খোদ পুলিশকর্তার মেয়ে। আর তাঁর হাত ধরেই কেজি কেজি সোনা পাচার হত ভারতে। এক বছর ধরে দুবাই যাতায়াত করছিলেন তিনি। গত ৩ মার্চ বেঙ্গালুরুর কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১৪ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা-সহ গ্রেফতার হন কন্নড় অভিনেত্রী রান্যা রাও। এর আন্তর্জাতিক বাজারদর প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বিমানবন্দরগুলিতে যে ধরনের নিরাপত্তা এবং নজরদারির মধ্যে দিয়ে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়, সেই নজরদারি এড়িয়ে কী ভাবে সোনা পাচার করছিলেন অভিনেত্রী? কন্নড় অভিনেত্রী ভাল ভাবে জানতেন যে, শরীরে এমন একটি অংশে সোনা রাখতে হবে যা সহজে ধরা পড়বে না।
তা ছাড়া মহিলা হওয়ার কারণে তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষাও করা হবে না। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। ঊরুতে টেপ এবং ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে সোনার বিস্কুটগুলিকে বেঁধে নিতেন। গত ৩ মার্চও সেই কৌশল কাজে লাগিয়ে সোনা পাচার করছিলেন। ১৪টি সোনার বাট শরীরে আটকে পাচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
শুধু এই অভিনেত্রী নন, শুল্ক দফতরের কড়া নজর এড়িয়ে নানা অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করেন সোনা পাচারকারীরা। সব সময় সেই কৌশল যে সফল হয় তা নয়। নিরাপত্তার বেষ্টনীতে ধরা পড়ে যায় বেশির ভাগ ফন্দিফিকির। এমনও ঘটনা ধরা পড়েছে যেখানে এক মহিলা ৩৫ লিটারের সোনার পেস্ট তৈরি করে তা মলদ্বারে ভরে পাচার করার চেষ্টা করছিলেন।
কখনও হুইলচেয়ারের ফাঁপা দণ্ডে সোনা ভরে ভারতে আনা হয়। আবার কখনও তরল সোনা শ্যাম্পুর বোতলে মিশিয়ে, অন্তর্বাসে লুকিয়ে, কখনও আবার পরচুলার মধ্যে সোনা ভরে পাচার করার চেষ্টা চলে। সেই পরিকল্পনা কখনও সফল হয় আবার কখনও পাচারকারীরা ধরা পড়েন ডায়রেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স-এর (ডিআরআই) হাতে।
বিমানকর্মীদের সহায়তায় কী ভাবে সোনা পাচার হয় তা বোঝা যায় ‘ক্রু’ নামের সিনেমাটি দেখলে। রুপোলি পর্দায় যা দেখানো হয়েছে তার অনেকটাই বাস্তব। বিমানের আসনের নীচে সোনার পাত রেখে তা পাচার করেন কোনও কোনও বিমানকর্মী, এমনটাই অভিযোগ। পরে সেগুলি সাফাইকর্মীর যোগসাজশে বার করে আনা হয় বিমানবন্দর থেকে।
এক বার একটি বিমানের সিঙ্কের নীচে তিন কেজি সোনার গুঁড়ো উদ্ধার হয়েছিল। সেই সোনার মূল্য ছিল এক কোটি টাকারও বেশি। সোনাপাচারের সবচেয়ে সোজা উপায়গুলির মধ্যে কয়েকটি হল হেডফোনের ভিতরের অংশে সোনা ভরে দেওয়া, বেল্টের ধাতব অংশটি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া। এমনকি চকোলেট ও খেজুরের মধ্যে ভরে সোনাপাচারও চলে। প্রতি বারই নতুন নতুন পদ্ধতি ও উপায় বেছে নেন পাচারকারীরা।
বিভিন্ন বিমানবন্দর ও সীমান্তে যে সব সোনা উদ্ধারের খবর সংবাদ শিরোনামে আসে, সেই সমস্ত পাচারচক্রের জাল বিছিয়ে রয়েছে ভারত জুড়ে। সংবাদমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য বলছে ৮৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা চলে বেআইনি সোনাপাচারকে কেন্দ্র করে। এই অন্ধকার সাম্রাজ্যের শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে পড়শি দেশ পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত।
ভারতে সোনার চাহিদা এত বেশি যে তা ২০২৪ সালে চিনের সোনার চাহিদাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। সেই চাহিদার সঙ্গে লাভের তুল্যমূল্য বিচার করে সোনাপাচার ভারতে রমরমা এক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। গত এক বছরের বাজেয়াপ্ত হওয়া সোনার পরিমাণ দেখলে এই ব্যবসার পরিধি কতটা তা কিছুটা হলেও অনুমান করা সম্ভব।
২০২৩-২৪ সালে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েছে প্রায় ৪ হাজার ৯০০ কেজি অবৈধ সোনা। ১৯২২ জনকে সোনাপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও এই সংখ্যাটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ৫০ শতাংশ সোনা পাচারকারী বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায় আইনের ফাঁক গলে।
২০২৪ সালের আগে ভারতে সোনার উপর কর ছিল ১৫ শতাংশ। কর ব্যতীত বিদেশ থেকে ভারতীয় পুরুষদের সোনা আনার ক্ষেত্রে ছাড়ের উর্ধ্বসীমা ছিল ৫০ হাজার টাকা অথবা ২০ গ্রাম পরিমাণ সোনার মধ্যে যে পরিমাণ বেশি হবে সেটি। মহিলাদের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে সোনা আনার ক্ষেত্রে এই ছাড় কিছুটা বেশি। মহিলারা ১ লক্ষ টাকা বা ৪০ গ্রাম সোনা কোনও প্রকার কর ছাড়াই ভারতে আনতে পারবেন বৈধ ভাবে।
তবে কেন এই অবৈধ ব্যবসার রমরমা? সাদা চোখে দেখতে গেলে ১৫ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য। সোনা পাচারকারীরা ভারতীয় বাজারে সোনা বিক্রি করে সোনার দাম ছাড়াও করের এই অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ লাভ করতে পারতেন। সরকার ২০২৪ সালের জুলাই থেকে সোনা আমদানির ক্ষেত্রে করের বোঝা এক ধাক্কায় অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনে।
মাত্র ৬ শতাংশ কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেকে পাচার করা সোনা কিনতে উৎসাহী। এর প্রধান কারণ, ভারতীয়েরা বিশ্বাস করেন, সোনা জমানো মানে ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা থাকা। ভারতীয় পরিবারের মহিলাদের গহনাপ্রীতি অজানা নয়। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় মহিলাদের কাছে যত সোনা গচ্ছিত রয়েছে সেই পরিমাণ সোনা খুব কম দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ভল্টে জমা রয়েছে।
বিপুল চাহিদার জন্যই সোনাপাচারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেকেই। পশ্চিম এশিয়া, বিশেষ করে দুবাই থেকে সোনা এনে তা পাচারকারী দলের হাতে তুলে দিলেই হাতে হাতে মেলে নগদ টাকা। তথ্য বলছে, শুল্ক দফতরের নজর এড়িয়ে এক বার দুবাই বা পশ্চিম এশিয়ার দেশ থেকে সোনা আনতে পারলেই মেলে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা। সঙ্গে বিনামূল্যে বিদেশভ্রমণ, বিলাসবহুল হোটেলে থাকা তো রয়েইছে।
ডায়রেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স ও সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমসের তথ্য খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রতি বছর ১৫০ থেকে ২০০ টন সোনা অবৈধ ভাবে ভারতে ঢুকছে। এর মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশই ধরা পড়ে তল্লাশি অভিযানে। ধরা না পড়া সেই টন টন সোনার মূল্য ৮৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছরই ৯ হাজার কোটি টাকা কর হারায় সংশ্লিষ্ট দফতর।
পাচার হওয়া সোনা ব্যবহার করা হয় নির্মাণ ব্যবসা থেকে শুরু করে হাওলাতেও। এমনকি বাংলাদেশে সীমান্তপারে টাকার বদলে বেচাকেনা হয় সোনায়। এর ফলে ভারতীয় টাকার দাম আরও পড়ছে। এখানেই শেষ নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাতেও প্রভাব ফেলছে সোনাপাচার।
ভারতে ২ হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার পর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ও সন্ত্রাসবাদী দলগুলি লেনদেনের হাতিয়ার করেছে সোনা ও হিরে। সোনাপাচারের ঘটনায় উঠে আসে কুখ্যাত ডন দাউদ ইব্রাহিমের নামও।
জড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অন্যতম বৃহত্তম জঙ্গি সংগঠন লশকর-ই-ত্যায়বার নামও। বিভিন্ন জেহাদি পরিকল্পনা ও অস্ত্র কেনাবেচায় নগদ টাকার বদলে তারা ব্যবহার করে পাচার হয়ে আসা সোনা। ফলে দেশের নিরাপত্তার জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এই সোনাপাচার।
বর্তমানে আদালতের নির্দেশে ডিআরআই হেফাজতে রয়েছেন অভিনেত্রী রান্যা। সেখানেই গোয়েন্দারা তাঁকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তাঁর সঙ্গে কোনও বড় চক্রের যোগ রয়েছে কি না খোঁজ চলছে তারও। দুবাই থেকে সেই চক্র পরিচালনা করা হয় বলেও অনুমান তদন্তকারীদের।