Modi-Putin Summit

সাজসজ্জাই সার, হল না লড়াকু জেট, এয়ার ডিফেন্সের চুক্তি! পুতিনের ভারতসফর কি শুধুই পর্বতের মূষিকপ্রসব?

দু’দিনের ভারতসফর সেরে দেশে ফিরে গিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরও নয়াদিল্লি ও মস্কোর মধ্যে হয়নি কোনও প্রতিরক্ষা চুক্তি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:১৭
Share:
০১ ১৮

প্রোটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে উষ্ণ আলিঙ্গন। একই গাড়িতে সওয়ার হওয়া। গার্ড অফ অনার, রাষ্ট্রপতি ভবনে নৈশভোজ থেকে কাশ্মীরি জাফরান উপহার। দু’দিনের সফরে আসা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘খাতির-যত্ন’ নেহাত কম করেনি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিন্তু, তাতে লাভের গুড় কতটা হাতে পেল নয়াদিল্লি? তিনি দেশে ফিরতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। কারণ, পুতিন এলেও এ বার মস্কোর সঙ্গে বড় কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সারেনি ভারত।

০২ ১৮

গত ৫ ডিসেম্বর দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আলোচনা শেষে যৌথ ভাবে গণমাধ্যমের সামনে বিবৃতি দেন দুই রাষ্ট্রনেতা। শুধু তা-ই নয়, ওই সময়ে ১৬টি চুক্তিতে সই করেন দুই দেশের বিদেশমন্ত্রী। কিন্তু তার পরেও গোটা বিষয়টিকে অত্যন্ত সাদামাঠা বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল। কারণ, তাঁদের যুক্তি, সংশ্লিষ্ট সমঝোতাগুলিতে শক্তি প্রদর্শন করেনি মস্কো বা দিল্লি কোনও পক্ষই।

Advertisement
০৩ ১৮

দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, পুতিনের সফরে হওয়া ভারত-রুশ চুক্তিগুলি দু’দেশের সচিব-আমলা পর্যায়েই অনায়াসে সম্পন্ন করা যেতে পারত। চিন, আমেরিকা বা পশ্চিমি বিশ্বের উদ্দেশে যৌথ ভাবে কোনও বার্তা দেননি দুই রাষ্ট্রনেতা। ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) বেজিঙের ‘আগ্রাসী’ মনোভাব নিয়ে নয়াদিল্লির মাথাব্যথা থাকলেও সে ব্যাপারে মস্কোর নীরবতা মোদী সরকারের রক্তচাপ বাড়াল বলেই মনে করা হচ্ছে।

০৪ ১৮

বিদেশ মন্ত্রকের একাংশের মতে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নির্ণীত হয় পারস্পরিক স্বার্থ এবং শক্তির সমীকরণের উপরে ভিত্তি করে। পারস্পরিক সম্পর্কের উপরে নয়। নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটা গুরুত্ব থাকে। তবে সেটা স্বার্থের ভিত্তিতে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়নকেই বড় করে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্ট মহলের। এই একই ভুল করা হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে।

০৫ ১৮

পুতিন সফরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ভারত-রুশ প্রতিরক্ষা চুক্তি। তিনি এ দেশে আসার মুখে মস্কোর থেকে নয়াদিল্লি এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ, এস-৫০০ প্রমিথিউসের মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এবং পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির লড়াকু জেট এসইউ-৫৭ কিনতে চলেছে বলে খবর প্রকাশ করে একাধিক গণমাধ্যম। যদিও বাস্তবে সেই ধরনের কোনও সমঝোতা হয়নি। এর নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাপ’কেই দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা।

০৬ ১৮

হায়দরাবাদ হাউসে ২৩তম ভারত-রাশিয়া শীর্ষ বৈঠক শেষে অপরিশোধিত খনিজ তেল নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিন বলেন, ‘‘দিল্লিকে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে প্রস্তুত মস্কো। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করার লক্ষ্যে অনেক চুক্তি স্বাক্ষর করছি আমরা।’’

০৭ ১৮

যদিও ওই দিনই সন্ধ্যার সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী বুঝিয়ে দেন যে এটা কেবল কথার কথা। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সস্তায় পাওয়া সত্ত্বেও মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’র আমদানি অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে ভারত। রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কেনার জন্য এ দেশের পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফলে আমেরিকার বাজারে নয়াদিল্লির সামগ্রীর উপরে শুল্কের মাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ।

০৮ ১৮

ট্রাম্প অবশ্য গত কয়েক মাস ধরেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলতে চাইছেন। সেই নিয়ে কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে পুতিন আসার পর সামরিক চুক্তির বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আপাতত তা স্থগিত রাখা হয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হয়ে ফেলে ফের তা প্রকাশ্যে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

০৯ ১৮

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, পুতিনের সঙ্গে মোদীর আলোচনায় চিন নিয়ে সাউথ ব্লকের শিরঃপীড়ার কথাও সে ভাবে জানাতে পারেনি নয়াদিল্লি। ফলে বেজিং-কাঁটা নিয়ে বর্তমান ভূকৌশলগত পরিস্থিতিতে রাশিয়া যে ভারতের পাশে দাঁড়াবে না, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময়ও মস্কোর থেকে সাহায্য বা সমর্থন পায়নি নয়াদিল্লি। এখন যে ক্রেমলিনের বাধ্যবাধকতা আরও বেশি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

১০ ১৮

বিশ্লেষকদের দাবি, গত পৌনে চার বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞার নাগপাশে আবদ্ধ রাশিয়াকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে চিনের উপর বেড়েছে মস্কোর নির্ভরশীলতা। এটি ভারতের জন্য একেবারেই সুখবর নয়।

১১ ১৮

কিন্তু, তার পরেও পুতিনের সফরকে পুরোপুরি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে নারাজ কূটনৈতিক মহল। তাঁদের দাবি, ভারতের সঙ্গে অস্ত্রচুক্তির মতো সংবেদনশীল ব্যাপার নিয়ে অতীতেও খুব বেশি ঢাক পেটায়নি রাশিয়া। কিন্তু, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ‘বন্ধু’র কর্তব্য পালন করে ঠিক হাতিয়ার সরবরাহ করে গিয়েছে মস্কো। আগামী দিনে সেই দৃশ্য ফের দেখা যাবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন তাঁরা।

১২ ১৮

এ বারের ভারতসফরে পুতিনের সঙ্গে ছিলেন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত মধ্যস্থতাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত রুশ সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’-এর এক শীর্ষকর্তা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন তিনি। সূত্রের খবর, সেখানে একাধিক হাতিয়ারের যৌথ উৎপাদনের ব্যাপারে দু’তরফে আলোচনা হয়েছে। তবে ইচ্ছাকৃত ভাবেই এ ব্যাপারে তেমন উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে না নয়াদিল্লি ও মস্কো।

১৩ ১৮

সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-রুশ প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে ‘কাউন্টারিং আমেরিকাজ় অ্যাডভারসারিস থ্রু স্যাংসনস অ্যাক্ট’ বা কাটসা নিষেধাজ্ঞা চাপাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু পুতিনের সফর নিয়ে তেমন কোনও আপত্তি জানায়নি ওয়াশিংটন। সে দিক থেকে কূটনৈতিক ভাবে মোদী সরকারের লাভ হয়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা।

১৪ ১৮

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, এসইউ-৫৭ লড়াকু জেট হোক বা এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কেনা বা যৌথ উৎপাদন সংক্রান্ত আলোচনা বন্ধ করেনি নয়াদিল্লি ও মস্কো। এত দিন পর্যন্ত রুশ হাতিয়ারের দাম ডলারে মেটাচ্ছিল ভারত। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে সেটা আর সম্ভব নয়। ফলে চুক্তির সময় সেই দিকেও নজর দিতে হচ্ছে দু’পক্ষকে। ফলে আগের মতো দ্রুত সমঝোতায় আসা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

১৫ ১৮

আগামী কয়েক বছরে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। এর জন্য প্রয়োজন ছোট আকারের মডিউলার রিয়্যাক্টর। সেখানে লগ্নি করার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী রাশিয়া। পুতিনের সফরে সে ব্যাপারে কথাবার্তা বেশ কিছু দূর এগিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর।

১৬ ১৮

গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৬,৮৬৯ কোটি ডলারে পৌঁছোয়। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৪৮৮ কোটি ডলারের পণ্য মস্কোকে সরবরাহ করেছিল নয়াদিল্লি। বাকি ৬,৩৮১ কোটি ডলারের সামগ্রী পূর্ব ইউরোপের দেশটির থেকে ঘরে তোলে কেন্দ্রের মোদী সরকার। অর্থাৎ, গত অর্থবর্ষে দুই ‘বন্ধু’র বাণিজ্যিক ঘাটতি ছিল ৫,৮৯৩ কোটি ডলার। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে এই অঙ্ক ছিল ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা।

১৭ ১৮

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি কী ভাবে মেটানো যাবে, তা নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কথা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সূত্রের খবর, অচিরেই মস্কো নিয়ন্ত্রিত ‘ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন’ বা ইএইইউ-র সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলবে ভারত। সংশ্লিষ্ট সংগঠনে মোট পাঁচটি দেশ রয়েছে। রাশিয়া ছাড়া এর অন্য সদস্যরা হল আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজ়াখস্তান এবং কিরঘিজ়স্তান। সংশ্লিষ্ট সমঝোতা হয়ে গেলে এগুলির বাজারে ‘মেগা এন্ট্রি’ নিতে পারবে দিল্লি।

১৮ ১৮

দীর্ঘ দিন ধরেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। আর তাই রুপি-রুবল বাণিজ্যকে সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে বৈঠকের পর মস্কোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রার কথা ঘোষণা করছেন মোদী। ফলে ভারতীয় পণ্যের জন্য ক্রেমলিন তার অভ্যন্তরীণ বাজার এ বার খুলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে দিক থেকেও পুতিনের সফর স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement