ISRO’s Satellite Navigation

দম প্রায় শেষ বুড়ো পরমাণু ঘড়ির, মহাশূন্যে মৃত্যুমুখে মারণাস্ত্রের নিশানা বেঁধে দেওয়া ‘দেশি জিপিএস’

আমেরিকার জিপিএস, রাশিয়ার গ্লোনাস, চিনের বাইডো এবং ইইউর গ্যালিলিওর মতো ভারতেরও রয়েছে নিজস্ব দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থা ‘নেভিক’। বর্তমানে এর ১১টি কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্যে কাজ করছে মাত্র চারটি। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছে দেশের নিরাপত্তা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৫ ১৬:২৪
Share:
০১ ২০

দিন দিন কমছে কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যা। ফলে মহাকাশভিত্তিক দিকনির্ণয় নিয়ে ঘোর সঙ্কটে ভারত! এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সেনার পক্ষে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে শত্রুকে নিশানা করা হবে দুষ্কর। বিষয়টি নজরে আসায় সংসদে এই নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। জবাবে ক’দিনের মধ্যে দিক নির্ণয়কারী কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানো হবে বলে স্পষ্ট করেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। যদিও এতে দ্রুত উদ্বেগ যে কাটতে চলেছে, এমনটা নয়।

০২ ২০

আমেরিকার জিপিএস (গ্লোবাল পজ়িশনিং সিস্টেম), রাশিয়ার গ্লোনাস (গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম), চিনের বেইডো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) গ্যালিলিওর মতো ভারতেরও রয়েছে নিজস্ব মহাকাশভিত্তিক দিকনির্ণয়কারী ব্যবস্থা। নাম, ‘নেভিগেশন উইথ ইন্ডিয়া কনস্টেলেশন’ বা নেভিক। এই কৌশলগত ব্যবস্থাটিকে ব্যবহার করে নিখুঁত নিশানায় বিভিন্ন হাতিয়ার ছুড়তে পারে সেনা। পাশাপাশি, শত্রুর অবস্থান বুঝতেও নেভিকের উপরেই ভরসা করে সেনা।

Advertisement
০৩ ২০

নেভিকের কৃত্রিম উপগ্রহগুলির নির্মাণ, উৎক্ষেপণ, নিয়ন্ত্রণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব রয়েছে দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন) কাঁধে। সম্প্রতি মহাকাশভিত্তিক এই দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থাটিকে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনে কেন্দ্র। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নেভিকের ১১টি উপগ্রহের মধ্যে কাজ করছে মাত্র চারটি, যা দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।

০৪ ২০

আতঙ্কের এখানেই শেষ নয়। নেভিকের ‘জীবিত’ চারটি কৃত্রিম উপগ্রহের মধ্যেও দু’টির আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে একটি হল ‘ইন্ডিয়ান রিজিয়োনাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ বা আইআরএনএসএস-১বি। গত ১০ বছর ধরে কর্মরত রয়েছে এই নভোযান। জীবনকাল শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে যে কোনও সময়ে তথ্য পাঠানো বন্ধ করতে পারে এই উপগ্রহ।

০৫ ২০

প্রায় একই অবস্থা নেভিকের আইআরএনএসএস-১এফ-এর। শেষ ন’বছর ধরে মহাকাশ থেকে দিকনির্ণয়কারী তথ্য ক্রমাগত পাঠিয়ে চলেছে এই কৃত্রিম উপগ্রহ। বর্তমানে এতে বেশ কিছু প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, বিগড়েছে কিছু কলকব্জাও। ফলে আগের মতো আর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে না আইআরএনএসএস-১এফ। এই অবস্থায় নেভিককে চাঙ্গা রাখতে দ্রুত ‘জীবন ফুরিয়ে’ যাওয়া কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে বদলে ফেলা প্রয়োজন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

০৬ ২০

আমেরিকার জিপিএস, রাশিয়ার গ্লোনাস, চিনের বাইডো এবং ইইউ-এর গ্যালিলিওর সঙ্গে ভারতের তৈরি নেভিকের কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। নয়াদিল্লির প্রতিবেশী দেশগুলির বিভিন্ন এলাকার সঠিক অবস্থান এবং দিকনির্ণয়ের কথা মাথায় রেখে একে তৈরি করেছে ইসরো। এ দেশের মূল ভূখণ্ড এবং সীমান্ত থেকে ১,৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কোনও জায়গার অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে নেভিক। অন্য দিকে, জিপিএস বা গ্লোনাসকে ব্যবহার করে বিশ্বের যে কোনও জায়গাকে খুঁজে পেতে পারে ওয়াশিংটন বা মস্কো।

০৭ ২০

মহাকাশভিত্তিক দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থা নেভিক তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৯৯ সালের ভারত-পাকিস্তান কার্গিল যুদ্ধ। সংঘর্ষ চলাকালীন ইসলামাবাদের ফৌজ ছিল পাহাড়ের উপরে সুবিধাজনক জায়গায়। তাঁদের সঠিক অবস্থান জানতে এবং নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে আমেরিকার কাছে জিপিএস পরিষেবার সুবিধা চায় নয়াদিল্লি। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র তা দিতে অস্বীকার করে। তখনই এই ধরনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কেন্দ্র।

০৮ ২০

যুদ্ধ থামার পর নেভিক তৈরি করতে ইসরোর জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করে সরকার। কয়েক বছরের মধ্যেই জিপিএসের সমতুল্য এই ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের খুব একটা সমস্যা হয়নি। ২০১৩ সালের ১ জুলাই নেভিকের জন্য প্রথম দিক নির্ণয়কারী উপগ্রহকে অন্তরীক্ষে পাঠান তাঁরা। চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি এই ব্যবস্থার সর্বশেষ উপগ্রহটিকে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে সফল ভাবে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে ইসরো।

০৯ ২০

ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তৈরি নেভিক যে শুধু সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, এমনটা নয়। এই ব্যবস্থার কৃত্রিম উপগ্রহগুলি স্থল, আকাশ এবং সমুদ্রে দিকনির্ণয়ের ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়াও তাদের কৃষি, জরুরি পরিষেবা, সামুদ্রিক মাছ শিকার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পাওয়ার গ্রিড এবং বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়।

১০ ২০

নেভিকের মাধ্যমে জাহাজ, বিমান, মোবাইল ফোন বা ওই ধরনের কোনও যোগাযোগ রক্ষাকারী ডিভাইসের সঠিক অবস্থান জানা সম্ভব। জিপিএসের মতোই ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময়ে নিখুঁত নিশানায় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে একে ব্যবহার করে থাকে ফৌজ। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ভবিষ্যতের যুদ্ধে নেভিকের মতো ব্যবস্থা হাতে না থাকলে একচুলও এগোতে পারবে না সেনা। সেই কারণে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটিকে আরও উন্নত এবং শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

১১ ২০

২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নেভিকের হাত শক্ত করতে মোট ন’টি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে ইসরো। সেগুলির সবই ছিল ‘ইন্ডিয়ান রিজিয়োনাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’ বা আইআরএনএসএস শ্রেণির নভোযান। ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী উপগ্রহগুলির নামকরণ করেন এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। আর তাই প্রথমটির নাম ছিল আইআরএনএসএস-১এ। পরেরগুলির নাম একই ভাবে ১বি, ১সি, ১ডি, ১ই, ১এফ, ১জি, ১এইচ এবং ১আই রাখেন তাঁরা।

১২ ২০

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মহাশূন্যে নেভিকের কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে পাঠানোর সময়ে একবার মাত্র ব্যর্থ হয় ইসরো। উৎক্ষেপণের সময়ে রকেট ঠিকমতো কাজ না করায় আইআরএনএসএস-১এইচকে পৃথিবীর কক্ষপথে নিয়ে যেতে পারেননি এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বাকি আটটির ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও সমস্যা হয়নি। অন্তরীক্ষে পৌঁছোনোর পর নির্ধারিত কাজেও লেগে পড়ে তারা।

১৩ ২০

ভারতীয় ভূখণ্ড এবং প্রতিবেশী দেশগুলির কোনও জায়গার নিখুঁত অবস্থান জানতে নেভিকের কৃত্রিম উপগ্রহগুলিতে তিনটি করে পারমাণবিক ঘড়ি বসিয়েছিল ইসরো। সুইস সংস্থা ‘স্প্রেক্টাটাইম’ থেকে সেগুলিকে সংগ্রহ করেন এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। কয়েক বছর কাজ করার পর নেভিকের পাঁচটি উপগ্রহে ওই পরমাণু ঘড়ি ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখনই সেগুলিকে ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এ দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।

১৪ ২০

তথ্যের অধিকার বা আরটিআই (রাইট টু ইনফরমেশন) থেকে পাওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নেভিকের যে পাঁচটি উপগ্রহের পরমাণু ঘড়ি পুরোপুরি কাজ করা বন্ধ করেছে সেগুলি হল ১এ, ১সি, ১ডি, ১ই এবং ১জি। এ ছাড়া ১এফ উপগ্রহটির তিনটির মধ্যে দু’টি আণবিক ঘড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে। একটি এখনও কাজ করছে।

১৫ ২০

এই অবস্থায় বর্তমানে ১বি এবং ১আই উপগ্রহ দু’টি সঠিক ভাবে কাজ করে চলেছে। কিন্তু বয়সজনিত কারণে ১বি যে কোনও সময়ে তথ্য পাঠানো বন্ধ করতে পারে বলে মনে করছে ইসরো। ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ হওয়া ১আই উপগ্রহটি অবশ্য পরিষেবা দেবে ২০২৮ সাল পর্যন্ত। তবে পাঁচটি উপগ্রহের ‘অকালমৃত্যু’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একাংশ।

১৬ ২০

দু’বছর আগে নেভিকের প্রথম প্রজন্মের আইআরএনএসএস-এর পুরনো বহর সরিয়ে ফেলতে এনভিএস সিরিজের একগুচ্ছ কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাশূন্য পাঠায় ইসরো। অত্যাধুনিক এই এনভিএস হল পাঁচটি উপগ্রহের সমষ্টি। ২০২৩ সালে এনভিএস ০১-এর সফল উৎক্ষেপণ করে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা। কিন্তু, চলতি বছরের জানুয়ারিতে এনভিএস-০২কে পৃথিবীর কক্ষপথে সঠিক ভাবে স্থাপন করতে ব্যর্থ হন তাঁরা।

১৭ ২০

সূত্রের খবর, পৃথিবীর কক্ষপথে ‘বেখাপ্পা’ জায়গায় আটকে রয়েছে এনভিএস-০২। ইসরোর তৈরি এই উপগ্রহগুলির অনবোর্ড ইঞ্জিন সেগুলিকে ঠিক জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। ফলে দিকনির্ণয় বা অবস্থান চিহ্নিতকরণের কাজ করতে পারছে না তারা। উপগ্রহগুলির ইঞ্জিনকে কেন কন্ট্রোল সিস্টেম থেকে চালু করা যাচ্ছে না, তা অবশ্য স্পষ্ট করেনি ইসরো।

১৮ ২০

এনভিএস-০২-এর পাশাপাশি এ বছর আরও একটি অভিযানে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ইসরো। গত ১৮ মে পিএসএলভি-সি৬১ রকেটটি অন্তরীক্ষে যাওয়ার সময় মাঝপথে ধ্বংস হয়ে যায়। ‘আর্থ অবজ়ারভেশন স্যাটেলাইট-০৯’ বা ইওএস-০৯কে পৃথিবীর কক্ষপথে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তার। এই ব্যর্থতাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থাটির ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯ ২০

নেভিকের জন্য এনভিএস-০১ এবং এনভিএস-০২কে অন্তরীক্ষে পাঠাতে ১৯ মাস সময় নিয়েছে ইসরো। বিশেষজ্ঞদের কথায়, আগামী দিনে জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এই ব্যবধান কমাতে হবে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। তা ছাড়া দ্রুত ত্রুটি সংশোধন করে আরও আধুনিক উপগ্রহ তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে তাঁদের।

২০ ২০

এ ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে সংসদে কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে এনভিএস-০৩, এনভিএস-০৪ এবং এনভিএস-০৫র কৃত্রিম উপগ্রহগুলির উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া শেষ করবে ইসরো। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে পুরনো সিরিজের আরও কিছু নভোযানকে অল্প সময়ের জন্য মহাশূন্যে পাঠাতে পারে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এই সংস্থা। পাশাপাশি, নেভিককে শক্তিশালী করতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement