এক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কসংঘাত। অন্য দিকে বিরল খনিজ-সহ একাধিক কাঁচামালের অভাব। জোড়া ফলায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে সীমান্ত সমস্যাকে একপাশে সরিয়ে রেখে ‘সাপের ছুঁচো গেলার’ মতো করেই চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য মজবুত করার রাস্তায় হেঁটেছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে বিপজ্জনক ভাবে রফতানির অঙ্ক বাড়িয়ে ফেলার সুযোগ পাচ্ছে বেজিং।
ভারত-চিন পণ্য লেনদেনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বাণিজ্যিক ঘাটতি। নয়াদিল্লি এক টাকার সামগ্রী বিক্রি করলে তার ১০ গুণ রফতানি করছে বেজিং। ফলে এ দেশের বাজার অনেকাংশ চলে যাচ্ছে ড্রাগনভূমির দখলে। এর জেরে উদ্বেগ বেড়েছে কেন্দ্রের। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে মান্দারিনভাষীদের পণ্য সরবরাহ বাড়াতে সক্ষম হয় মোদী সরকার। কিন্তু তাতে ঘাটতির সূচক হ্রাস পাওয়া দূরে থাক, উল্টে আরও বেড়েছে।
কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) প্রথম সাত মাসে চিনে ৬,৪০০ কোটি ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে ভারত। গত বছর এই সময়সীমায় এই পরিমাণ ছিল ৫,৭৬৫ কোটি ডলার। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে বেজিঙের সঙ্গে নয়াদিল্লির বাণিজ্যিক ঘাটতি ৯,৯১২ কোটি ডলার ছুঁয়ে ফেলে। এ বার সেই অঙ্কই ১০ হাজার কোটি ডলার ছাপিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বছর চিনা বাজারে ভারতীয় পণ্যের রফতানি বৃদ্ধির নেপথ্যে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতিকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। গত এপ্রিল থেকে আমেরিকার সঙ্গে এই ইস্যুতে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বেজিং। এর পরই আমদানির ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনতে নয়াদিল্লির দিকে বেশি করে ঝুঁকতে কিছুটা বাধ্য হয় ড্রাগন সরকার। তবে সামগ্রিক ভাবে গত পাঁচ বছরে এখানকার পণ্য কম কিনেছে মান্দারিনভাষীরা।
২০২০-’২১ আর্থিক বছর থেকে চড়চড়িয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভারত-চিন বাণিজ্যিক ঘাটতি। ওই সময় থেকে শুরু করে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষের মধ্যে ড্রাগনভূমিতে নয়াদিল্লির পণ্য রফতানি হ্রাস পায় ৩৩ শতাংশ। উল্টে দিকে বেজিঙের আমদানি সূচককে প্রায় ৭৪ শতাংশ বাড়তে দেখা গিয়েছে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে ১,৪২৫ কোটি ডলারের সামগ্রী বিক্রি করে মোদী সরকার, যা সর্বকালের সর্বনিম্ন।
এ বছরের প্রথম সাত মাসে ১,০০৩ কোটি ডলারের পণ্য বেজিঙে পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। ড্রাগনভূমির সামগ্রী এ দেশে বহুল পরিমাণে সরবরাহ করার মূল কারণ হল বৈদ্যুতিন পণ্য, ব্যাটারি, সবুজ শক্তির সৌর প্যানেল এবং ওষুধ তৈরির কাঁচামালের অভাব। এ ব্যাপারে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছে ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’। তাদের দাবি, ভারতের প্রধান আটটি শিল্পক্ষেত্রের মূল পণ্য সরবরাহকারী দেশ হল চিন।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের এক শীর্ষ আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘সবচেয়ে বিপদের জায়গা হল রফতানি বাড়িয়েও বাণিজ্যিক ঘাটতি কমানো যাচ্ছে না। এ বছরের এপ্রিল থেকে অগস্টের মধ্যে বেজিঙে পণ্য সরবরাহ চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, ঘাটতি বেড়ে গিয়েছে ১৫ শতাংশ। ফলে কোনও লাভই হয়নি।’’ এই প্রবণতা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেই বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক ঘাটতির কারণ অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন ওই শীর্ষ আধিকারিক। তাঁর যুক্তি, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বেজিঙের থেকে সস্তায় কাঁচামাল কিনতে পারছেন। তাঁদের কাছে কোনও বিকল্প তুলে ধরা যাচ্ছে না। সেই কারণেই যত সময় গড়াচ্ছে ততই চওড়া হচ্ছে আমদানি-রফতানির ব্যবধান। এই পরিস্থিতির রাতারাতি বদল যে সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য।
২০২০ সালে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলওএসিতে (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) চিনা লালফৌজ (পিপল্স লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ) আগ্রাসী মনোভাব দেখালে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ওই সময় পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় বেজিঙের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান বিহার রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন জওয়ান। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, ভারতের পাল্টা প্রত্যাঘাতে প্রাণ যায় ৪০-এর বেশি ড্রাগন সৈনিকের। এই ঘটনার সর্বাধিক প্রভাব পড়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে।
গলওয়ান সংঘর্ষের পর চিনা পণ্য আমদানির নিয়মে কড়াকড়ি শুরু করে কেন্দ্র। নিষিদ্ধ করা হয় ‘টিকটক’-সহ বেজিঙের একাধিক অ্যাপ। ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৮,৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে ফের সেটা বেড়ে ১২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে পৌঁছে যায়। এর মধ্যে নয়াদিল্লিকে ১১ হাজার ৩৪৫ কোটি ডলারের সামগ্রী পাঠায় ড্রাগনভূমির বিভিন্ন সংস্থা। অর্থাৎ, এ ব্যাপারে মান্দারিনভাষীদের একাধিপত্য রয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।
এই পরিস্থিতির জন্য কেন্দ্রের নীতিকে দুষেছেন জিটিআরআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরোয়া উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ দিতে ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেন্টিভ’ বা পিএলআই প্রকল্প চালু করেছে সরকার। কিন্তু, এতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। কারণ দেশীয় শিল্পগুলি কাঁচামাল বা উন্নত যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’’
উদাহরণ হিসাবে ফার্মা সংস্থাগুলির কথা বলা যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে তাদের তৈরি ওষুধের বেশ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অ্যান্টিবোয়টিক বা জীবনদায়ী ওষুধ তৈরিতে যে সক্রিয় উপাদানের (অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট) প্রয়োজন হয় তার ৭০ শতাংশ চিন থেকে আমদানি করে থাকে ভারত। এই উপাদানের সরবরাহ বেজিং পুরোপুরি বন্ধ করলে এ দেশের ফার্মা সংস্থাগুলি যে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একই অবস্থা সৌর প্যানেলের ক্ষেত্রেও। সবুজ শক্তি উৎপাদনের সৌর কোষগুলির মূল কাঁচামাল আসে ড্রাগনভূমি থেকে। প্রতি বছর গড়ে ৪০০ কোটি ডলারের সেই উপাদান নয়াদিল্লিকে পাঠাচ্ছে বেজিং। বৈদ্যুতিন গাড়ি, মোবাইল ফোন বা সরঞ্জাম তৈরির অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হল সেমিকন্ডাক্টর ও বিরল খনিজ। এই দু’টির নিয়ন্ত্রণও বর্তমানে রয়েছে মান্দারিনভাষীদের হাতে।
আর তাই জিটিআরআইয়ের তরফে দেওয়া সতর্কবার্তায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি, শিল্পের ক্ষেত্রে পুরোপুরি আত্মনির্ভর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে দিল্লিভিত্তিক এই সমীক্ষক সংস্থা। চিনে মূলত বিভিন্ন খনিজ, জৈব রাসায়নিক, সামুদ্রিক পণ্য এবং কৃষিপণ্য রফতানি করে থাকে ভারত।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য বাণিজ্যিক ঘাটতি কমাতে চিনা পণ্যে বিপুল শুল্ক আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইস্পাতের প্রসঙ্গ টেনেছেন তাঁরা। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট পণ্যটি উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বেজিং ও নয়াদিল্লি। আর তাই এ দেশে রফতানি বাড়াতে অনেক সময়েই মান্দারিনভাষীদের ভারতীয় সংস্থাগুলির চেয়ে সস্তা দরে ইস্পাত বিক্রির চেষ্টা করতে দেখা যায়।
সেই কারণে চিন থেকে আগত ইস্পাতের উপর ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে নয়াদিল্লি। ফলে এখানকার বাজারে ব্যবসা করা বেজিঙের ইস্পাতের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হয়েছে। তবে সমস্ত ক্ষেত্রে এই নীতি নেওয়া একেবারেই সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে ফার্মা বা বিরল খনিজের রফতানি বন্ধ করে ভারতকে বিপদে ফেলতে পারে ড্রাগন সরকার। দ্বিতীয়ত, এর জেরে ঘরোয়া বাজারে লাফিয়ে বাড়তে পারে মুদ্রাস্ফীতির হার।
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিদের যুক্তি, চিনের বিকল্প খুঁজে পেতে বর্তমানে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিকে পাখির চোখ করেছে সরকার। সেখান থেকে বিরল খনিজ পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে বাদ দিয়ে রফতানির অন্য বাজার খুঁজে বার করার চেষ্টা চালাচ্ছে মোদী সরকার। সেখানে সাফল্য এলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বেজিঙের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে একটি আন্তঃমন্ত্রক প্যানেল তৈরি করেছে কেন্দ্র। তাতে বাণিজ্য বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অফ কমার্স), বিদেশি বাণিজ্য (ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড), শুল্ক দফতর এবং শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচার বিভাগের অফিসারেরা রয়েছেন। চিনা পণ্যে এ দেশের বাজারে ‘ডাম্পিং’ হচ্ছে কি না, সে দিকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্যানেলটিকে।