এক দিকে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো ধাঁচের সামরিক সমঝোতা। অন্য দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দহরম-মহরম। এর পাশাপাশি আর এক ‘সুপার পাওয়ার’ চিনকে ‘বন্ধু’ হিসাবে পেয়েছে পাকিস্তান। বিদেশনীতিতে ইসলামাবাদের এ-হেন সাফল্য একেবারই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আর্থিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও কোন জাদুমন্ত্রে এটা করতে সক্ষম হচ্ছেন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির? দুনিয়া জুড়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সন্ত্রাসবাদ, সীমান্ত সংঘাত, একাধিক প্রদেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়া এবং রাজনৈতিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কখনওই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েনি ইসলামাবাদ। এর নেপথ্যে মূলত চারটি কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা। এর মধ্যে প্রথমেই আসবে পাকিস্তানের ‘কৌশলগত অবস্থান’। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীটির সঙ্গে ইরান, আফগানিস্তান এবং চিনের সীমান্ত রয়েছে। আর তাই দেশভাগের ফলে জন্ম হওয়া রাষ্ট্রটিকে মধ্য এশিয়ার ‘প্রবেশদ্বার’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে পশ্চিম, দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ার একটি সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণেই আমেরিকা এবং চিনের মতো ‘সুপার পাওয়ার’ দেশগুলিকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারছে ইসলামাবাদ। ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীর জমিতে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারলে এশিয়ার একটা বিরাট এলাকার উপর যে প্রভাব খাটানো যাবে, তা ভালই জানে ওয়াশিংটন ও বেজিং। পাশাপাশি, সেখানকার সম্পদের উপরেও নজর আছে এই সমস্ত দেশের।
যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান-প্রেমের প্রধান কারণ হল আফগানিস্তান। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে হিন্দুকুশের কোলের দেশটির বাগরাম বিমানঘাঁটি কব্জা করতে চেয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মূলত চিনের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজর রাখতে সংশ্লিষ্ট বায়ুসেনা ছাউনিটির নিয়ন্ত্রণ চাইছেন তিনি। তা ছাড়া আমু দরিয়ার তীরে ওয়াশিংটনবিরোধী কোনও জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কি না, বলা বাহুল্য সে দিকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর প্রশাসনের।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তালিবানশাসিত আফগানিস্তান থেকে বাগরাম ছিনিয়ে নিতে আগামী দিনে সেখানে সামরিক অভিযান করবেন ট্রাম্প। হিন্দুকুশের কোলের দেশটি পুরোপুরি স্থলবেষ্টিত হওয়ায় ওই এলাকায় বাহিনী নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের জমি ব্যবহার করা ছাড়া আমেরিকার কাছে দ্বিতীয় রাস্তা নেই। সেই কারণে ইসলামাবাদকে হাতে রাখতে চাইছেন তিনি। অন্য দিকে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় এবং সেনাপ্রধান মুনির।
৯/১১ হামলার পর ২০০১ সালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান আক্রমণ করে মার্কিন ফৌজ। তাদের সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুয়েরিং ফ্রিডম’। ওই সময় সেনাশাসনে থাকা পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন জেনারেল পারভেজ় মুশারফ। যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে হামলা চালানোর জন্য রাস্তা দিতে দ্বিতীয় বার ভাবেননি তিনি। অচিরেই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যাবে বলে মনে করছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
আফগানিস্তানকে বাদ দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার ঘনিষ্ঠতার দ্বিতীয় কারণ হল ইরান। ১৯৭৯ সালে সাবেক পারস্য মুলুকে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা রুহুল্লাহ্ খামেনেই। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয় সেখানকার পহেলভি রাজবংশ। সংশ্লিষ্ট পরিবারটির মাধ্যমে তেহরানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। কুর্সিবদলের আগে পর্যন্ত দু’তরফে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। কিন্তু সেখানে খামেনেই আসতেই বদলাতে শুরু করে পরিস্থিতি। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে সাবেক পারস্য দেশটির উপর প্রভাব পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে ওয়াশিংটন।
২১ শতকে পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আরও খারাপ হয়েছে ইরান এবং আমেরিকার সম্পর্ক। তেহরানের বর্তমান শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতোল্লা আলি খামেনেই প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। অন্য দিকে ওয়াশিংটনের অভিযোগ, পরমাণু কর্মসূচির আড়ালে আণবিক বোমা তৈরির মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে তেহরান। গণবিধ্বংসী ওই অস্ত্র হাতে পেলে তা ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার উপর প্রয়োগ করতে পিছপা হবে না তারা। এই নিয়ে দু’তরফে যুদ্ধ পরিস্থিতি রয়েছে বলা যেতে পারে।
ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির স্বপ্নে জল ঢালতে চলতি বছরের জুনে সাবেক পারস্য দেশে হামলা চালায় মার্কিন বিমানবাহিনী। সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’। এতে কৌশলগত বোমারু বিমান বি-২ স্পিরিটকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার উড়ে এসে তেহরানের তিনটি আণবিক কেন্দ্রে বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলেছিল তারা। কিন্তু তার পরেও শিয়া মুলুকটির পরমাণু অস্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা গিয়েছে, এ কথা মানতে নারাজ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
এই পরিস্থিতিতে তেহরানের উপর কড়া নজরদারি চালাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের সেই দুর্বলতা টের পেতেই আসরে নামে ইসলামাবাদ। সূত্রের খবর, এ বছরের অক্টোবরের গোড়ায় দক্ষিণ-পশ্চিম পাক প্রদেশ বালোচিস্তান পাসনিতে একটি বন্দর তৈরির প্রস্তাব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। জায়গাটা থেকে ইরানের চাবাহার বন্দরের দূরত্ব মেরেকেটে ১৪২ কিলোমিটার। ফলে রাওয়ালপিন্ডির সেনাপ্রধানের প্রস্তাব মেনে নিলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রপথে যে মার্কিন আধিপত্য বাড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এ ছাড়া আরও একটি বিষয়ের ‘লোভ’ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কাছে টানছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের দাবি, বালোচিস্তানের মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে বিরল খনিজের বিশাল ভান্ডার। অক্টোবরে আমেরিকা সফরে গিয়ে সেই ধাতুগুলির নমুনা ট্রাম্পকে দেখান শাহবাজ় এবং মুনির। ফলে বিরল খনিজ হস্তগত করতে একগুচ্ছ মার্কিন সংস্থার সেখানে লগ্নি করার সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এই ধাতু সরবরাহের উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। এর জেরে ওয়াশিংটনের রক্তচাপ যে বেড়েছে, বলাই বাহুল্য।
ইসলামাবাদ-বেজিং সম্পর্কের আবার অন্য সমীকরণ রয়েছে। ২০১৩ সালে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে রাস্তা ও সমুদ্রবন্দর নির্মাণ-সহ একাধিক পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে ড্রাগন সরকার। ‘চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসি (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) নামের ওই প্রকল্পের কাজ এখনও চলছে। এটি মান্দারিনভাষীদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্গত বলে জানা গিয়েছে।
বর্তমানে চিনের ৮০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মলাক্কা প্রণালী দিয়ে। বিশ্লেষকদের দাবি, সংঘাত পরিস্থিতিতে ভারতীয় নৌবাহিনী ওই রাস্তা বন্ধ করলে নিমেষে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে বেজিঙের অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে সিপিইসির মাধ্যমে আরব সাগর পর্যন্ত একটা বিকল্প রাস্তা দিয়ে ড্রাগনের বিশ্বাস অর্জন করছে পাকিস্তান। এর মাধ্যমে বালোচিস্তানের গ্বদর বন্দরটিকে মান্দারিনভাষীদের হাতে ইসলামাবাদ তুলে দিয়েছে বলা যেতে পারে।
গত শতাব্দীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এবং আমেরিকার মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হলে দু’টি অক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে পৃথিবী। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা একাধিক সামরিক জোটে যোগ দেয় পাকিস্তান। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৫৫ সালের ‘কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা’ বা সেন্টো (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) এবং ১৯৫৪ সালের ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা সিয়াটো (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। ফলে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠতে ইসলামাবাদের খুব একটা সমস্যা হয়নি।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ফৌজ আফগানিস্তানে অভিযান চালালে আরও কাছাকাছি আসে আমেরিকা ও পাকিস্তান। ওই সময় মধ্য এশিয়ায় মস্কোর প্রভাব আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে একটা গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে তারা। সিআইএ-র এই গোপন অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সাইক্লোন’। এতে খোলাখুলি ভাবে ইসলামাবাদের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের সাহায্য পেয়েছিল তারা।
‘অপারেশন সাইক্লোন’-এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে ‘মুজ়াহিদিন’ বা ধর্মযোদ্ধা নামে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে তৈরি করতে সক্ষম হয় আমেরিকা ও পাকিস্তান। গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা সোভিয়েত বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। ফলে ১৯৮৯ সালে আমু দরিয়া পেরিয়ে দেশে ফিরে যায় মস্কোর ফৌজ। এর দু’বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৯১) পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া মিলিয়ে জন্ম হয় রাশিয়া-সহ ১৫টি রাষ্ট্রের।
১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর চিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করে পাকিস্তান। সংশ্লিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী, পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা পিওকে-র (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর) শ্যাক্সগাম উপত্যকা বেজিঙের হাতে তুলে দেয় ইসলামাবাদ। এতে দু’তরফের সম্পর্ক আরও মজবুত হয়েছিল। বর্তমানে ড্রাগনের তৈরি হাতিয়ারের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হল পাকিস্তান।
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে পাকিস্তানের নিবিড় যোগাযোগের নেপথ্যে রয়েছে এর ইসলামীয় পরিচয়। অতীতে ইসলামাবাদের সেনা অফিসারদের জর্ডন, ইয়েমেন এবং কাতারের মতো দেশে মোতায়েন থাকতে দেখা গিয়েছে। আরব দুনিয়ার ইহুদি রাষ্ট্র ইজ়রায়েলকে দেশ হিসাবে মান্যতা দেয় না পাক সরকার। এটাও তাদের সৌদি আরবের মতো বিত্তবান এবং খনিজ তেল সমৃদ্ধ দেশের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে।