ইজ়রায়েলকে বিপদে ফেলতে ‘ইসলামীয় নেটো’ তৈরির দাবিতে সরব পাকিস্তান। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে তার সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছে ইসলামাবাদ। অন্য দিকে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর থেকে ক্রমাগত ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এ-হেন জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে পশ্চিম এশিয়ার ‘বন্ধু’ ইহুদি রাষ্ট্র। একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
ইজ়রায়েলি গণমাধ্যম ‘আই২৪’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নয়াদিল্লি সফর করবেন ইহুদিভূমির প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী-সহ মোট চার জন ‘হেভিওয়েট’ রাজনৈতিক নেতা। এতটা কম সময়ে সেখানকার একের পর এক মন্ত্রীর ভারতে আসাকে ‘নজিরবিহীন’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এতে দু’পক্ষের সম্পর্ক যে মজবুত হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু তা-ই নয়, এই সময়সীমার মধ্যে একাধিক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে দু’তরফে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সাবেক সেনাকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কূটনৈতিক সূত্রকে উল্লেখ করে ‘আই২৪’ লিখেছে, এ বছরের নভেম্বরের গোড়ায় প্রথমে ভারত সফর করবেন ইজ়রায়েলি বিদেশমন্ত্রী গিডিয়ান সার। ঠিক তার পরেই ডিসেম্বরে নয়াদিল্লিতে পা পড়বে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। মুম্বই এবং অহমদাবাদ— এই দুই শহরে যেতে পারেন তিনি। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে এখনও কিছু জানায়নি সাউথ ব্লক।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লিতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সম্মেলনের আয়োজন করছে কেন্দ্র। ইজ়রায়েলি গণমাধ্যমগুলির দাবি, সেখানে ব্যক্তিগত ভাবে ‘বন্ধু’ নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তবে ডিসেম্বরের সফরের মাত্র দু’মাসের মাথায় ফের তিনি এআই সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে আসবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা অবশ্য তাঁর সম্ভাব্য ভারত সফরের গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করছেন।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত দু’বছর ধরে চলা গাজ়া যুদ্ধে বিশ্বমঞ্চে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ইজ়রায়েল। হঠাৎ করেই প্যালেস্টাইনকে একটি পৃথক রাষ্ট্রের মান্যতা দিয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স-সহ ইউরোপের একগুচ্ছ দেশ। ইহুদি দেশটির জন্মলগ্ন থেকে এই ‘বন্ধু’রা সবসময়ে পাশে ছিল তাদের। দ্বিতীয়ত, প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ঝাড়ে-বংশে শেষ করতে গিয়ে ইহুদি ফৌজের বিরুদ্ধে উঠেছে গণহত্যার অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর দিল্লির দিকে তাকানোয় অনেক হিসাব যে উল্টে যেতে পারে, তা বলাই বাহুল্য।
সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, ডিসেম্বরে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের উদ্দেশ্য হবে দু’টো। প্রথমত, নয়াদিল্লির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করা। দ্বিতীয়ত, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিকগুলিকে নিয়ে আলোচনা। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেতানিয়াহু দেশে ফিরলে আসবেন ইহুদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাট্জ়। তাঁর সম্ভাব্য সফর আগামী বছরের জানুয়ারি বা ফ্রেব্রুয়ারিতে হতে পারে। ২০২৬ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে ইজ়রায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জ়োগও ভারতে আসবেন বলে দাবি করেছে ‘আই২৪’।
ইহুদিভূমির রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদী খোলাখুলি ভাবে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়ান, তাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অনেক বদল হয়েছে। ওই সময়ে সন্ত্রাসবাদ এবং ইসলামীয় মৌলবাদ নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোটদানে বিরত থেকে পরোক্ষ ভাবে ইহুদিদের সমর্থন করে গিয়েছে তাঁর সরকার। আর তাই নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি এবং জ্বালানির ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদারি আরও মজবুত করতে চাইছেন নেতানিয়াহু।
সাবেক সেনাকর্তারা অবশ্য ভারত এবং ইজ়রায়েলের কাছাকাছি আসার নেপথ্যে আরও একটি যুক্তি দিয়েছেন। সেটা হল, হামাসের সঙ্গে পাকিস্তানের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা। এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘মিডল-ইস্ট ফোরাম’। সেখানে বলা হয়েছে ইহুদি হামলায় গাজ়ায় কোণঠাসা হয়ে পড়া প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে ডেকে এনে নিজের ঘরে জায়গা দিচ্ছে ইসলামাবাদের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআই।
‘মিডল-ইস্ট ফোরাম’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭ অক্টোবরের হামলার পর পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন হামাসের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাজ়ি জ়াহির। সেখানে ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট দুই কুখ্যাত জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বা এবং জইশ-ই-মহম্মদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। পাশাপাশি তাঁদের আয়োজিত সম্মেলনে ভাষণ দিতেও দেখা গিয়েছে জ়াহিরকে। এটা যে ভারত এবং ইজ়রায়েল দু’টি দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে উদ্বেগজনক, তা মানছেন অনেকেই।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, ২০২৩ সালে গাজ়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পাক ভূমিতে রকেট গতিতে উত্থান হয় জ়াহিরের। সম্প্রতি প্যালেস্টাইনের সমর্থনে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পেশোয়ারে একটি বিরাট সমাবেশে ভাষণ দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সম্মেলনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে হাজির ছিলেন হামাসের আর এক শীর্ষনেতা খালেদ মাশাল। সশস্ত্র গোষ্ঠীর এই নেতাকে বর্তমানে হন্যে হয়ে খুঁজছে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ।
২০২৩ সালের ২ নভেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর শহর করাচিতে ‘তুফান-ই-আকসা’ সম্মেলনে যোগ দেন জ়াহির। ওই অনুষ্ঠানটির মূল আয়োজক ছিল ইসলামাবাদের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ‘জামিয়েত উলেমায় ইসলাম-ফজ়ল’। এদের নেতা মৌলানা ফজ়লুর রহমান বর্তমানে পাক সংসদ ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র সদস্য। সংশ্লিষ্ট সম্মেলনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেন ৭ অক্টোবরের হামলার ‘মূল চক্রী’ তথা হামাসের তৎকালীন শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়ে। গাজ়ায় যুদ্ধ চলাকালীন তাঁকে নিকেশ করে ইহুদি ফৌজ।
পরবর্তী সময়ে ইসলামাবাদ মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার রাজনৈতিক শাখা ‘পাকিস্তান মারকাজ়ি মুসলিম লিগ’-এর সমাবেশে ভাষণ দেন হামাস নেতা জ়াহির। সেটারও আয়োজন করাচিতেই করা হয়েছিল। ২৬/১১-র মুম্বই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ তথা কুখ্যাত লস্কর জঙ্গি হাফিজ় সইদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছেন ভারত এবং ইজ়রায়েলের গোয়েন্দারা। ‘পাকিস্তান মারকাজ়ি মুসলিম লিগ’-এর সম্মেলনে জ়াহিরকে হিন্দু এবং ইহুদিবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
গত বছরের জানুয়ারিতে করাচি প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করেন হামাসের এই শীর্ষ নেতা। এ ছাড়া পেশোয়ারে ‘ইজ়রায়েলের মৃত্যু’ শীর্ষক একটি সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালে পাকিস্তান সফর করেন প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির রাষ্ট্রদূত খালেদ কাদ্দৌমি। ওই সময়ে ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির এবং আইএসআইয়ের শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ২০২৪ সালে হামাসকে রীতিমতো লাল গালিচা পেতে সম্মানিত করে পাক সংসদ ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি।’’
এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদ আয়োজিত ‘কাশ্মীর সংহতি’ দিবসের অনুষ্ঠানে লশকর এবং জইশ জঙ্গি কমান্ডারদের সঙ্গে হাজির ছিলেন কাদ্দৌমি-সহ হামাসের শীর্ষ নেতারা। পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজ়েকের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) রাওয়ালকোটে বিরাট এক সম্মেলনে ভাষণ দেন তাঁরা। সেখানে প্যালেস্টাইন এবং কাশ্মীরের মুজ়াহিদিনরা (ধর্মযোদ্ধা) ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বলে জিহাদি ভাষণ দিতে শোনা যায় তাঁদের। ওই সময়ে সেই ভিডিয়োও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছিল।
হামাস নেতা খালিদ মাশালের বিরুদ্ধে ভারতে মৌলবাদ ছড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। গত বছর কেরলে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে হওয়া একটি সমাবেশে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেন তিনি। এ বছরের ৯ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের গুপ্ত ঠিকানায় বিমানহামলা চালায় ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। তাতে খালিদের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রথমে মনে করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁর বেঁচে থাকার প্রমাণ মেলে। ফলে নতুন করে তাঁর সন্ধান শুরু করেছে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ।
দোহায় ইজ়রায়েলি হামলার পর আরব দুনিয়ায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলে পাকিস্তান। সেখানে বলা হয়েছে, দু’টির মধ্যে যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও পক্ষ দ্বারা আক্রান্ত হলে তাকে যৌথ ভাবে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে রিয়াধ ও ইসলামাবাদ। এই সামরিক সমঝোতাকে যে ইহুদিরা ভাল চোখে দেখছে না, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পাক-সৌদি সামরিক চুক্তির পর বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ। প্রয়োজনে রিয়াধকে পরমাণু নিরাপত্তা দেওয়া হবে বলে স্পষ্ট করেন তিনি। এর পরই রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের হাতে আণবিক হাতিয়ার থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ইজ়রায়েল। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক বিবৃতি দেন ইহুদি নেতৃত্ব।
উল্লেখ্য, গত কয়েক মাসে পুরনো ফাটল মেরামতি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকটাই কাছে চলে গিয়েছে পাকিস্তান। পাশাপাশি, হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষ বিরতির শর্তে ইজ়রায়েলকে ঘন ঘন চাপ দিয়ে যাচ্ছেন আমেরিকার বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই পরিস্থিতিতে দ্বিরাষ্ট্রের সমর্থক ভারতে একের পর এক ইহুদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের আনাগোনা দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তায় কী ভাবে প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার।