Gold reserve in india

৩০০০০০০০০০০০০ টাকার ‘অলস’ সোনার মালিক ভারতীয়েরা! এই হলুদ ধাতু বাজারে এলে আর লাগবে না বিদেশি বিনিয়োগ?

বিশ্ববাজারে সোনার ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে তা জমানোর প্রবণতা বেশ কয়েক দশক ধরে বেড়েই চলেছে। নিরাপদ সম্পদ হিসাবে হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগেই আস্থা রাখছে আমজনতা। যদিও সেই সোনা ব্যাঙ্কের ভল্টে বা আলমারিতে বন্ধ রাখতেই ভালবাসেন অধিকাংশ ভারতীয়।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৭
Share:
০১ ২০

সোনা সঞ্চয়ের নিরিখে বিশ্বের প্রথম পাঁচ দেশকে মেলালেও কম পড়বে। ভারতীয় পরিবারগুলির হাতে যে পরিমাণ সোনা মজুত রয়েছে তার নজির বোধহয় বিশ্বের আর কোথাও নেই। ‘ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল’-এর পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে যত সোনা রয়েছে, তার ১১ শতাংশই ভারতীয় পরিবারের মহিলাদের নিজস্ব সম্পদ। ভারতীয় মহিলা বা পরিবারগুলির কাছে যত সোনা রয়েছে তার মোট পরিমাণ ২৫ হাজার টন!

০২ ২০

আমেরিকা, জার্মানি, চিন, সুইৎজ়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলিতেও এই নজির নেই। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ সোনা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন বিশেষত মহিলারাই। ভারতীয় সমাজ এবং সংস্কৃতিতে সোনার গুরুত্ব অপরিসীম। বিবাহ এবং অন্য সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসাবে সোনার অলঙ্কার দেওয়ার চল রয়েছে এই দেশে। তা ছাড়া ভবিষ্যতের সঞ্চয় হিসাবেও অনেকে সোনা কিনে রাখেন।

Advertisement
০৩ ২০

যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি নির্ভর করে তার সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর। যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার যত বেশি, সে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে তত শক্তিশালী। আরবিআইতে সোনাও সঞ্চয় করা হয় বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে। সঞ্চিত সোনার মূল্য বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে যুক্ত হয়। শুধু ভারত নয়, একাধিক দেশই এই নীতি নিয়েছে। স্বর্ণসঞ্চয়ে জোর দিচ্ছে তারা।

০৪ ২০

বিশ্ববাজারে বাড়ছে সোনার চাহিদা ও দাম। অর্থনীতিতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন সেই অস্থির পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে জমিয়ে রাখা সোনার হাতেই। স্থানীয় মুদ্রার দর পড়লেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালাতে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়, তাই নিজেদের রাজকোষে টন টন সোনা জমানোর দিকে নজর দিয়েছে ভারত। রাষ্ট্রের হাতে যে পরিমাণ সোনা বৈদেশিক তহবিলে রয়েছে তার তুলনায় ব্যক্তিগত মালিকানায় জমানো সোনার পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি।

০৫ ২০

যুগের পর যুগ ধরে সোনার গয়না পরার চল ভারতে। বিশ্ববাজারে সোনার ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে তা জমানোর প্রবণতা বেশ কয়েক দশক ধরে বেড়েই চলেছে। নিরাপদ সম্পদ হিসাবে হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগেই আস্থা রাখছে আমজনতা। যদিও সেই সোনা ব্যাঙ্কের ভল্টে বা আলমারিতে বন্ধ রাখতেই ভালবাসেন অধিকাংশ ভারতীয়।

০৬ ২০

বিপুল পরিমাণ এই সোনা ঠিকমতো ব্যবহার বা বিনিয়োগ করতে পারলে তা ভারতের অর্থনীতির পালে হাওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালের পর থেকে ভারতে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল এক লক্ষ কোটি টাকা।

০৭ ২০

২০২৪-২৫ সালে ভারতে মোট ৮১০০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে বলে জানিয়েছে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। তার আগের বছরের থেকে ১৪% বেশি। কিন্তু নিট হিসাবে এই লগ্নি প্রায় ৯৬% কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০ কোটি ডলারে। গত অর্থবর্ষে শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলি ১৭০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছে।

০৮ ২০

ট্রাম্পের শুল্কনীতির ঘায়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে দোলাচল তৈরি হওয়ায় জুলাই মাসে ভারত নিট ৫৫২৪ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে তহবিল তুলে নিয়েছে তারা। ফলে ভারতের বিদেশি বিনিয়োগ ধাক্কা খেয়েছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর জন্য বিদেশি বিনিয়োগের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার বদলে ভারতীয়দের কাছে গচ্ছিত সোনা ব্যবহার করতে পারলে আখেরে লাভ হবে সরকারেরই।

০৯ ২০

দেশের আমজনতার হাতে যে পরিমাণ সোনা জমা রয়েছে তার অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি টাকা। গত ২৫ বছরে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ ভারতে এসেছে তার তিন গুণ অর্থ জমা রয়েছে দেশের অভ্যন্তরেই। অর্থনীতিতে যখন টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হবে তখন দেশের জনগণের হাতে থাকা সোনাকেই কাজে লাগানো সম্ভব। সেই অস্থির পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে জমিয়ে রাখা সোনার হাতেই।

১০ ২০

স্বাধীনতার পর ভারতে সোনা কেনার উপর কিছু সরকারি নিয়ম আরোপ করা হয়েছিল। ভারতীয় মহিলা ও পুরুষেরা নির্দিষ্ট কিছু পরিমাণ সোনা নিজেদের নামে গচ্ছিত রাখতেন। সেই আইন ভারতীয়দের সোনা জমানোর প্রবণতা দমাতে পারেনি। চোরাপথে সোনা আমদানি উত্তরোত্তর বেড়ে গিয়েছিল।

১১ ২০

হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগের প্রথাগত রাস্তাটি হল অলঙ্কার ক্রয়। তবে সেই বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীর মুনাফার সুযোগ কম। কারণ অলঙ্কারে একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা কিনতে হয়। সেখানে হলুদ ধাতুর ভগ্নাংশ কেনার কোনও সুযোগ নেই।

১২ ২০

অলঙ্কারের ক্ষেত্রে হলুদ ধাতু বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা করা বেশ জটিল। কারণ, এতে গয়নার মজুরি বাদ দিয়ে সোনার দাম হিসাব করা হয়। তা ছাড়া অনেক সময় দামি পাথরে অলঙ্কারের নকশা তৈরি করা হয়। বিক্রির সময় সেগুলিকে বাদ দিয়ে সোনার দর হিসাব করতে হবে।

১৩ ২০

এই সোনা উৎপাদনশীল সম্পদ তৈরির পরিবর্তে পারিবারিক সঞ্চয়ে রূপান্তরিত হচ্ছিল। জনতার জমানো সোনা বাজারে টেনে এনে লগ্নি করানোর জন্য গোল্ড মানিটাইজ়েশন প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। এই প্রকল্পে সাধারণ মানুষ তাঁদের ঘরে থাকা সোনা ব্যাঙ্কে জমা রাখতে পারবেন। আর তার জন্য সুদও পাবেন তাঁরা। ব্যাঙ্ক ওই সোনা গয়না প্রস্তুতকারকদের ঋণ হিসাবে দিতে পারবে, যার মাধ্যমে ব্যাঙ্কের সামনে খুলে যাবে আয়ের আরও একটি পথ।

১৪ ২০

অলস ভাবে পড়ে থাকা ওই সোনা সুদের বিনিময়ে ব্যাঙ্কে জমা রাখার প্রকল্প কেন্দ্রীয় সরকার চালু করে ২০১৫-র নভেম্বরে। লক্ষ্য ছিল ওই সোনা গলিয়ে তা গয়না প্রস্তুতকারীদের কাছে জোগান দেওয়া, যাতে বিপুল পরিমাণ সোনা আমদানিতে রাশ টানা সম্ভব হয়। কিন্তু সামান্য সুদ এবং সেই সঙ্গে খাদ বাদ দিয়ে গয়না থেকে খাঁটি সোনা বার করে আনার খরচের কারণে অনেক ভারতীয়ের কাছেই এই প্রকল্প না-পসন্দ ছিল।

১৫ ২০

পারিবারিক ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসেবে গয়নার প্রতি ভারতীয়দের আকর্ষণ বিদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি। সোনার বদলে পুঁজি বা ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ভারতীয় সংস্কৃতিতে ভাল চোখে দেখা হয় না। তাই সরকারের প্রকল্পটি সাদরে গৃহীত হয়নি ভারতীয় পরিবারে। অন্য দিকে প্রকল্পে সোনা জমা নিয়ে ব্যাঙ্কগুলির হাতেও লাভ প্রায় থাকে না। মাত্র ৩০ টন সোনা সরকারি ভাঁড়ারে জমা পড়েছিল।

১৬ ২০

অন্যান্য দেশের মতো ভারতে সোনার খনিতে বিদেশি বিনিয়োগ করার নিয়ম নেই। আফ্রিকার ছোট্ট দেশ ঘানাও তাদের সোনার খনিতে ৫০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ চালু করেছে। ভারতে সেই সুবিধা নেই। তাই ভারত এখনও পর্যন্ত ৯০ শতাংশ সোনা আমদানি করে থাকে। ভারতীয়দের হাতে থাকা সোনা যদি সরকার কাজে লাগাতে পারত তবে সেই আমদানির পরিমাণ ৫০ শতাংশে নেমে আসত বলে মত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের।

১৭ ২০

জমানো সোনার ১০% সংগ্রহ করে যদি আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো যেতে পারে, নতুন সোনা আমদানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে। ফলে ভারতের মুদ্রা স্থিতিশীল হবে, বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং আরও স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামো তৈরি করবে ভারত।

১৮ ২০

সুখের বিষয় হল বিশ্ব রাজনীতি অস্থির হওয়ার কারণে হলুদ ধাতুর দাম রকেটের গতিতে চড়তে শুরু করেছে। শুধুমাত্র অলঙ্কার কেনার পুরনো প্রথাগত লগ্নির রাস্তা থেকে কিছুটা সরে আসছেন তরুণ প্রজন্মের বিনিয়োগকারীরা। ডিজিটাল সোনা ক্রয়ের প্রবণতা বাড়ছে তাঁদের। প্রথমত বিনিয়োগের ঝুটঝামেলা অনেকটাই কম।

১৯ ২০

মাত্র একশো টাকা দিয়েও ডিজিটাল সোনা কিনতে পারেন গ্রাহক। এর ফলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে সোনা। আবার বিক্রির ক্ষেত্রেও ডিজিটাল সোনায় কোনও ঝুটঝামেলা নেই। গ্রাহক যতটা পরিমাণ হলুদ ধাতু বিক্রি করতে চাইছেন তার দাম পেয়ে যাবেন তিনি। এ ছাড়াও আবার লগ্নিকারী ইচ্ছে করলে ডিজিটাল সোনাকে ভৌত হলুদ ধাতুতে বদলে নিতে পারেন। অর্থাৎ, একে সোনার বার বা কয়েনে বদলে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে ডিজিটাল লেনদেনে।

২০ ২০

আরবিআই একটি ভারসাম্য রিজ়ার্ভ পোর্টফোলিয়ো তৈরির জন্য সোনা মজুত করছে। দেশের বিদেশি মুদ্রা ভান্ডারে কিছু বৈচিত্র থাকার প্রয়োজন রয়েছে। সেই কথা মাথায় রেখেই এই পদক্ষেপ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। শুধু ভারত নয়, একাধিক দেশই স্বর্ণসঞ্চয়ে জোর দিচ্ছে। শুধুমাত্র ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে তারা। আর তাই বিকল্প হয়ে উঠছে সোনা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement