প্রতিরক্ষা থেকে বাণিজ্য কিংবা মহাকাশ গবেষণা। প্রতিটা ক্ষেত্রে পায়ে পা লগিয়ে চিনের সঙ্গে ঝগড়া করতে নিমরাজি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উল্টে বেজিঙের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলার ব্যাপারে বেশি উৎসাহ তাঁর। শুধু তা-ই নয়, ড্রাগনকে নিয়ে ‘জি-২’ নামের দ্বিপাক্ষিক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চাইছেন তিনি। তাই দেখে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে ট্রাম্পের তুলনা টানা শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তে পতনের পথে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? উঠছে প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিনের ব্যাপারে ‘কৌশলগত’ দিক থেকে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ট্রাম্প। বেজিঙের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবমূল্যায়ন করছে তাঁর সরকার। ফলে আগামী দিনে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’ হয়ে উঠতে পারে ড্রাগনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনা। তখন ওই এলাকায় নিজেদের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ যে পুরোপুরি ভাবে যুক্তরাষ্ট্র হারিয়ে ফেলবে, তা বলাই বাহুল্য। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের অবিমৃশ্যকারী পদক্ষেপে গত ১১ মাসে একাধিক ‘বন্ধু’ হারিয়েছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের বিদেশনীতি নিয়ে ‘কৌশলগত অংশীদার’দের মনে তৈরি হয়েছে সন্দেহ। বিশ্লেষকদের কথায়, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূ-কৌশলগত দূরদৃষ্টির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫ সাল) পর দুনিয়াব্যাপী মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে যে সামরিক জোটগুলি তৈরি হয়েছিল, এক এক করে সেই নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলছেন তিনি। ফলে সেই ফাঁকা জায়গায় আধিপত্য বৃদ্ধির সুবিধা পাচ্ছে চিন।
সাবেক সেনাকর্তারা মনে করেন, ট্রাম্প প্রস্তাবিত ‘জি-২’ বাস্তবের মুখ দেখলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় একচ্ছত্র রাজত্বের নতুন অধ্যায় শুরু করবে চিন। সেখানকার একাধিক দ্বীপরাষ্ট্র কব্জা করতে পারে বেজিং। পাশাপাশি ওই এলাকার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলিকে বন্ধ করাই হবে তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ চিন সাগর, তাইওয়ান প্রণালী, বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে বাড়বে ড্রাগন নৌবাহিনী ‘দৌরাত্ম্য’। এই সামুদ্রিক এলাকার সম্পদের উপর দীর্ঘ দিন ধরেই নজর রয়েছে মান্দারিনভাষীদের।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্প যে ভাবে চিনের হাতে ‘ফাঁকা চেক’ তুলে দিচ্ছেন, তাতে অচিরেই বদলে যাবে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আর্থিক কাঠামো, প্রযুক্তিগত বাস্তুতন্ত্র, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যাবতীয় হিসাব। এতে জাপান, রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া), ফিলিপিন্স এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত ‘বন্ধু’দের মারাত্মক বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, এই সামুদ্রিক ক্ষেত্রের আঞ্চলিক শৃঙ্খলা এবং ভারসাম্য ওয়াশিংটন এবং বেজিঙের দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার ভারে ভেঙে পড়তে পারে।
আর তাই এ বছরের জুনে ট্রাম্পের বিদেশনীতির কড়া সমালোচনা করে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’। সেখানে বলা হয়েছে, আমেরিকার ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত ২৪টির মধ্যে ১৯টি দেশের তরুণ প্রজন্মের ওয়াশিংটনের উপর রয়েছে চরম অবিশ্বাস। তালিকায় নাম আছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের। মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্যই গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার পদত্যাগ প্রত্যক্ষ করেছে টোকিও, বলছেন ‘পিউ রিসার্চ’-এর সমীক্ষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের কুর্সিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম কার্যকালের মেয়াদে অবশ্য চিনকে নিয়ে ট্রাম্পের চিন্তাভাবনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই সময় বেজিঙের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ান তিনি। ২০১৭ সালে ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত ‘চতুর্ভুজ নিরাপত্তা সংলাপ’ বা কোয়াডকে (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ) পুনরুজ্জীবিত করেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলিতে এই তিন দেশের সঙ্গে সামরিক ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে ওয়াশিংটন। শুরু হয় যৌথ সামরিক মহড়া এবং নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করে ওঠার কাজ।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতার আসার পর প্রাথমিক ভাবে চিনকে নিয়ে একটা ‘যুদ্ধং দেহী’ মনোভাব ছিল ট্রাম্পের। মাত্র চার মাসের মাথায় এপ্রিলে বেজিঙের সঙ্গে শুল্ক সংঘাতে নেমে পড়েন তিনি। পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে আমেরিকাকে বিরল খনিজ রফতানি বন্ধ করেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ওই সময় হুমকি দিয়েও মান্দারিনভাষীদের তেমন কোনও সুবিধা করতে পারেননি বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর পরই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে ‘নরমপন্থী’ পদক্ষেপ করতে থাকেন ট্রাম্প।
গত অক্টোবরে চিনা পণ্যে শুল্ক হ্রাস করে তা ৪৭ শতাংশে নামিয়ে আনেন ট্রাম্প। একসময়ে যা ছিল ১৪২ শতাংশ। ওই সময় আমেরিকার সামগ্রীতে ১৩৪ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে রেখেছিল বেজিং। গত মে মাসে এই বাণিজ্যিক সংঘাত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তখনই সমাজমাধ্যমে মারাত্মক ভাবে ট্রোলিংয়ের শিকার হন তিনি। যদিও বিশ্লেষকেরা মনে করেন এ ছাড়া তার সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।
একসময়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা প্রভাব হ্রাসে কোয়াডকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। তার উত্তরসূরি জো বাইডেনের আমলেও সেই নীতি থেকে সরে আসেনি আমেরিকা। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর চতুর্দেশীয় জোটটিকে সে ভাবে গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে না তাঁকে। নভেম্বরে দিল্লিতে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যোগ দেবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এর পাশাপাশি ‘কৌশলগত অংশীদার’ ভারতের সঙ্গে ক্রমাগত শুল্ক সংঘাত বাড়িয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প। গত এপ্রিলে নয়াদিল্লির পণ্যে ২৬ শতাংশ শুল্ক চাপান তিনি। পরে রাশিয়ার থেকে খনিজ তেল কেনার শাস্তি হিসাবে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি, নানা ইস্যুতে চাপ তৈরি করায় দু’তরফে হয়নি কোনও বাণিজ্যচুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ-হেন মনোভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে প্রভাব ফেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
গত ৩০ অক্টোবর রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকের (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) বুসান শহরে চিনা রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রায় দু’ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার আলোচনার পর নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেন ‘প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ অর্থাৎ পোটাস। সেখানে তিনি লেখেন, বাণিজ্য নিয়ে কেটেছে জট। ফলে বিরল খনিজ পেতে আর কোনও সমস্যা হবে না।
বুসানে ওই বৈঠকের মুখে প্রথম বার ‘জি-২’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন ট্রাম্প। এর পরই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় হইচই। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ‘জি-২’র মাধ্যমে চিনকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিপাক্ষিক ভাবে বিশ্ব জুড়ে মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখতে চাইছেন পোটাস, যাকে স্বাগত জানাতে অবশ্য একেবারেই দেরি করেনি বেজিং।
দক্ষিণ কোরিয়ায় চিনা প্রেসিডেন্ট শি-র সঙ্গে বৈঠকের পর ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প লেখেন, ‘‘জি-২র বৈঠক আমাদের দুই দেশের জন্যই দুর্দান্ত ছিল। এটা আমাদের চিরস্থায়ী শান্তি এবং সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে। ঈশ্বর চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই আশীর্বাদ করুন!’’
এর পরই বিষয়টি নিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেয় বেজিঙের বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা যৌথ ভাবে দায়িত্ব পালন করব। বিশ্বের কল্যাণের জন্য মহান এবং সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তার জন্য একসঙ্গে পথ চলার ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তি নেই।’’
১৯৮৫ সালে ক্ষমতায় আসেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল সের্গেইভিচ গর্বাচেভ। কুর্সিতে বসেই সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেন তিনি। তাঁর নেওয়া দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রোইকা। এতে মস্কোকে নিয়ে সোভিয়েত জোটে দেখা দেয় চরম অবিশ্বাস, যা তাদের বুনিয়াদে ফাটল ধরিয়েছিল।
ক্ষমতায় থাকাকালীন ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেন গর্বাচেভ। আমেরিকার সঙ্গে চলা চার দশকের ‘ঠান্ডা লড়াই’ থামাতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ফলস্বরূপ ১৯৯০ সাল আসতে আসতে সোভিয়েতের রাশ আলগা হতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে রাশিয়া-সহ ১৫টি রাষ্ট্রে ভেঙে যায় এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের দাবি, গর্বাচেভের মতো একই ভুল করছেন ট্রাম্প। সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান শত্রুতা ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় শামিল হয়েছিলেন। ফলে যাবতীয় ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের মস্কোর উপর ভরসা কমেছিল। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সেখানে জোরদার হয় স্বাধীনতার দাবি। পাশাপাশি অনেকেই আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) দিকে ঝুঁকতে শুরু করে।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক হুসেন ওবামার আমলেও চিনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টায় ত্রুটি করেনি আমেরিকা। বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়িয়ে বেজিংকে বিস্তারবাদী নীতি থেকে সরিয়ে আনতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের একটা বড় অংশ দখল করে ফেলে ড্রাগনের বিভিন্ন সংস্থা।
ট্রাম্প সেই একই ভুল করছেন বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ। তবে আমেরিকার অবস্থা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো হবে, এই ধারণা অবশ্য কষ্টকল্পিত। কারণ, নেটো-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া পরিস্থিতি বুঝে ফের কোয়াডকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিতে পারেন তিনি, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।