বিবাহ— হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকেন এই পবিত্র বন্ধন সাত জন্মের। মনে করা হয়, অগ্নিসাক্ষী করে যে গাঁটছড়া বাঁধা হয়, সে বাঁধন জন্ম-জন্মান্তরের। প্রচলিত বিশ্বাস, মৃত্যুতে সমাপ্তি ঘটে না এই পবিত্র সম্পর্কের। তবে এমন গাঁটছড়াও আছে, যা বাঁধাই হয় মৃত্যুর পরে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এ কথা সত্যি।
এমনই এক ঐতিহ্য রয়েছে ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কর্নাটকে। বিশেষ এক নামও আছে এই প্রথার, ‘প্রেত মদুভে’। এর অর্থ প্রেতের বিবাহ। ‘কুলে মদিমে’ নামেও প্রচলিত এই প্রথা। দক্ষিণ কর্নাটক জেলার তুলুনাড়ু অঞ্চলের একটি প্রচলিত প্রথা এটি, যেখানে দু’টি বিদেহী আত্মার বিয়ে দেওয়া হয়।
পরিবারের কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্য অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলে, সে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে তার অভিভাবকেরা তার জন্য উপযুক্ত সঙ্গীর সন্ধান করতে শুরু করেন। পরিবারের মৃত সদস্য যাতে একাকিত্বে না ভোগে, সেই কারণেই এই উদ্যোগ বলে বিশ্বাস।
তবে শুধু এই কারণেই নয়। মৃত অবিবাহিত সদস্য বিবাহযোগ্য হওয়ার পরে তার বিয়ে না দেওয়া হলে সেই পরিবার দুর্ভাগ্যের হাত থেকেও সহজে নিষ্কৃতি পায় না বলে বিশ্বাস করা হয়। তার অপূর্ণ ইচ্ছার কারণেই এমনটা ঘটে বলে মনে করা হয়।
আবার অনেক সময় দেখা যায় কোনও পরিবারের বিবাহযোগ্য ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে নানা ভাবে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এ রকম সময়ে কোনও গণকঠাকুরের পরামর্শ নেওয়া হয়। তিনি এসে খোঁজ নেন যে, পরিবারের কোনও ছেলে বা মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় মারা গিয়েছে কি না। ঘটনা সত্যি হলে পরলোকগত উপযুক্ত ‘পাত্র’ বা ‘পাত্রী’র সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার নিদান দেন।
কর্নাটকের উপকূলীয় জেলা এবং কেরলের কাসারগড় জেলার একটি অংশের কিছু মানুষ এ-ও দাবি করে থাকেন যে, অবিবাহিত মৃত আত্মীয়েরা তাঁদের স্বপ্নে ক্রমাগত দেখা দিতে থাকেন। এই বিবাহ সম্পন্ন হলে পূর্ণতা লাভ করে বিদেহী আত্মারা। এটিকে পূর্বসূরিদের উপাসনারও একটি পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে।
অনেক সময় উপযুক্ত ‘পাত্র’ বা ‘পাত্রী’র সন্ধানে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সম্প্রতি কর্নাটকের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে এমনই একটি ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ৩০ বছর আগে মৃত মেয়ের জন্য উপযুক্ত মৃত পাত্রের খোঁজে বিজ্ঞাপন দেয় দক্ষিণ কর্নাটকের পুত্তুর শহরের একটি পরিবার। অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটিতে এ-ও ছিল যে, বরের পরিবার যেন অবশ্যই ‘কুলাল’ বর্ণ এবং ‘বাঙ্গেরা’ গোত্রের হয়।
বিদেহী আত্মাদের বিবাহ হলেও বিষয়টিকে যে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়, এই বিজ্ঞাপন দেখেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। বর্ণ, গোত্র, কুষ্ঠী সব মিলিয়ে তবেই দুই বিবাহযোগ্য বিদেহী আত্মা সাত পাকে বাঁধা পড়ে। শুভ দিনক্ষণ নির্ধারণ করে দেন পুরোহিত।
জীবিত ব্যক্তিদের বিয়ের সব রীতিই নিষ্ঠাভরে পালিত হয় ‘প্রেত মদুভে’তে। বর এবং কনের প্রতীক হিসাবে দু’টি পাত্র রাখা হয়। যে পাত্রটিকে কনে মনে করা হয় তাকে দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি, কালো মুক্তোর গয়না এবং জুঁই ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ‘বর’কে পোশাক-আশাকের সঙ্গে পাগড়িও পরানো হয়। বর-কনের ভাইবোনেরা দু’টি পাত্রের মালাবদল করান এবং ‘কনে’র সিঁথিতে সিঁদুর এঁকে দেওয়া হয়। কেরলের কাসারগড়ের মতো কিছু জায়গায় বর এবং কনের প্রতিনিধিত্ব করে দু’টি ছোট ছোট মূর্তি।
প্রেতের বিয়েতে আমন্ত্রিত থাকেন আত্মীয়-পরিজনেরাও। এমনই একটি বিয়েতে আমন্ত্রিত হওয়ার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া হয়েছে ‘@অ্যানি_অরুণ’ নামের একটি এক্স হ্যান্ডল থেকে। সেই বিয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে পোস্টদাতা লিখেছেন, দু’টি পরিবার একে অপরের বাড়িতে বাগ্দানের জন্য যাবে, বিয়ের শোভাযাত্রা হবে এবং সব শেষে গাঁটছড়া বাঁধা হবে।
অরুণ জানিয়েছেন, বিয়ের কনে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৩০ বছর আগে। অনুমান করা যায়, এই কনের জন্যই হয়তো ‘পাত্র চাই’ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল কর্নাটকের স্থানীয় সংবাদপত্রে। তিনি এমন এক ঘটনার উল্লেখও করেছেন যেখানে একটি বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছে কারণ মৃত কনে মৃত বরের চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিল!
হোসাবেত্তু বিশ্বনাথ নামে এক ব্যক্তির লেখায় পাওয়া যায়, তাঁর মাসিকে প্রতিবেশিনী জানকী-আক্কা ‘মামি’ সম্বোধন করতেন। সাধারণত শাশুড়িস্থানীয়াদের এই সম্বোধন করা হয়ে থাকে। অথচ, ছোট্ট বিশ্বনাথ বিবাহিত এমন কোনও পুরুষ-নারীকে এই দুই বাড়িতে দেখতেন না, যাঁদের কেন্দ্র করে এই সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। পরে তিনি জানতে পারেন তাঁর মাসির অবিবাহিত মৃত কন্যার সঙ্গে ‘কুলে মদিমে’ সম্পন্ন হয় জানকী-আক্কার অবিবাহিত মৃত ভাইয়ের। এ থেকে বোঝা যায়, যে দু’টি পরিবারের মৃত সদস্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তারা চিরকাল আত্মীয়তা বজায় রাখে।
দুর্বল স্মৃতিপথ ধরে হেঁটে খুব আবছা ভাবে বিশ্বনাথ মনে করতে পারেন যে, বর-কনের প্রতিনিধিত্ব করেছিল দু’টি নারকেল গাছ। তবে বহু চেষ্টা করেও এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন না তিনি। তাঁর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠেরা কেউই বেঁচে না থাকার কারণে ‘কুলে মদিমে’তে পালিত অন্যান্য আচার সম্পর্কেও বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।
অনেক সময় নাকি পরিবারের কোনও জীবিত সদস্যকে ভর করে মৃত অবিবাহিত সদস্যটি (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ)। এর মাধ্যমেই সে জানিয়ে দেয় যে কোথায় গেলে তার উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান পাওয়া যাবে। তবে আধুনিক ভাবনাচিন্তার ‘আক্রমণ’ এই প্রথা বিলুপ্ত করতে বসেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বনাথ।
এই প্রথার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তুলুনাড়ু অঞ্চলের মানুষেরা বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে কতখানি গুরুত্ব দেন। তাঁদের বিশ্বাস, বিয়ে না হলে মৃত্যুর পরেও শান্তি লাভ করা যায় না। শুধু এই জীবনে না, এই জীবন শেষ হয়ে গেলেও প্রাণ কেঁদে বেড়ায় সঙ্গীর আকাঙ্ক্ষায়।