাইনপন্থীদের মধ্যে যে একটা বিভাজন তৈরি হল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ‘রবিনহুড’ ইমেজ়ের জন্য দক্ষিণ গাজ়ায় ক্রমশ বাড়ছে তাঁর জনপ্রিয়তা। ফলে ‘ক্ষমতার লোভ’ দেখিয়ে তাঁকে হামাসের বিরুদ্ধে ‘ছায়াযুদ্ধে’ নামাতে পারে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে গাজ়ার শাসকদের অচিরেই ক্ষমতাচ্যুত করার স্বপ্ন দেখছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
তবে এর উল্টো মতও রয়েছে। কারণ, সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের জন্মের নেপথ্যে রয়েছে শিয়া মুলুক ইরানের হাত। গাজ়ায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে ক্রমাগত তাঁদের হাতিয়ার এবং অর্থ জুগিয়ে যাচ্ছে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটি। তা ছাড়া চরম ইহুদি বিদ্বেষকে পুঁজি করে সেখানে ক্ষমতার শীর্ষে গিয়েছে হামাস। স্বাধীন প্যালেস্তাইনের স্বপ্ন দেখা গাজ়াবাসীর চূড়ান্ত সমর্থন রয়েছে তাদের দিকে। ফলে হামাসের সামনে শাবাব এবং তাঁর দল কত ক্ষণ টিকবে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের একাংশের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ইরান মদতপুষ্ট হামাস ইতিমধ্যেই শাবাবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘বিপজ্জনক’ বলে প্রচার শুরু করে দিয়েছে। তাঁর ‘জনপ্রিয় বাহিনী’কে ইরাকে আমেরিকার তৈরি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে অনেকে তুলনা করেছেন। ২১ শতকের গোড়ায় কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘আল-কায়দা’কে শেষ করতে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্ট এজেন্সি’ বা সিআইএ-র হাত ধরে জন্ম হয় তাঁদের। কিন্তু বাগদাদ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী প্রত্যাহার করতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল ওই বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
বিশ্লেষকদের দাবি, এর আগে লেবাননে একই রকমের পদক্ষেপ করেছিল ইজ়রায়েলি গুপ্তচর বাহিনী। উত্তরের প্রতিবেশী দেশটিতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তোলে ‘মোসাদ’। ইরান মদতপুষ্ট হিজ়বুল্লার সঙ্গে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল তাঁরা। কিন্তু, ২০০০ সালে বেইরুট থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে আইডিএফ। তার পর ওই সংগঠনটিও রাতারাতি কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল।
অন্য দিকে, গাজ়া ভূখণ্ডে অবিলম্বে সংঘর্ষবিরতির জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে বিশেষ ক্ষমতা ‘ভিটো’ প্রয়োগ করেছে এর স্থায়ী সদস্য আমেরিকা। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই ‘ভিটো’ প্রয়োগ করে। বাকি দেশগুলি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
নিরাপত্তা পরিষদের ওই প্রস্তাবে গাজ়ায় দ্রুত এবং স্থায়ী সংঘর্ষবিরতির কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার বক্তব্য, ওই প্রস্তাবটিতে যুদ্ধবিরতির দাবির সঙ্গে বন্দিমুক্তির প্রসঙ্গকে যুক্ত করা হয়নি। সংবাদ সংস্থা এপি অনুসারে, সেই কারণে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে প্রাপ্ত বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রস্তাবটি খারিজ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন।
ইজ়রায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ থামাতে বেশ কয়েক বার মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সেটা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে গাজ়ায় সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাবে আমেরিকার ‘ভিটো’ প্রয়োগ করা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আমেরিকার ‘ভিটো’ প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলি। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ইজ়রায়েলকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা বলে অভিযোগ তুলেছে তারা। রাষ্ট্রপুঞ্জের চিনা রাষ্ট্রদূত ফুং কংয়ের দাবি, আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সীমা অতিক্রম করেছে পশ্চিম এশিয়ার ওই ইহুদিভূমি। তবুও একটি দেশ তাদের আড়াল করে যাচ্ছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।