চারদিক ঘেরা ঘন নীল জল। তার মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া এক দ্বীপ। উপকূলবর্তী একটি ছোট দ্বীপ। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে ভেসে রয়েছে দ্বীপটি। ১০০ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এত কাল ধরে জনশূন্য রয়েছে অভিশপ্ত দ্বীপটি। এই দ্বীপে পা রাখলে নাকি প্রাণ নিয়ে ফেরা প্রায় অসম্ভব।
ব্রাজ়িলের সাও পাওলো উপকূল থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে দ্বীপটি। সাধারণ পর্যটকদের দৃষ্টিতে এটি একটি সবুজে ঘেরা নির্জন দ্বীপ হতে পারে, কিন্তু এই দ্বীপের প্রতি বর্গফুটে পাতা রয়েছে মৃত্যুফাঁদ। আনাচকানাচে ওত পেতে রয়েছে কালান্তক জীব। গোটা ব্রাজ়িলের মানুষের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত যে ওই দ্বীপে গেলে জীবন্ত কেউ ফিরে আসে না!
ইলহা দ্য কুয়েইমাডা গ্র্যান্ডে। নামটা শুনলেই কেমন রহস্য রহস্য ভাব ফুটে ওঠে। এই দ্বীপে পা রাখার সাহস দেখান না স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউই। সরকারও ওই দ্বীপে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এর পিছনে কারণ জানলে শিউরে উঠবেন।
মাত্র ১০৬ একর জুড়ে বিস্তৃত পাথুরে, প্রত্যন্ত দ্বীপটি। আকারে ছোট হওয়া সত্ত্বেও, এর বাসিন্দাদের কারণে ভয়ে সেখানে কেউ বসবাস তো দূরের কথা, পা দিতে পর্যন্ত চান না। দ্বীপটিকে নিয়ে কয়েকটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন এক মত্স্যজীবী। খিদে পাওয়ায় খাবারের খোঁজে দ্বীপে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। পরদিন নাকি তাঁর রক্তাক্ত দেহ পাওয়া যায়।
এই ঘটনার পর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ও ত্রাসের সঞ্চার হয়। ওই দ্বীপে গেলে কেউ প্রাণ নিয়ে ফেরে না, এই ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে চেপে বসে তাঁদের মধ্যে। বিশ্বের সবচেয়ে ‘বিপজ্জনক’ দ্বীপগুলির একটি বলে তকমা জুড়ে গিয়েছে। কোন বাসিন্দাদের জন্য মানুষের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইলহা দ্য কুয়েইমাডা গ্র্যান্ডেতে।
এই দ্বীপটিতে ত্রাসের রাজত্ব চালায় নাগবংশ। অসংখ্য বিষাক্ত সাপের আস্তানা ব্রাজ়িলের এই প্রত্যন্ত দ্বীপটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বীপে প্রতি এক বর্গমিটারে গড়ে ১ থেকে ৫টি সাপ রয়েছে। এখানকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বাসিন্দা হল গোল্ডেন ল্যান্সহেড ভাইপার। এটি বিরল ও অত্যন্ত বিষাক্ত প্রজাতির সাপ। সে কারণে লোকমুখে দ্বীপটি স্নেক আইল্যান্ড নাম পরিচিতি লাভ করেছে।
গোল্ডেন ল্যান্সহেড সাপ লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বিষাক্ত সাপগুলির মধ্যে একটি। এই প্রজাতির সাপটি শুধুমাত্র স্নেক আইল্যান্ডেই পাওয়া যায়। এর কামড়ে মানুষ খুব দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে এর বিষ হৃদ্যন্ত্র বিকল করে দিতে পারে। বিষ ভূখণ্ডের ভাইপার গোত্রের আত্মীয়দের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী, বিশেষ করে পাখি শিকারের জন্য শরীরে এমন বিষ তৈরি করে গোল্ডেন ল্যান্সহেড।
এখানে এত বেশি বিষাক্ত সাপের বাস যে কেউ সেখানে যাওয়ার সাহস দেখান না। মৎস্যজীবী মারা যাওয়ার পর কয়েক জন প্রাণ বাজি রেখে সেখানে থাকার জন্য গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। প্রচলিত আছে যে, একসময় সেখানে একটি বাতিঘর ছিল এবং সেই বাতিঘরের কর্মচারী ও তাঁর পরিবারকে সাপের ছোবলে প্রাণ দিতে হয়। সেই ঘটনার পর থেকেই বাতিঘরটি পরিত্যক্ত হয়। দ্বীপটি মনুষ্যবর্জিত হয়ে পড়ে।
কোথা থেকে এল এই সাপ? এ নিয়েও কাহিনি আছে। শোনা যায়, জলদস্যুরা লুট করা সোনা এই দ্বীপে লুকিয়ে রাখত। কেউ যাতে সেগুলো হাতাতে না পারে সে জন্য কয়েকটি বিষাক্ত সাপ নিয়ে এসে দ্বীপে ছেড়ে দিয়েছিল তারাই। সেই সোনার লোভে বারে বারেই সেখানে হানা দিয়েছে মানুষ। কিন্তু শোনা যায়, তাঁরা কেউই ফেরেনি।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই দ্বীপে সাপের এত আধিক্য হওয়ার কারণ হল, হাজার বছর আগে এই দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে সরে আসে। বরফযুগের শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রায় ১১ হাজার বছর আগে ব্রাজিলের মূল ভূখণ্ড থেকে স্নেক আইল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে খাবারের টান পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে ও শিকার ধরতে সাপেরা নিজেদের বিষ আরও মারাত্মক ভাবে অভিযোজিত করে।
বিচ্ছিন্ন এবং জনবসতিহীন হওয়ায় এই সাপগুলি দ্বীপে খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে ফেলে। গোটা দ্বীপটাই দখল করে নেয় সাপেদের প্রজাতি। ৩,০০০ সোনালি ল্যান্সহেড ছাড়াও, দ্বীপটিতে পাখি, টিকটিকি এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যা বলতে গেলে হাতেগোনাই। পরিযায়ী পাখিরা এই দ্বীপে এলেই তা সাপের খাদ্যে পরিণত হয়।
ব্রাজ়িল সরকার বহু বছর আগেই এই দ্বীপে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। শুধুমাত্র সোনালি ল্যান্সহেড নিয়ে গবেষণার জন্য অনুমোদিত বিজ্ঞানীরাই সেখানে প্রবেশের সুযোগ পান। তা-ও কঠোর নিয়ম ও কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। কৌতূহলবশত কেউ এই দ্বীপে প্রবেশের চেষ্টা করলে, তা তাঁর জীবনের শেষ ভুল বলে গণ্য হতে পারে।
সোনালি ল্যান্সহেড সাপটিকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর। উজ্জ্বল ব্রোঞ্জের মতো রং, ত্রিভুজাকার মাথা ও আকর্ষণীয় চোখের মণি। সাপটিকে নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য প্রাণের মূল্য তুচ্ছ করতে পারেন সর্পপ্রেমীরা। এর বিষ এতটাই দামি যে তার লোভে প্রায়ই দ্বীপে হানা দেওয়ার চেষ্টা করে প্রাণী পাচারকারীর দল। হৃদরোগ এবং ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য বিষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।