আগামী ১৩ বছরের মধ্যেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠতে পারে ভারত। এ বার সেই পূর্বাভাস দিল সমীক্ষক সংস্থা ‘ইওয়াই ইকোনমিক ওয়াচ’। তাদের রিপোর্টে এখানকার প্রশাসনিক কাঠামোগত সংস্কার এবং বিপুল জনসংখ্যার সুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য দিকে, তালিকায় এক নম্বর স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গদি টলমল হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের অগস্টে বিশ্ব অর্থনীতির গতি নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘ইওয়াই ইকোনমিক ওয়াচ’। সেখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ২০.৭ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে যাবে ভারত। আর ২০৩৮ সালের মধ্যে সেটা আরও বেড়ে পৌঁছোবে ৩৪.২ লক্ষ কোটি ডলারে। তাদের এই পূর্বাভাসের পর দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই। বর্তমানে আর্থিক শক্তির তালিকায় চার নম্বরে রয়েছে নয়াদিল্লির নাম।
ভারতীয় অর্থনীতির এ-হেন উত্থানের নেপথ্যে একাধিক যুক্তি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা। তাদের দাবি, বর্তমানে এ দেশের জনগণের গড় বয়স ২৮.৮ বছরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় আমজনতার আর্থিক সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি করছেন তাঁরা, যা দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সূচককে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে সাহায্য করছে।
দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছরে সরকারি ঋণ এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) অনুপাত বেশ অনেকটাই কমেছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) এই সূচক দাঁড়িয়েছিল ৮১.৩ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সেটা ৭৫.৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে ‘ইওয়াই ইকোনমিক’। এর জেরে আর্থিক শক্তির নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশে পরিণত হওয়া ভারতের পক্ষে সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
‘অগস্ট-২০২৫’ শীর্ষক আর্থিক রিপোর্টে ‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার’ বা আইএমএফ-কে (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) উদ্ধৃত করেছে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২৮-’৩০ সালের মধ্যে ভারত ও আমেরিকার আর্থিক বৃদ্ধির হার যদি ৬.৫ এবং ২.১ শতাংশে স্থির থাকে, তা হলে ২০৩৮ সালের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাবে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, পিপিপি-র (পড়ুন পারচেজ়িং পাওয়ার প্যারিটি) দিক দিয়ে একে উঠে আসবে ভারত।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন ‘ইওয়াই ইকোনমিক ওয়াচ’-এর মুখ্য নীতি উপদেষ্টা (চিফ পলিসি অ্যাডভাইসর) ডিকে শ্রীবাস্তব। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও তরুণ ও দক্ষ শ্রমিক, শক্তিশালী সঞ্চয় ও বিনিয়োগ এবং ঋণের অঙ্ক কমানোর মাধ্যমে বৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে ভারত। আর্থিক দিক থেকে এ দেশে স্থিতিশীলতা রয়েছে।’’ এর জন্য কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রশংসাও করেছেন তিনি।
শ্রীবাস্তব মনে করেন, ২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’-এর স্বপ্নপূরণ করতে পারবে কেন্দ্র। সেই লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হল চিন। পিপিপির দিক দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বেজিঙের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪২.২ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও মান্দারিনভাষীদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে একাধিক বাধার কথা বলেছেন ‘ইওয়াই ইকোনমিক’-এর শীর্ষকর্তা।
সমীক্ষকদের যুক্তি, বর্তমানে মূলত দু’টি জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে চিনা অর্থনীতি। প্রথমত, ড্রাগনভূমির আমজনতার গড় বয়স ভারতের চেয়ে অনেকটাই বেশি। দ্বিতীয়ত, গত কয়েক বছরে বেজিঙের ঋণের মাত্রা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অঙ্ক বাড়তে বাড়তে জিডিপির ১২০ শতাংশ পেরিয়ে গিয়েছে, যার ফলে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিতে ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’ বা জিএসটি (গুড্স অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) এবং ‘ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ বা ইউপিআই চালু করার মতো সিদ্ধান্তকে মাস্টারস্ট্রোক বলে উল্লেখ করেছে সংশ্লিষ্ট সমীক্ষক সংস্থা। এ ছাড়া মোদী সরকারের ‘উৎপাদন সংযুক্ত উৎসাহ ভাতা’ বা পিএলআই (প্রোডাকশান লিঙ্কড ইনটেনসিভ) প্রকল্প শিল্পের অগ্রগতিতে যে সাহায্য করেছে, তা বলাই বাহুল্য।
পাশাপাশি, ঋণের অঙ্ক হ্রাস করতে ‘ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্সি কোড’ আইন এনেছে কেন্দ্র। সমীক্ষকদের অনুমান, ২০২৮ সালের মধ্যে বিনিয়োগের নিরিখে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে ভারত। ওই সময় জার্মানিকে পিছনে ফেলবে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে, আগামী দিনে বার্লিনের আর্থিক বৃদ্ধির গতি শ্লথ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চলতি বছরের ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নেওয়া শুরু করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, নয়াদিল্লিকে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার এই শুল্কনীতির প্রভাবে এ দেশের অর্থনীতি টালমাটাল হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মার্কিন শুল্কবাণ ভারতের জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশকে প্রভাবিত করতে পারে। সে ক্ষেত্রে খুব খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হলে বৃদ্ধির সূচক হ্রাস পাবে মাত্র ০.১ শতাংশ। কারণ, ইতিমধ্যেই বিকল্প বাজারের খোঁজ শুরু করে দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি, বিপুল জনসংখ্যার কারণে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা রয়েছে, যা এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে কেন্দ্র করে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে শীতলতার মধ্যেই ব্রিটেনের সঙ্গে ‘মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি’ বা এফটিএ (ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) সেরে নিয়েছে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, খুব দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে একই ধরনের সমঝোতা হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটিতে ফ্রান্স এবং জার্মানি-সহ রয়েছে মোটে ২৭টি ইউরোপীয় দেশ।
এ ছাড়া শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের বাড়াবাড়ির কারণেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে কানাডা, ব্রাজ়িল এবং আফ্রিকার একাধিক দেশ। পাশাপাশি, বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে দু’টি ‘মেগা অফার’ দিয়েছে রাশিয়া। যাবতীয় সীমান্ত সংঘাত ভুলে ‘বন্ধুত্ব’-র হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চিনও।
গত ২০ অগস্ট ভারতে কর্মরত রুশ উপ-বাণিজ্য প্রতিনিধি এভজ়েনি গ্রিভা বলেন, ‘‘মস্কোর অপরিশোধিত খনিজ তেল ‘উরাল ক্রুড’ কেনার ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে পাঁচ শতাংশ ছাড় পাবে নয়াদিল্লি। এ দেশের যে সমস্ত সংস্থা তেল কিনছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারটা ঠিক করবে আমাদের কোম্পানি।’’
ট্রাম্প প্রশাসন ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোয় আমেরিকার বাজারে ভারতীয় পণ্য বিক্রি করা কঠিন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। মস্কো অবশ্য জানিয়েছে, এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির চিন্তা করার কিছু নেই। এখানকার সামগ্রীর জন্য ঘরোয়া বাজার খুলে দেবে ক্রেমলিন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে বিবৃতি দেন রুশ ডেপুটি চিফ অফ মিশন রোমান বাবুশকিন।
৩১ অগস্ট ড্রাগনভূমির বন্দর শহর তিয়ানজ়িনে বসবে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন) সদস্য দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠক। সেখানে যোগ দিতে সাত বছর পর চিন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সূত্রের খবর, তাঁকে মেগা অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বেজিং। মার্কিন শুল্কযুদ্ধের আবহে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে যোগ দেবেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও।
এসসিওর বৈঠকে মধ্য, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মিলিয়ে মোট ২০ জনের বেশি রাষ্ট্রপ্রধানের পা পড়ার কথা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে মাত্র দু’জনকে ব্যক্তিগত ভাবে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাবেন স্বয়ং চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বা সিসিপির চেয়ারম্যান তথা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তাঁরা হলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক স্তরে এর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ‘চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্ট’ নামের গবেষণা সংস্থার মুখ্য সম্পাদক এরি ওল্যান্ডার। তাঁর কথায়, ‘‘এ বারের এসসিও সম্মেলনকে মার্কিন-বিরোধী শক্তিশালী জোট হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন শি। সেই লক্ষ্যে রাশিয়া, ভারত এবং ইরানকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে তাঁর প্রশাসন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এ বারের এসসিও বৈঠকে ‘রুশ ভারত চিন ত্রিশক্তি’ বা রিক ট্রয়িকার (রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ট্রয়িকা) পুনরুজ্জীবনের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, মোদী ও শি-র মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠককে কেন্দ্র করেও পারদ চড়তে শুরু করেছে। ফলে সেখানে সীমান্ত সংঘাত মেটানোর পাশাপাশি দু’তরফে একাধিক বাণিজ্যিক সমঝোতার সম্ভাবনা থাকছে। এতেও নয়াদিল্লির অর্থনীতির সূচক যে ঊর্ধ্বমুখী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।