মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শরীরে বইছে ‘হালাল’ রক্ত! সেই কারণে দ্রুত দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিতে হবে তাঁকে। এ বার প্রকাশ্যে এই আহ্বান জানালেন পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার ‘বড় শত্রু’ ইরানের দু’হাজারের বেশি ইসলামীয় ধর্মগুরু। তাঁদের দেওয়া এ-হেন হুমকিতে ঘুম উড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিদের। ট্রাম্পের সুরক্ষাকে আরও জোরদার করার দিকে নজর দিয়েছেন তাঁরা।
চলতি বছরের ১ অগস্ট পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুকটির সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা ‘কোম’-এ জড়ো হন দু’হাজারের বেশি ধর্মগুরু। সেখানে দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হত্যার ফরমান জারি করেন তাঁরা। এই নিয়ে দেওয়া হয় একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও, যাতে ট্রাম্পের ধমনীতে ‘হালাল’ রক্ত বইছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইরান ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দু’হাজার ধর্মগুরুর ফরমানে বলা হয়েছে, ‘‘বিপ্লবী সংযম এবং ধৈর্যের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ট্রাম্পের রক্ত ও সম্পত্তি ‘হালাল’। আর তাই কাসেম সুলেমানির হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া প্রতিটা মুসলিম এবং স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষের কর্তব্য।’’ ২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ট্রাম্পের নির্দেশেই মার্কিন ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয় তেহরানের ওই সেনা কমান্ডারের।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সংশ্লিষ্ট ফরমানে বিশিষ্ট ধর্মগুরুদের পাশাপাশি সই করেন ইরানের জুনিয়ার মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ট্রাম্পকে ‘বর্বর’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি সেখানে আরও বলা হয়, ‘‘এই ধরনের ঘটনার পর কোনও জাতির পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। আমরা এর জবাব দেবই। সময় বুঝে জোরদার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’’
ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আমি খামেনেই নিযুক্ত অন্তত তিন জন শীর্ষনেতা ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন। তাঁরা হলেন শুক্রবারের জুম্মার নমাজ়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমাম আহমেদ খাতামি, এক্সপিডিয়েন্সি কাউন্সিলের সদস্য মহসেন আরাকি এবং গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্য মেহেদি শাবজ়েনদার। এই তিন জনও ট্রাম্পের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন বলে জানা গিয়েছে।
আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইরানের সুদক্ষ আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের বহর নিয়ন্ত্রণ করেন এর ফৌজি জেনারেলরা। খামেনেইয়ের নির্দেশে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে কোনও রকমের ঝুঁকি নিতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকেন তাঁরা। তেহরানের এই শিয়া ধর্মগুরুর কাছে আমেরিকা ‘বড় শয়তান’। ইহুদিভূমি ইজ়রায়েলকে ‘ছোট শয়তান’ বলে ডেকে থাকেন তিনি।
২০২০ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত কাসেম সুলেমানি ছিলেন আইআরজিসির কমান্ডার। আলি খামেনেই ঘনিষ্ঠ এই সেনা অফিসার কুর্দ বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও অংশ নেন তিনি। পরবর্তী কালে একের পর এক গুপ্ত অভিযান চালিয়ে ইজ়রায়েলকে নাস্তানাবুদ করে তোলেন সুলেমানি। তাঁর রণকৌশলের সঙ্গে এঁটে ওঠা ইহুদিদের পক্ষে বেশ মুশকিল হচ্ছিল।
সূত্রের খবর, এ-হেন সুলেমানিকে সরিয়ে দিতে ছক কষে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। তাঁর গতিবিধির উপর কড়া নজর ছিল ইহুদি গোয়েন্দাদের। সেই খবর মার্কিন ফৌজের কাছে পৌঁছে দেয় তারা। এর পরেই বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে গাড়িতে ওঠার পর সুলেমানির উপরে ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। এই ঘটনার পর প্রতিশোধ নিতে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার একাধিক সেনাঘাঁটিকে নিশানা করে তেহরান। যদিও এতে আমেরিকার তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সুলেমানির মৃত্যুর পর ওই বছরের ১০ অগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবন এবং দফতর হোয়াইট হাউসের বাইরে গুলি চালায় সন্দেহভাজনক এক ব্যক্তি। সে সময়ে সাংবাদিক বৈঠকে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন ট্রাম্প। তড়িঘড়ি তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের অফিসারেরা। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বৈঠকটিকেও বাতিল করা হয়।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্যাস্কেল সেসিল ভেরোনিক ফেরিয়ার নামের এক মহিলাকে গ্রেফতার করে নিউ ইয়র্কের গোয়েন্দা বিভাগ। তাঁর কাছে মেলে ট্রাম্পকে লেখা বিষমাখানো একটি চিঠি। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ‘কুৎসিত অত্যাচারী জোকার’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট চিঠিটিকে জৈব হাতিয়ার মেনে নিয়ে ভেরোনিক ফেরিয়ারকে ২২ বছরের জন্য জেলে পাঠায় আমেরিকার আদালত।
গত বছর অন্তত দু’বার নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত থাকাকালীন ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আততায়ী। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই পেনসিলভ্যানিয়ায়। ওই সময়ে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তিনি। তার মাঝেই থমাস ম্যাথিউ ক্রুকস নামের এক ব্যক্তি এআর-১৫ রাইফেল দিয়ে ট্রাম্পের উপরে অন্তত আটটি গুলি চালান। এর মধ্যে একটি বুলেট তাঁর কান ছুঁয়ে চলে যায়। থমাস লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান ট্রাম্প।
পেনসিলভ্যানিয়া-কাণ্ডে কিছু ক্ষণের মধ্যেই অভিযুক্ত ক্রুকসকে গুলি করে নিকেশ করে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের স্নাইপার দল। ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ফ্লোরিডার একটি গল্ফ ক্লাবে ঝোপের মধ্যে রাইফেল হাতে এক ব্যক্তিকে বসে থাকতে দেখে গুলি চালান ট্রাম্পের নিরাপত্তারক্ষীরা। তিনি ওই সময়ে গল্ফ খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি পালানোর চেষ্টা করলে তাঁকে গ্রেফতার করে স্থানীয় পুলিশ।
আমেরিকার ‘ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ বা এফবিআইয়ের তদন্তে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম রায়ান ওয়েসলি। কেন তিনি ট্রাম্পকে খুন করতে চেয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। ২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি জনসভা সংলগ্ন চেকপয়েন্টে দু’টি আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রচুর বিস্ফোরক-সহ গ্রেফতার হন এক ব্যক্তি। তাঁর থেকে উদ্ধার হয় জাল লাইসেন্স এবং ভুয়ো নম্বরপ্লেটের একটি গাড়ি। সংশ্লিষ্ট জনসভার মুখ্য বক্তা ছিলেন ট্রাম্প।
১৯৭৯ সালে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর আগে পর্যন্ত ইরান-আমেরিকার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। তেহরানের তৎকালীন শাহ মহম্মদ রেজ়া পেহলভি ছিলেন পশ্চিমি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু, তাঁকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা রুহুল্লা খামেনেই। এর পর থেকেই সাবেক পারস্য দেশটির সঙ্গে চরম শত্রুতা শুরু হয় আমেরিকার।
পরবর্তী দশকগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচাপ বাড়িয়ে পরমাণু বোমার অন্যতম উপাদান ইউরেনিয়াম শুদ্ধকরণে জোর দেয় তেহরান। মার্কিন ও ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের দাবি, আণবিক বোমা তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে সাবেক পারস্য দেশ। একে ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’ বলে মনে করে এ বছরের জুনে ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। তাঁদের ওই সেনা অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’।
কিন্তু ইজ়রায়েলি হামলার প্রত্যাঘাত শানিয়ে পাল্টা হাইপারসনিক ও ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে ইহুদি ভূমির একাধিক শহরকে নিশানা করে শিয়া ফৌজ। তাদের ছোড়া ওই হাতিয়ারকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় ইজ়রায়েলের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। ফলে তেল আভিভ এবং হাইফার মতো জনবহুল এলাকায় আছড়ে পড়ে ওই ক্ষেপণাস্ত্র। তেহরান এই সামরিক জবাবের নাম দেয় ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় ৩’।
ইরান-ইজ়রায়েল এই সংঘাতে ফের প্রবেশ ঘটে ট্রাম্পের। তাঁর নির্দেশে তেহরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা। এর জন্য ‘বি-২ স্পিরিট’ বোমারু বিমান ব্যবহার করে তারা। সাবেক পারস্য দেশটির উত্তর দিকের ভূগর্ভস্থ গোপন আস্তানায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ চালাচ্ছিল তেহরান। ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’-এ তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ১৮। মার্কিন সেনা অভিযানের পর ট্রাম্পের ‘মধ্যস্থতা’য় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি নয় যুযুধান শিয়া ও ইহুদি ফৌজ। পরে ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাট্জ় একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, আলি খামেনেইকে নিকেশ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু সংঘাত চলাকালীন তাঁকে সুরক্ষিত গোপন ডেরায় নিয়ে যায় আইআরজিসি। ফলে সেই লক্ষ্য পূরণ করা যায়নি।
মজার বিষয় হল, ট্রাম্পের মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামাবাদ সফরে যান ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সমাজমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট করেন তিনি। ফলে স্পষ্ট হয়ে যায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির দ্বিচারিতা।
মজার বিষয় হল, ট্রাম্পের মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামাবাদ সফরে যান ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সমাজমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট করেন তিনি। ফলে স্পষ্ট হয়ে যায় পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির দ্বিচারিতা।
ইরানি প্রেসিডেন্ট পেজ়েশকিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে চিন এবং আমেরিকাকে নিয়ে পর পর দু’টি পোস্ট করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেজিং এবং তেহরানের যথেষ্ট শত্রুতা রয়েছে। অথচ দু’পক্ষের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছে ইসলামাবাদ। কিছু দিন আগে ট্রাম্পকে শান্তির জন্য নোবল পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এর মাধ্যমে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মন জয়ের চেষ্টা করেছে তা বলাই বাহুল্য।
তেহরানকে যে কখনওই পরমাণু বোমা তৈরির অনুমোদন আমেরিকা দেবে না, ইতিমধ্যেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন ট্রাম্প। অন্য দিকে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ বন্ধ করতে নারাজ ইরান। তার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলেন সাবেক পারস্য দেশটির দু’হাজারের বেশি ধর্মগুরু। তাই এই ঘটনার আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।