কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) এবং মেশিন লার্নিংয়ের হাত ধরে ‘দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব’! দুনিয়া জুড়ে বদলে যাচ্ছে পণ্য উৎপাদনের পদ্ধতি। সেই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই কারাখানার ভিতরেই ছোট আকারের পরমাণু তড়িৎ চুল্লি নির্মাণের রাস্তায় হাঁটছে ভারত। সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় সাফল্য এলে রাশিয়া এবং চিনের পাশাপাশি একসারিতে যে নয়াদিল্লির নাম উঠে আসবে তা বলাই বাহুল্য।
ছোট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার পোশাকি নাম স্মল মডুলার রিঅ্যাক্টর (এসএমআর)। মূল ভূখণ্ড থেকে দূরবর্তী কোনও দ্বীপ হোক বা এআই প্রযুক্তির জন্য তৈরি তথ্যকেন্দ্র (ডেটা সেন্টার)— নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট এসএমআরের। সাধারণত ৩০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা থাকে এগুলির। বর্তমানে স্মল মডিউলার রিঅ্যাক্টর তৈরির মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি।
গত কয়েক বছরে একের পর এক এসএমআর তৈরি করে সবাইকে চমকে দেয় চিন। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এগুলির কাঁধে ভর করেই পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের এক নম্বর স্থানে পৌঁছে গিয়েছে বেজিং। অন্য দিকে ভারতে ছোট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছুক রাশিয়া। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন মস্কোর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসাটম’-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রকল্প পরিচালক আলেকজ়ান্ডার ভলগিন। তবে নয়াদিল্লি তাদের সঙ্গে কোনও চুক্তি করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে ভলগিন বলেন, ‘‘ভারতকে এসএমআরের প্রযুক্তি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। উৎপাদন ক্ষেত্রে এটা বিপ্লব আনতে পারে। প্রচলিত পরমাণু কেন্দ্রগুলির চেয়ে অনেক কম জায়গায় এগুলিকে তৈরি করা যায়। আবার প্রয়োজনে এসএমআরকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ারও সুবিধা রয়েছে।’’
দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর কুদানকুলামে রয়েছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায় ২,৬০০ একর জমিতে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। ভলগিন জানিয়েছেন, এসএমআরের ক্ষেত্রে এ-হেন বিপুল জমির কোনও প্রয়োজন নেই। মাত্র ৪০ থেকে ৪২ একর জায়গায় একে তৈরি করা সম্ভব। স্মল মডুলার রিঅ্যাক্টরে থাকে একাধিক ইউনিট। এর মধ্যে পাম্প, স্টিম জেনারেটর এবং আণবিক জ্বালানির কেন্দ্র উল্লেখযোগ্য।
রুশ এসএমআরগুলি ৫৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। পাশাপাশি, ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত তাপ সরবরাহের ক্ষমতা রয়েছে এগুলির। স্মল মডুলার রিঅ্যাক্টর চালাতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ইউরেনিয়ামের ২০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধিকরণের প্রয়োজন পড়ে। প্রচলিত আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির তুলনায় তা অনেকটাই বেশি। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মতো বিপদের আশঙ্কা এসএমআরে নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন ভলগিন।
এসএমআরের দ্বিতীয় সুবিধা হল এটিকে ট্রেনে পরিবহণ করার সুবিধা রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা, যেখানে শুধুমাত্র ডিজ়েল গাড়ি ব্যবহার হয়, সেখানেও একে অনায়াসেই নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ইয়াকুটিয়া এলাকার জন্য ইতিমধ্যেই একটি স্থলভিত্তিক এসএমআর নির্মাণ করেছে রাশিয়া। পাশাপাশি, এই ধরনের ছ’টি ছোট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি সেরেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য থাকা উজ়বেকিস্তান।
রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসাটম’-এর পদস্থ কর্তা ভলগিন বলেছেন, ‘‘বর্তমানে অনেক দেশই নিজস্ব এসএমআর তৈরি করছে। সেই তালিকায় আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও চিন। বেজিং পরীক্ষামূলক ভাবে একটি স্থলভিত্তিক ১০০ ইউনিটের স্মল মডুলার রিঅ্যাক্টর চালু করেছে। এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মনে রাখতে হবে বিশ্বে এই প্রযুক্তি প্রথম বার আনে মস্কো।’’ ৯। ভলগিনের দাবি, ১৯৫০ সাল থেকে ছোট আকারের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার করে আসছে রাশিয়া। পরবর্তীকালে আরআইটিএম-২০০০ নামের একটি আণবিক চুল্লি তৈরি করে মস্কোর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসাটম’। এসএমআরের সংজ্ঞাকেই এটা পাল্টে দিয়েছিল বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ভলগিনের দাবি, ১৯৫০ সাল থেকে ছোট আকারের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার করে আসছে রাশিয়া। পরবর্তীকালে আরআইটিএম-২০০০ নামের একটি আণবিক চুল্লি তৈরি করে মস্কোর রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসাটম’। এসএমআরের সংজ্ঞাকেই এটা পাল্টে দিয়েছিল বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে ‘নেট-জিরো মিশন’ চালু করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে ২০৭০ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির অংশ হিসাবে ছোট আকারের পরমাণু কেন্দ্র তৈরিতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে মুম্বইয়ের ‘ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার’ বা বার্ক। এর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ১০০ গিগাওয়াট। এই প্রকল্পের অংশিদারী পাওয়ার ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ রয়েছে রাশিয়ার।
কেন্দ্র অবশ্য স্মল মডুলার রিঅ্যাক্টর নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘আত্মনির্ভরতা’র রাস্তায় হাঁটতে আগ্রহী। অর্থাৎ এই প্রযুক্তির সবটাই দেশের মানুষকে বার্কের গবেষকেরা উপহার দিক, চাইছে মোদী সরকার। কিন্তু, তার পরেও হাল ছাড়তে নারাজ ‘রোসাটম’। ভাসমান এবং স্থির সব ধরনের ছোট আণবিক চুল্লি সরবরাহ করতে তারা প্রস্তুত, ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে ওই রুশ সংস্থা।
এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ভলগিন বলেন, ‘‘বার্কের আমন্ত্রণ পেলে অবশ্যই তাদের প্রকল্পে আমরা অংশগ্রহণ করব। এসএমআর নিয়ে ভারত সরকার এবং তাদের পরমাণু শক্তি বিভাগের সঙ্গে আমরা নিবিড় ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছি। আমাদের মধ্যে একাধিকবার এ বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনাও হয়েছে।’’
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দরজা বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য খুলে দেয় কেন্দ্র। ফলে ‘রোসাটম’-এর সামনে খুলে গিয়েছে বিপুল লগ্নির সুযোগ। নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড (এনপিসিআইএল) এবং ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে নিবিড় ভাবে যোগাযোগ রেখে চলছে তারা, খবর সূত্রের।
ছোট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রে একটি ব্যাপারে ‘রোসাটম’-এর খুবই সুখ্যাতি রয়েছে। রুশ আইসব্রেকারগুলির জন্য ৪০০-র বেশি এসএমআর তৈরি করেছে তারা। কিন্তু কোনও দিন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মতো দুর্ঘটনার মুখে পড়েনি সেগুলি। ফলে নিরাপত্তার নিরিখে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে পেরেছে মস্কোর এই সংস্থা।
সূত্রের খবর, একটি ছোট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র টানা পাঁচ থেকে ছ’বছর তড়িৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। এর পর ফের বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে এতে দিতে হবে ইউরেনিয়াম। বৃহৎ আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় এসএমআরে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেশি। তবে কম মূলধনে এগুলির নির্মাণ সম্ভব, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ছোট পরমাণু তড়িৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎকে সবুজ শক্তি বলা যেতে পারে। এটি যথেষ্টই পরিবেশবান্ধব। নয়াদিল্লির পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ১০০ গিগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ওই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোনোর ক্ষেত্রে এসএমআর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। সেখানে ছোট পরমাণু চুল্লির প্রসঙ্গ উঠতে পারে বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে মুখ খোলেনি নয়াদিল্লি ও মস্কো।