কথায় আছে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে’। কিন্তু, তাই বলে ভারতীয় বায়ুসেনার লড়াকু জেট! ৬০ বছরের বেশি কর্মজীবন শেষ হতে না হতেই চাকরিতে ‘পুনর্বহাল’ হতে চলেছে তারা। যদিও সেটা নব রূপে এবং নতুন আঙ্গিকে। ফলে বুড়ো হাড়ে সদ্য অবসর নেওয়া যুদ্ধবিমানগুলি যে ফের ভেল্কি দেখাবে, তা বলাই বাহুল্য। বিমানবাহিনীর এ-হেন সিদ্ধান্তে ঘুম ছুটেছে চিন এবং পাকিস্তানের মতো শত্রু দেশগুলির।
‘মিগ-২১ বাইসন’। একটা সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি এই লড়াকু জেটগুলিই ছিল ভারতীয় বায়ুসেনার শিরদাঁড়া। কিন্তু, ছ’দশকের বেশি দাপিয়ে চাকরি করার পর এ বার সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলিকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ দেশের বিমানবাহিনী। পাশাপাশি, লড়াকু জেটগুলিকে ড্রোনে বদলে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে। অর্থাৎ, কর্মজীবন শেষ হলেও এখনই ছুটি হচ্ছে না ‘মিগ-২১ বাইসন’-এর।
চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসর নেবে সাবেক সোভিয়েত জমানার এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। ওই দিন চণ্ডীগড় ছাউনিতে ‘মিগ-২১ বাইসন’কে বিশেষ সংবর্ধনা দেবে ভারতীয় বায়ুসেনা। তার পরেই সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটগুলি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে লেগে পড়বেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সেই প্রকল্পে বিমানবাহিনীর একাধিক আধিকারিকের থাকার কথা রয়েছে। সূত্রের খবর, অবসরপ্রাপ্ত ‘মিগ-২১’কে দু’-তিন ধরনের মানববিহীন উড়ুক্কু যানে বদলে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
সেই তালিকায় প্রথমেই থাকছে ‘টার্গেট’ ড্রোন। উচ্চ গতির ওই উড়ুক্কু যানকে মূলত যুদ্ধাভ্যাসের জন্য ব্যবহার করতে পারবে বায়ুসেনা। লড়াকু জেটের পাইলটদের মহড়ায় প্রায়ই এই ধরনের ড্রোনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। এগুলিকে শত্রুর যুদ্ধবিমান হিসাবে গণ্য করে লড়াইয়ের অনুশীলন করে থাকেন তাঁরা। এ ছাড়া লড়াকু জেটের ‘আকাশ থেকে আকাশ’ (পড়ুন এয়ার টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্যেও এটি ব্যবহার হতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত ‘মিগ-২১ বাইসন’কে টার্গেট ড্রোনে বদলে ফেলার ভাবনার নেপথ্যে রয়েছে দু’টি কারণ। প্রথমত, সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির গতি। ছ’দশকের বেশি কর্মজীবন পার করেও শব্দের দু’গুণ গতিতে (পড়ুন দুই ম্যাক) ছুটতে পারে সাবেক সোভিয়েত জমানার ওই লড়াকু জেট। দ্বিতীয়ত, মাঝ-আকাশে ডিগবাজি খাওয়ার ক্ষমতা। সেটা এখনও অন্যান্য যুদ্ধবিমানের কাছে ঈর্ষণীয়। আর তাই দক্ষ যোদ্ধা পাইলট তৈরি করতে একে ‘টার্গেট’ ড্রোনে বদলে ফেলতে চাইছে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে আসবে ‘ছদ্ম’ ড্রোন। আধুনিক লড়াইয়েই শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে আক্রমণ শানাতে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুসেনা। ইলেকট্রনিক যুদ্ধে ‘ছদ্ম’ ড্রোনের জুড়ি মেলা ভার। এর মূল কাজ হল ভুল তথ্য পাঠিয়ে বিপক্ষের রেডারকে বিভ্রান্ত করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে এই কৌশলে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে অকেজো করতে সক্ষম হয়েছেন আকাশযোদ্ধারা।
গত মে মাসে হওয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে চলা ‘যুদ্ধে’ এই ‘ছদ্ম’ ড্রোনের বহুল ব্যবহার করেছে নয়াদিল্লি। সেগুলির কোনওটি তৈরি করেছে দেশীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্ট ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন), কোনওটা আবার সম্পূর্ণ বিদেশি। ‘মিগ-২১ বাইসন’কে ওই শ্রেণির ড্রোনে বদলে ফেললে ইলেকট্রনিক যুদ্ধে ভারত যে কয়েক গুণ এগিয়ে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ছাড়া নজরদারি এবং আত্মঘাতী ‘কামিকাজ়ে’ ড্রোনে ‘মিগ-২১ বাইসন’কে বদলে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার। শেষেরটির ক্ষেত্রে শত্রু দেশে অনেকটা বিস্ফোরক নিয়ে হামলা করার সক্ষমতা পাবে বিমানবাহিনী। যুদ্ধের সময় শত্রুর গোলা-বারুদের ডিপো উড়িয়ে দিতে এগুলি ব্যবহার করতে পারে তারা। ‘মিগ-২১ বাইসন’কে তাই কামিকাজ়ে ড্রোনে বদলে ফেলার পরিকল্পনাকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
অবসরপ্রাপ্ত যুদ্ধবিমানকে ড্রোনে বদলে ফেলার চিন্তাভাবনা ভারতই যে প্রথম করেছে এমনটা নয়। ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে ইজ়রায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক বছর আগে ‘এফ-৪ ফ্যান্টম্স’ লড়াকু জেটকে ড্রোনে বদলে দিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেন ইহুদি প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। অন্য দিকে, কর্মজীবন শেষে ‘কিউএফ-১৬’কে টার্গেট ড্রোনে বদলে ফেলার নজির রেখেছে আমেরিকা।
‘মিগ-২১ বাইসন’কে ড্রোনে বদলে ফেলার ব্যাপারে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার। প্রথমত, দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহারের ফলে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির যাবতীয় তথ্য রয়েছে বিমানবাহিনীর হাতে। অন্য দিকে, গত কয়েক বছরে মানববিহীন সামরিক উড়ুক্কু যান তৈরিতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে এ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি একাধিক সংস্থা। ফলে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা একেবারেই কঠিন নয়।
সূত্রের খবর, অবসরের পর ‘মিগ-২১ বাইসন’গুলিকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবেন ডিআরডিও-র গবেষকেরা। এর পর কোনগুলিকে টার্গেট এবং কোনগুলিকে ছদ্ম বা কামিকাজ়ে ড্রোনে বদলে ফেলা যায়, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। পরে এর রূপান্তকরণের কাজ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হিন্দুস্থান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যালের ওয়ার্কশপে হবে বলে জানা গিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে নামমাত্র খরচ করে একগুচ্ছ শক্তিশালী ড্রোন হাতে পাবে ভারতীয় বায়ুসেনা। কারণ, এ ক্ষেত্রে সামরিক উড়ুক্কু যানের কাঠামো তৈরি করতে হবে না ডিআরডিও বা হ্যালকে। শুধুমাত্র বদলাতে হবে এর ভিতরের কলকব্জা। সেই জায়গায় বসবে ড্রোন প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যন্ত্রাংশ।
তবে ‘মিগ-২১ বাইসন’কে রাতারাতি ড্রোনে বদলে ফেলা একেবারেই সহজ নয়। দুর্ঘটনার লম্বা ইতিহাস রয়েছে এর। গত ছ’দশকে মহড়ার সময় এই যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে অন্তত ১৭০ জন বায়ুসেনা পাইলটের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া প্রাণ হারিয়েছেন ৪০-এর বেশি সাধারণ মানুষ। আর তাই একটা সময়ে গণমাধ্যমে ‘মিগ-২১ বাইসন’-এর নাম হয়ে যায় ‘উড়ন্ত কফিন’।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের হাতে বাজে ভাবে পরাজিত হওয়ার পর বায়ুসেনাকে নতুন ভাবে সাজানোর পরিকল্পনা করে কেন্দ্র। ঠিক তার পরের বছরই (পড়ুন ১৯৬৩) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি আমদানি করে ভারত। এর প্রথম সংস্করণটির নাম ছিল ‘মিগ-২১ এলএফ’।
১৯৫৫ সালে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির নকশা তৈরি করেন তৎকালীন সোভিয়েত প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। এর নির্মাণকারী সংস্থা হল মিকোয়ান-গুরেভিচ (সংক্ষেপে মিগ) অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন। মস্কোর থেকে মোট ৮৭৪টি মিগ-২১ কেনে ভারত, যার মধ্যে ক্রেমলিনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় ৬৫৭টি ঘরের মাটিতেই তৈরি করে হ্যাল।
২০০০ সালে ‘মিগ-২১’-এর আধুনিকীকরণ করে ভারত। ডিআরডিও এবং হ্যালের সহায়তায় তৈরি হয় ‘বাইসন’ মডেল। বর্তমানে তার ১.৫ স্কোয়াড্রন কর্মরত রয়েছে। রাজস্থানের বিকানেরের নাল বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সেগুলিকে মোতায়েন রেখেছে বিমানবাহিনী। সংশ্লিষ্ট স্কোয়াড্রনের পোশাকি নাম ‘প্যান্থার্স’। এতে মোট ৩৫টি জেট রয়েছে, যার সবগুলি সেপ্টেম্বরে অবসরে যেতে চলেছে।
১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বড় ভূমিকা নেয় ‘মিগ-২১ বাইসন’। তবে বিশ্লেষকদের কথায়, রুশ জেটটি সর্বাধিক সাফল্য পেয়েছে ২০১৯ সালে। সে বার এর সাহায্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পাক বিমানবাহিনীর একটি ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় ভারতীয় বায়ুসেনা। ‘মিগ-২১ বাইসন’-এর ককপিটে ছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান।
ধারে ও ভারে আমেরিকার ‘এফ-১৬’ অনেক উন্নত যুদ্ধবিমান। ‘মিগ-২১’-এর মতো বুড়ো লড়াকু জেটের সাহায্যে তাকে ধ্বংস করার ঘটনাকে তাই ‘অবিশ্বাস্য’ বলে উল্লেখ করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। অবসরের পর সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলি ড্রোনে বদলে নিয়ে ফের পাক জেট শিকারে তাদের নামাবে ভারতীয় বায়ুসেনা? এর জবাব দেবে সময়।