প্রথমে শুল্কযুদ্ধ। তার পাল্টা বিরল খনিজের রফতানিতে তালা। সবশেষে সংঘাত থামাতে সমঝোতা। মার্কিন-চিন ‘ঠান্ডা লড়াই ২.০’কে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন দুনিয়ার দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, এতে বেজিঙের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়েছে ওয়াশিংটন। ফলে আগামী দিনে দু’তরফে আরও তীব্র হতে পারে সম্পর্কের টানাপড়েন। এর আঁচ থেকে বাঁচতে নয়াদিল্লির আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকের (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) বুসান শহরে চিনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় দু’ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার আলোচনার পর নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেন ‘প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ অর্থাৎ পোটাস। সেখানে তিনি লেখেন, বাণিজ্য নিয়ে কেটেছে জট। ফলে বিরল খনিজ পেতে আর কোনও সমস্যা হবে না।
‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ করা ট্রাম্পের পোস্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজ পাঠাতে রাজি হয়েছে চিন। বিনিময়ে বেজিংকে সয়াবিন সরবরাহ করবে আমেরিকা। তাঁর ওই ঘোষণার পর ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি অবশ্য সে ভাবে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেননি। দেশে ফিরে গোটা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আশ্বাস দেন তিনি। অন্য দিকে এই ইস্যুতে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সংবাদসংস্থা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’। তাদের দাবি, মান্দারিনভাষীদের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে ‘হেরেছেন’ পোটাস।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’ যা-ই লিখুক না কেন, শি-র সঙ্গে বৈঠক নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই জবাব দিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর যুক্তি, প্রত্যাশার চেয়েও নাকি ভাল ছিল ওই আলোচনা। অন্য দিকে মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, অতীতে যখনই কোনও দেশের সঙ্গে কথা বলেছেন পোটাস, তখনই সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রটির থেকে বিপুল লগ্নি ঘরের মাটিতে টানতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। একমাত্র চিনের ক্ষেত্রেই তা হয়নি। ফলে আগামী দিনে দু’তরফে ‘দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধ’র তীব্রতা বাড়বে বলেই মনে করছে তারা।
এ বছরের এপ্রিলে চিনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে নামেন ট্রাম্প। আমেরিকার বাজারে বেজিঙের পণ্যে ৫৪ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন তিনি। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে ড্রাগন সরকার তাঁর সঙ্গে সমঝোতায় আসবে বলে একরকম নিশ্চিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ফল হয় হিতে বিপরীত। উল্টে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রীর উপর সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করে মান্দারিনভাষীদের সরকার। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে দু’পক্ষই নিলামের মতো করে লাগাতার বাড়াতে থাকে শুল্কের অঙ্ক।
ট্রাম্প-শির এ-হেন ‘ঢিল মারলে পাটকেল’ নীতির জেরে দু’তরফেই বাড়ছিল বাণিজ্যিক লোকসান। ফলে ১২ মে এই প্রক্রিয়াকে ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন পোটাস। ওই সময় চিনা পণ্যে আমেরিকার শুল্কের মাত্রা ছিল ১৪২ শতাংশ। আর বেজিং চাপিয়েছিল ১৩৪ শতাংশ শুল্ক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট থামতেই সমাজমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে শুরু হয় ট্রোলিং। যদিও বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এ ব্যাপারে তাঁর সামনে খোলা ছিল না দ্বিতীয় কোনও রাস্তা।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, যুক্তরাষ্ট্রকে ঝোঁকাতে চিনের হাতে রয়েছে একটি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। আর সেটা হল বিরল খনিজ। এটা কোনও একটি ধাতু নয়। বিশ্বের মোট ১৭টি পদার্থকে এর আওতাভুক্ত করেছেন গবেষকেরা। যে কোনও ধরনের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম তৈরি করতে গেলে এই বিরল ধাতু আবশ্যিক। এ ছাড়া সামরিক, মহাকাশ গবেষণা এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্মাণেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বেজিংকে পৃথিবীর বিরল ধাতুর একচ্ছত্র অধিপতি বললে অত্যুক্তি হবে না।
বর্তমানে বিশ্বের ৬৯ শতাংশ বিরল ধাতু উত্তোলন করে থাকে চিন। খনি থেকে তোলার পর পরিশোধনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পদার্থগুলিকে বদলে ফেলা হয় বিশেষ ধরনের এক চুম্বকে। আর সেটাই হল বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের প্রাণভোমরা। বিরল ধাতুর এই পরিশোধন প্রক্রিয়ার ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ড্রাগনভূমিতে। আর তাই বৈদ্যুতিন সরঞ্জামে ব্যবহার হওয়া ১০টার মধ্যে ন’টা বিরল ধাতুর চুম্বক বেজিং থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছে দুনিয়া।
ড্রাগনের এই অমোঘ শক্তি ট্রাম্প যে আন্দাজ করতে পারেননি, এমনটা নয়। গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই বিরল ধাতুর খনির খোঁজ পেতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। এ ব্যাপারে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ‘ব্ল্যাকমেল’-এর চেষ্টা পর্যন্ত করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। ২০২২ সাল থেকে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ লড়ছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশ, যাদের হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করছে আমেরিকা।
কুর্সিতে বসেই গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর নামে জেলেনস্কিকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান ট্রাম্প। সেখানে প্রকাশ্যেই কিভের বিরল ধাতুর খনিগুলি আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সংশ্লিষ্ট খনি হাতে পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচাপ কমে যাবে, তা কিন্তু নয়। কারণ, মার্কিন মুলুকে নেই ওই পদার্থগুলির পরিশোধনের কোনও পরিকাঠামো। বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ একেবারেই পরিবেশবান্ধব নয়। তাই এত দিন এ ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে ছিল আমেরিকা।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ চিনের আবার অন্য একটি দুর্বলতা রয়েছে। ফি বছর বহুল পরিমাণে খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আমদানি করে ড্রাগন সরকার। এর বেশিটাই আসে আমেরিকা থেকে। আর তাই এপ্রিলে ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধ শুরু করতেই খাদ্যশস্য মজুতের সিদ্ধান্ত নেয় বেজিং। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য কেনা ধীরে ধীরে কমাতে থাকে তারা। এ ব্যাপারে বিকল্প হিসাবে ভিয়েতনাম, ব্রাজ়িল এবং আর্জেন্টিনা-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে মান্দারিনভাষীরা।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর দাবি, চিনের এ-হেন পদক্ষেপের জেরেও বিপাকে পড়েন ট্রাম্প। কারণ, তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টির গড় হিসাবে পরিচিত আমেরিকার রাজ্যগুলির বাসিন্দাদের একটা বড় অংশই হলেন কৃষিজীবী। বেজিং আমদানি হ্রাস করায় হু-হু করে কমতে থাকে তাঁদের মুনাফার অঙ্ক। ফলে সেখানে পাল্লা দিয়ে নিম্নমুখী হয় পোটাসের জনপ্রিয়তার সূচক। পরিস্থিতি সামলাতে মার্কিন চাষিদের ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
চিনের সঙ্গে ট্রাম্পের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্কের সূত্রপাতটা অবশ্য হয়েছিল ২০১৬ সালে। সে বছর হঠাৎ করেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র সাবেক ফরমোজ়া তথা তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দাবি করে আসছে বেজিং। একে সম্পূর্ণ ‘অন্যায্য’ এবং ‘অনৈতিক’ বলে তোপ দাগতেও ওই সময় ছাড়েননি পোটাস। এর পাশাপাশি বেজিঙের পণ্য নিয়েও একাধিক অভিযোগ তোলেন তিনি।
ট্রাম্পের দাবি, আমেরিকার বাজারে সস্তা দরে স্মার্টফোন-সহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি করছে চিন। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় যথেষ্ট ‘দৌরাত্ম্য’ রয়েছে তার। তাইওয়ানকে বাদ দিলে জাপানের একাধিক দ্বীপ এবং গোটা দক্ষিণ চিন সাগর নিজেদের এলাকার উপর ক্রমাগত দাবি করে চলেছে বেজিং। আর তাই ড্রাগন সরকারের বিরুদ্ধে হংকংয়ে বিক্ষোভ দানা বাঁধলেই, তাতে ইন্ধন দিতে পিছপা হননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
২০২০ সালে কোভিড অতিমারি শুরু হলে এর জন্য চিনকে পুরোপুরি ভাবে দায়ী করেন ট্রাম্প। ওই সময় প্রকাশ্যে আসে একাধিক মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট। তাতে ‘সর্বাধিক বিপদ’ বেজিঙের দিক থেকে আসতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। অতিমারির নেপথ্যে থাকা ‘করোনা’কে চিনা ভাইরাস বলে উল্লেখ করেন পোটাস। ফলে এটি কোনও জৈবিক অস্ত্র কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল।
কোভিডের সময় গোটা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছিল ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি হেরে গেলে ক্ষমতা আসেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জো বাইডেন। ট্রাম্প সরে যেতেই রহস্যজনক ভাবে কোভিড নিয়ে তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। ফলে তাঁকে ভোটে হারাতে পিছন থেকে বেজিং কলকাঠি নেড়েছিল বলে মনে করেন কূটনীতিকদের একাংশ। ২০২৫ সালে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে যার শোধ কড়ায় গণ্ডায় নিতে চাইছেন ট্রাম্প।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, বর্তমান অবস্থায় দু’টি কারণে চিনের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না তাঁর। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিরল খনিজের কোনও বিকল্প না থাকা। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার বিপুল ঋণের বোঝা, যেটা বাড়তে বাড়তে ২০৩৫ সালের মধ্যে ‘মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ১৪৩.৪ শতাংশে পৌঁছোবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)।
আর্থিক দিক থেকে বেকায়দায় পড়ায় দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতির অঙ্ক। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো দাম হ্রাস পেয়েছে ডলারেরও। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে মার্কিন মুদ্রাকে সরিয়ে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে চিন। এ ব্যাপারে রাশিয়া এবং ব্রাজ়িলের সমর্থন পেতে পারে বেজিং, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
মার্কিন গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই কারণেই শি-র সঙ্গে বৈঠকে বিপুল অঙ্কের কোনও বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করতে পারেননি ট্রাম্প। উল্টে বেজিঙের উপর শুল্কের মাত্রা ৪৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়েছে তাঁকে। আগামী দিনে এই সূচক আরও নামাতে ফের বিরল ধাতুর তাস খেলতে পারে ড্রাগন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
মার্কিন-চিন এই সংঘাতে আগামী দিনে দুনিয়ার দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তখন সুনির্দিষ্ট একটি জোটে ঢুকে পড়া ভারতের পক্ষে বেশ মুশকিল হবে। কারণ, দু’জনের কেউই নয়াদিল্লির কাছে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ফলে ভারসাম্য বজায় রেখে বিদেশনীতিকে কী ভাবে সাউথ ব্লক এগিয়ে নিয়ে যায়, সেটাই এখন দেখার।