ভারতে প্রথাগত লগ্নির অন্যতম ক্ষেত্র হল ব্যাঙ্ক। এ দেশের নাগরিকেরা নিজেদের পছন্দমতো সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে টাকা জমা রাখতে পারেন। সেভিংস অ্যাকাউন্টের সঞ্চিত অর্থের উপর বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বিভিন্ন রকমের সুদ দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার স্থায়ী আমানত বা এফডিতে (ফিক্সড ডিপোজ়িট) বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থের অঙ্ক বাড়ানোর চেষ্টা করে থাকেন। চলতি বছরের শেষে পৌঁছে সেভিংস এবং এফডির নিয়মে বড় বদল করল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)।
এ দেশের যাবতীয় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হল আরবিআই। কেন্দ্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির তৈরি করা নিয়মের উপর ভিত্তি করেই ব্যবসা করে থাকে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক। আর তাই আরবিআইয়ের নতুন নিয়ম সব বয়সের সমস্ত গ্রাহকের উপর যে প্রভাব ফেলবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২০২৫ সালের শেষ লগ্নে পৌঁছে মোট আটটি নতুন নিয়ম চালু করার কথা বলেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। এতে পাঁচ লক্ষ টাকার উপর শূন্য সুদের কথাও বলা আছে!
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটির জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সেভিংস অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে বদলাচ্ছে তিনটি নিয়ম। নতুন বিধিতে বলা হয়েছে, এতে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ের উপর দেশের সমস্ত ব্যাঙ্ক একই হারে সুদ দেবে। অর্থাৎ, গ্রাহকের সেভিংস অ্যাকাউন্ট স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় (এসবিআই) থাকুক বা এইচডিএফসি বা অন্য যে কোনও ব্যাঙ্কে, সেখানে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ এক লক্ষ টাকা হলে সর্বত্র একই হারে সুদ পাবেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখছে না আরবিআই।
এত দিন পর্যন্ত সেভিংস অ্যাকাউন্টে ইচ্ছামতো আকর্ষণীয় সুদের কথা বলে গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করত বিভিন্ন ব্যাঙ্ক। অনেক সময় অর্থনীতির নিয়ম ভেঙে এই কাজ করার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। আর তাই নতুন বিধিতে একরকম নিয়ম করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির পায়ে আরবিআই বেড়ি পরাল বলেই মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদের হিসাবও সরল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। সেখানে বলা হয়েছে, গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে দৈনিক যত টাকা জমা হবে, দিনের শেষে তার উপর সুদ হিসাব করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক।
এ ছাড়া প্রতি তিন মাস অন্তর সেভিংস অ্যাকাউন্টের গচ্ছিত অর্থের সঙ্গে সুদ যুক্ত হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। প্রতি ত্রৈমাসিকে সুদবাবদ কত অর্থ পাচ্ছেন, তা জানতে পারবেন গ্রাহক। তবে এই নিয়ম এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বলবৎ হবে। সেভিংস অ্যাকাউন্টে তার চেয়ে বেশি অর্থ গচ্ছিত থাকলে ব্যাঙ্কভেদে সুদের হার পৃথক হতে পারে। সেখানে নিয়মের ক্ষেত্রে শিথিলতা বজায় রেখেছে আরবিআই।
সেভিংস অ্যাকাউন্টকে বাদ দিলে ব্যাঙ্কে বিনিয়োগের জনপ্রিয়তম প্রকল্প হল স্থায়ী আমানত (এফডি)। এতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টাকা গচ্ছিত রাখতে পারেন গ্রাহক। সেটা এক বছর, দু’বছর, পাঁচ বা ১০ বছর হতে পারে। এফডি বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ নয়। তবে এতে সুদের হার নির্দিষ্ট। মেয়াদোত্তীর্ণ হলে লগ্নিকারীকে সুদেমূলে পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দেয় ব্যাঙ্ক। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এতে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে টাকার অঙ্ক।
কিন্তু, সমস্যা হল গ্রাহকদের একাংশ অনেক সময় জরুরি প্রয়োজনে মেয়াদ শেষের আগেই এফডি ভেঙে টাকা তুলে নেন। সে ক্ষেত্রে জরিমানা নিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক। এ ছাড়া লগ্নি করা অর্থের উপর কমে যায় সুদ। এত দিন জরিমানা এবং সুদহ্রাসের ব্যাপারে কোনও একক নিয়ম ছিল না। নতুন বিধিতে সেখানে বদল এনেছে আরবিআই। ফলে আগামী দিনে স্থায়ী আমানতে টাকা রাখার সময় বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে গ্রাহকদের।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নতুন নিয়মে বলা হয়েছে, এ বার থেকে মেয়াদ শেষের আগে এফডি ভেঙে ফেললে কত টাকা সুদ এবং জরিমানা বাবদ কেটে নেওয়া হবে, তা আগাম জানাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক। আর তাই ফিক্সড ডিপোজ়িটের ফর্মে বাধ্যতামূলক ভাবে সেই নিয়ম লিখে দিতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষের আগে এফডি ভাঙলে কোনও ব্যাঙ্ক গ্রাহককে সুদ না দিতেও পারে। কিন্তু, এফডি করার সময় সেটা পরিষ্কার করে গ্রাহককে জানিয়ে দিতে হবে।
দেশের সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্ককে স্থায়ী আমানতের সর্বনিম্ন সময়সীমা সাত দিন রাখতে বলেছে আরবিআই। এফডির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার দিনে ছুটি থাকলে পরের দিনই সুদেমূলে পুরো টাকা হাতে পাবেন গ্রাহক। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত এক দিনের সুদ যুক্ত করে লগ্নিকারীকে টাকা দিতে বলেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক।
স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ টানতে এত দিন নানা ধরনের উপহার বা লটারির ‘মেগা অফার’ দিত একাধিক ব্যাঙ্ক। এই পদ্ধতি পুরোপুরি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে আরবিআই। উপহার বা লটারির লোভ দেখিয়ে কাউকে স্থায়ী আমানতে লগ্নি করালে আগামী দিনে শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর অটো-রিনিউয়াল বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গ্রাহকের টাকা ফের এফডিতে রাখতে পারবে না ব্যাঙ্ক। মেয়াদোত্তীর্ণ অর্থ লগ্নিকারী তুলে না নিলে ন্যূনতম সুদ পাবেন গ্রাহক। অর্থাৎ, এফডি বা সেভিংস অ্যাকাউন্ট, এই দুইয়ের মধ্যে যাতে সুদের হার কম, সেই হিসাবে সুদ পাবেন ওই ব্যাক্তি। তবে লগ্নিকারী নতুন করে স্থায়ী আমানতে টাকা রাখতে পারবেন।
সেভিংস অ্যাকাউন্টের মতো এফডির ক্ষেত্রেও সুদের হার সমস্ত ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে এক রকম করার নির্দেশ দিয়েছে আরবিআই। ফলে লগ্নিকারীরা যে কোনও ব্যাঙ্কে সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থায়ী আমানতে টাকা রাখলে একই রকম লাভবান হবেন। তবে উচ্চ মূল্যের বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না এই নিয়ম। আলাদা আলাদা সুদের হারে তাঁদের স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে পারবে তামাম সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাঙ্ক।
মেয়াদি আমানতে অবশ্য ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের বেশি সুদ দিচ্ছিল দেশের সমস্ত ব্যাঙ্ক। নতুন বিধিতে সেই নিয়মের কোনও রদবদল করছে না আরবিআই। সেভিংস অ্যাকাউন্ট এবং এফডির পাশাপাশি ভাসমান হারে গৃহঋণে সুখবর শুনিয়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর এই নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে তারা। এ বছরের ১ অক্টোবর থেকে নতুন নিয়ম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
আগে গৃহঋণের ক্ষেত্রে তিন বছরে এক বার মাত্র গ্রাহকদের স্প্রেড সংশোধন করতে পারত সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক। কিন্তু নতুন নিয়মে সেখানে শিথিলতা এনেছে আরবিআই। ফলে ঋণগ্রহণকারীর ক্রেডিট স্কোর উন্নত হলে তিন বছরের আগেই স্প্রেড সংশোধন করা যাবে। সে ক্ষেত্রে কমতে পারে ঋণের কিস্তি।
তবে এই ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় নয়। এর জন্য ঋণগ্রহণকারীকে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। গৃহঋণে ভাসমান সুদের হারে দু’টি অংশ থাকে। একটি হল বহিরাগত বেঞ্চমার্ক রেট এবং অপরটি ব্যাঙ্ক স্প্রেড। প্রথমটি আরবিআইয়ের রেপো রেটের উপর নির্ভরশীল। অন্য দিকে ব্যাঙ্কের মুনাফার পরিমাণ, পরিচালন ব্যয়, ঋণগ্রহণকারীর ক্রেডিট স্কোর এবং তাঁর প্রোফাইলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় ব্যাঙ্ক স্প্রেড।
নিয়ম অনুযায়ী, গৃহঋণের ক্ষেত্রে ক্রেডিট স্কোর উন্নত হলে গ্রাহক সুদের হার কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে পারেন। আগে প্রতি তিন বছরে এক বার সেটা করতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু নতুন নিয়মে তার আগেই আর্জি জানাতে পারবেন গ্রাহক। ওই আবেদনের উপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট ঋণ পুনর্মূল্যায়ন করবে ব্যাঙ্ক। এর পর তাৎক্ষণিক ভাবে সুদ কমলে মাসিক কিস্তিতে কম টাকা জমা করবেন ওই ব্যক্তি।
গৃহঋণ সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছরের মেয়াদে দিয়ে থাকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক। ঋণের অঙ্ক ২৫ লক্ষ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সেখানে ব্যাঙ্ক স্প্রেডের হিসাবে সুদের অঙ্ক মাত্র ০.২৫ শতাংশ হ্রাস পেলেও অনেক টাকা সঞ্চয় করতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।