Civil War in Myanmar

মায়ানমারের গৃহযুদ্ধে হাত রয়েছে ‘বন্ধু’ চিনের! কোন দুই অস্ত্রে শান দিয়ে আখের গোছাচ্ছে বেজিং?

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরই একাংশের মত, মায়ানমারে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বহিরাগত শক্তির। অনেকেই মনে করছেন, ‘বন্ধু’ চিনের হস্তক্ষেপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মায়নমারের পরিস্থিতি।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০৭
Share:
০১ ২৬

রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে টালমাটাল পরিস্থিতি মায়নমারের। ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল জুন্টা সরকার। তার পর দু’বছর পরিস্থিতি খানিক ঠিকই ছিল। বিক্ষিপ্ত ভাবে অশান্তি ছড়ালেও বড় মাপের কিছু হয়নি। তবে সেনাবিরোধী সংঘর্ষে আবারও উত্তপ্ত হয়েছে মায়ানমার। ভারতের প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রের উত্তরাংশে সেনা বনাম সেনাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ইতিমধ্যেই ঘরছাড়া হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ।

০২ ২৬

মায়ানমারে সীমান্তবর্তী অঞ্চল, বিশেষ করে শান এবং কাচিনে বিদ্রোহীরা আপাতত মূল ঘাঁটি গড়ে তুলেছেন। এই দুই প্রদেশে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ফলে এই দুই অঞ্চলে দারিদ্র, অবৈধ কার্যকলাপ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিমাণও বেশি।

Advertisement
০৩ ২৬

সেই শান এবং কাচিনেই জুন্টা সরকার বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যকলাপ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। মায়ানমারে রাজনৈতিক ওঠাপড়া নিয়ে যাঁরা খোঁজ রাখেন, তাঁদের একটি বড় অংশের মত, গত দু’বছরে কখনও এতটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি মায়ানমারের সামরিক সরকারকে।

০৪ ২৬

সেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরই একাংশের মত, মায়ানমারে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বহিরাগত শক্তির। অনেকেই মনে করছেন, ‘বন্ধু’ চিনের হস্তক্ষেপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মায়ানমারের পরিস্থিতি।

০৫ ২৬

বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়ানমারের অন্ধকার জগতের উপর দখল রয়েছে চিনের। যার মূল দুই প্রতিফলন হল, মানব এবং মাদক পাচার চক্র। এই দুই অস্ত্রে শান দিয়েই নাকি আখের গুছিয়ে ফেলছে চিন।

০৬ ২৬

মায়ানমারের ইতিহাসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে জাতিগত বিদ্রোহ এবং সরকার বিরোধী আন্দোলন। আপাতত জুন্টা সরকারের উপর সম্মিলিত আক্রমণ করা বর্তমান বিদ্রোহের উদ্দেশ্য। আর সেই বিদ্রোহকে বাঁচিয়ে রাখতে যে অর্থের প্রয়োজন, তার অনেকখানির জোগান আসছে চিন থেকে।

০৭ ২৬

মায়ানমারের শান প্রদেশে সেনাবিরোধী মূল দুই শক্তি—‘থ্রি ব্রাদারহুড’ জোট (ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি) এবং ‘ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’র আর্থিক চাহিদা মেটে মাদক ব্যবসার উপার্জন থেকে।

০৮ ২৬

মায়ানমারের উত্তরাঞ্চলে রয়েছে মায়ানমার-চিন সীমান্ত। আর সেই সীমান্ত অঞ্চলে রমরমিয়ে চলা মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রেখেছে সরকার বিরোধী সামরিক গোষ্ঠীগুলি।

০৯ ২৬

দক্ষিণ চিনের সীমান্তেই রয়েছে মায়ানমারের শান প্রদেশ। এই শান প্রদেশ আবার ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল (মায়ানমার, লাওস এবং তাইল্যান্ড)’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হেরোইন উৎপাদন অঞ্চল হিসাবে এই ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’-এর নাম উঠে এসেছে।

১০ ২৬

একই সঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম সিন্থেটিক মাদক উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবেও পরিচিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর শান প্রদেশের মাদক পাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১১ ২৬

বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, বিদ্রোহীদের ঘাঁটি শান প্রদেশে মাদক চোরাচালানকে রুখতে পারেনি মায়ানমারের সামরিক সরকার। আর সেই মাদকের রমরমা টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চিন।

১২ ২৬

২০২১ সালে লাওসে ৭২ টন ‘প্রোপিওনাইল ক্লোরাইড (মেথামফেটামিন তৈরি করতে ব্যবহৃত)’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, যা এসেছিল চিনের জিয়াংসু প্রদেশ থেকে। লাওস হয়ে মায়ানমারে পৌঁছনোর কথা ছিল সেই মাদকের।

১৩ ২৬

একটি অসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সশস্ত্র বিদ্রোহীরা নিজেদের মাদক ব্যবসা আরও ছড়িয়ে দিতে চিন-মায়ানমার সম্পর্ককে কাজে লাগাচ্ছে। অবৈধ মাদক উৎপাদনে ব্যবহৃত রাসায়নিক চিন থেকেই মায়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে পৌঁছচ্ছে। তার পর পৌঁছে যাচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির হাতে।

১৪ ২৬

পাশাপাশি, সামরিক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, চাপে থাকা জুন্টা সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে মায়ানমারকে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারে শি জিনপিং সরকার। আর সেই কারণেই নাকি গোপনে বিদ্রোহীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে চিন।

১৫ ২৬

আবার বিশেষজ্ঞেরা এ-ও মনে করছেন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেলে, সেই রাস্তা ধরে মায়ানমারে মাদক পাচার করা আরও সুবিধাজনক হবে। অর্থাৎ, দু’দিকে সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের আখের গোছাচ্ছে চিন।

১৬ ২৬

বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন, মায়ানমারের মাদক ব্যবসার পাশাপাশি মানব পাচার, বিশেষ করে নারী পাচার চক্রের অন্যতম মূল কান্ডারি চিন। ‘জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’ এবং ‘কাচিন উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন তাইল্যান্ড’-এর সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ২০১৩-২০১৭ সালের মধ্যে মায়ানমার থেকে প্রায় ২১ হাজার কিশোরী এবং যুবতীকে চিনের একটি নির্দিষ্ট প্রদেশে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

১৭ ২৬

সমীক্ষা অনুযায়ী, ওই একই সময়ে চিন থেকে মায়ানমারের যে এক লক্ষ ৬০ হাজার মহিলা পরিযায়ী দেশে ফিরেছেন তাঁদের মধ্যে পাঁচ হাজার জনকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চিনে পাচার করা হয়েছিল ৩,৯০০ জনকে এবং ২,৮০০ জনকে জোর করে সন্তান ধারণে বাধ্য করানো হয়েছিল।

১৮ ২৬

২০১৭-’১৮ সালে করা জন হপকিন্সের অন্য আর একটি গবেষণা অনুযায়ী, মায়ানমার থেকে ১৫ থেকে ৫৫ বছর প্রায় ৪০০ জন পরিযায়ী মহিলাকে চিনে নিয়ে গিয়ে সে দেশের পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সন্তানের জন্মও দেন তাঁরা।

১৯ ২৬

মায়ানমারের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সে দেশে মানব পাচারের ২২৬টি ঘটনা ঘটেছে। সরকার জানিয়েছে, মায়ানমারের সমাজকল্যাণ বিভাগ প্রতি বছর ১০০ থেকে ২০০ জন নারীকে চিন থেকে সে দেশে ফেরত নিয়ে আসে।

২০ ২৬

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাচার হওয়া নারীদের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় অনেক বেশি। মায়ানমারের শান এবং কাচিন প্রদেশের মতো এলাকায় স্বল্পশিক্ষিত গ্রামীণ এলাকার মহিলাদের জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার চল বেশি। এই অঞ্চলে ক্রমাগত সরকার বিরোধী বিদ্রোহ হাজার হাজার নারীকে তাঁদের অজান্তেই পাচারের শিকার হতে বাধ্য করেছে।

২১ ২৬

নারীদের পাচার করার পর তাদের মাদক সেবনে বাধ্য করা হয়। এর পর তাঁদের যৌন পেশায় ঠেলে দেওয়া হয়। অনেককে চিনের পুরুষদের ‘ভোগ্যপণ্য’ হিসাবে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কোনও মহিলা যদি পাচারের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের দ্বারস্থও হন, তা হলে তাঁকে চিনে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।

২২ ২৬

মায়ানমারের নারী পাচারের ঘটনা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসাবে চিনের ‘এক-সন্তান’ নীতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। একমাত্র সন্তান যাতে পুত্র হয়, তাই মায়নমারের মেয়েদের জোর করে বিয়ে করেন চিনের পুরুষেরা। যদি দেখা যায়, বিয়ের পর মহিলাদের গর্ভে কন্যাসন্তানের ভ্রূণ রয়েছে, তা হলে গর্ভপাত করানো হয়। চিনের মহিলাদের সঙ্গে এমন করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হতে পারে মনে করেই মায়ানমারের মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে করেন চিনের অনেক পুরুষ।

২৩ ২৬

২০২১ সালে মায়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে নারী এবং মাদক পাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, এর জন্য শুধু জুন্টা সরকারের অভ্যুত্থানকে দায়ী করছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, দীর্ঘ দিন ধরে মায়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নিজের সুবিধার জন্য কাজে লাগিয়েছে চিন। পাশাপাশি, দেশটিকে গৃহযুদ্ধে এবং অশান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

২৪ ২৬

সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আপাত ভাবে চিন মায়ানমারের জুন্টা সরকারের সমর্থক দেশ হিসাবেই পরিচিত। কিন্তু তলে তলে নাকি বিদ্রোহীদের সঙ্গেও দহরম-মহরম রয়েছে চিনের।

২৫ ২৬

২০২০-র নির্বাচনে জিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছিল মায়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী সু চি-র দল। কিন্তু তার কিছু দিন পরেই সেনা অভ্যুত্থান হয় মায়ানমারে। সে বছর ১ ফেব্রুয়ারি সু চি-সহ বহু গণতন্ত্রকামী নেতা-নেত্রীকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনী।

২৬ ২৬

দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে একাধিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলেও সেই সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমন করে জুন্টা সরকার। তবে দেশের সব জায়গায় সমান নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারেনি তারা। তবে এ বার কার্যত পশ্চাদপসরণ করতে দেখা যাচ্ছে তাদের।

ছবি: রয়টার্স এবং এএফপি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
Advertisement
আরও গ্যালারি
Advertisement