পাহাড়ে ঘেরা সবুজ মনোরম প্রকৃতির বুক চিরে এগিয়ে আসছে ট্রেন। জানলা দিয়ে বাইরে বা নীচের দিকে চোখ রাখলে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নামতে বাধ্য। প্রতি বছর এই মনোমুগ্ধকর অথচ শিহরন জাগানো দৃশ্য উপভোগ করার টানে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমান। এটি তাইল্যান্ডের বিখ্যাত (কুখ্যাতও বটে) ‘ডেথ রেলওয়ে’।
৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলের ট্র্যাকটি কেড়ে নিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাইল্যান্ড এবং সাবেক বর্মার মধ্যে রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন হাজার হাজার যুদ্ধবন্দি ও অসামরিক ব্যক্তি। প্রতি কিলোমিটারের জন্য প্রায় ২৯ জন যুদ্ধবন্দি তাঁদের জীবন খুইয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এই রেলপথ তৈরির জন্য।
ডেথ রেলওয়ের রুট ম্যাপটি রাজধানী শহর ব্যাঙ্কক থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত রাতচাবুরির নং প্লা ডুক জংশন স্টেশন থেকে শুরু হয়েছে। ট্রেনটি কাঞ্চনাবুরি হয়ে নাম টোক পর্যন্ত যায়। কোয়াই নদীর উপত্যকা বরাবর এই রেললাইনটি নির্মিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত রেলপথটি ব্যাঙ্কক থেকে মায়ানমারের (তৎকালীন বর্মা) সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। মাত্র এক বছরের মধ্যে সুদীর্ঘ রেলপথটি তৈরি করে জাপান সরকার।
১৯৪২ সালের শেষের দিকে সিঙ্গাপুর, হংকং, ফিলিপিন্স এবং ডাচ অধিকৃত ইস্ট ইন্ডিজ়ে মিত্রশক্তির শক্তিশালী ঘাঁটিগুলি জাপান দখল করে। মিত্রশক্তির আনুমানিক ১ লক্ষ ৪০ হাজার সেনা জাপানিদের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। এ ছাড়াও, হাজার চল্লিশেক শিশু-সহ প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার নাগরিককে জাপান বন্দি করে ফেলে। মিত্রবাহিনীর যাঁরা যুদ্ধবন্দি হন, তাঁদের সিংহভাগই ছিলেন কমনওয়েলথ দেশগুলির।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রায় ২২ হাজার অস্ট্রেলীয় (যাঁদের মধ্যে ২১,০০০ সেনাবাহিনীর, ৩৫৪ জন নৌবাহিনীর এবং ৩৭৩ জন বিমানবাহিনীর সদস্য), ৫০ হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ সেনা এবং কমপক্ষে ২৫,০০০ ভারতীয় সেনা। এঁদেরই যুদ্ধবন্দি করে অক্ষশক্তির এশীয় দেশটি।
দু’টি কারণে জাপানিদের জন্য বর্মা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। চিন ও ভারতের কিছু অংশ কব্জা করার জন্য জাপান বর্মার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। জাপানিদের নিজস্ব দ্বীপপুঞ্জ এবং বর্মার মধ্যবর্তী সমুদ্রপথগুলি তেমন নিরাপদ ছিল না। বর্মা অভিযানে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য নতুন বিকল্পের প্রয়োজন ছিল জাপান সরকারের। এর জন্য স্থলপথই সবচেয়ে সরাসরি বিকল্প ছিল।
মিত্রশক্তির আক্রমণের কারণে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো বিপজ্জনক ছিল। তা ছাড়া জাহাজগুলিকে প্রায় ৩২০০ কিলোমিটার ঘুরে বর্মা পৌঁছোতে হত। জলপথ এড়াতে জাপান তাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক থেকে বর্মার রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গন) পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্মায় জাপানের ঘাঁটিগুলিকে সংযুক্ত করতে এবং ভারত মহাসাগরে নিরাপদে অনুপ্রবেশের জন্য বর্মার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজন ছিল তাদের।
মিত্রশক্তির ৬০ হাজারেরও বেশি যুদ্ধবন্দিকে বর্মা রেলওয়ে নির্মাণের কাজে লাগিয়েছিল জাপান। এই যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ব্রিটিশ, ১৩ হাজার অস্ট্রেলীয়, ১৮ হাজার ডাচ এবং ৭০০ মার্কিন সৈন্য ছিলেন। ১৯৪২ সালের জুন থেকে ১৯৪৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে তাইল্যান্ডের বান পং থেকে বর্মার থানবিউজায়াত পর্যন্ত প্রায় ৪১৯ কিমি রেলপথ তৈরি করেছিল জাপান।
সেই রেলপথের প্রতিটি ইঞ্চিতে ঝরেছিল কয়েক হাজার সামরিক ও অসামরিক যুদ্ধবন্দির রক্ত ও প্রাণ। এই এক বছরের মধ্যে একটি দিনও বাদ যায়নি যে দিন রোগ, অপুষ্টি এবং জাপানিদের নিষ্ঠুর শাস্তি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়নি যুদ্ধবন্দিদের।
যুদ্ধবন্দিদের কঠোর পরিশ্রম করানো এবং শারীরিক নির্যাতন তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খাবারের কষ্ট। অর্ধাহার ও অনাহারে বহু বন্দি মারা যান ওই এক বছরের মধ্যে। খাদ্যের চরম অপ্রতুলতা দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখতেন জাপানি সেনারা। বন্দিদের যৎসামান্য খাবার সরবরাহ করার নির্দেশ ছিল উপরমহলের।
প্রতি দিনের খাবারের তালিকায় থাকত অল্প পরিমাণে সেদ্ধ ভাত এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া মাংস বা মাছ। সেই খাবারেও মেশানো হত ইঁদুরের বিষ্ঠা ও পোকামাকড়। গলা ভেজানোর পর্যাপ্ত জল পর্যন্ত মিলত না বন্দিদের। বন্দিরা অপুষ্টি, জলশূন্যতার কারণে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা করেননি জাপানিরা। মিত্রবাহিনীর চিকিৎসকেরা অসুস্থ এবং আহতদের কষ্ট লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তাতেও আটকানো যায়নি মৃত্যু।
বন্দিশিবিরের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পরিবেশের কারণে নানা রোগ ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রেলপথ নির্মাণে নিযুক্ত বন্দিদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশির মৃত্যুর জন্য অমাশয় এবং ডায়েরিয়াই দায়ী ছিল। অন্যান্য রোগের মধ্যে ছিল কলেরা, ম্যালেরিয়া এবং আলসার। সীমিত উপকরণ ও ওষুধের অপ্রতুলতার কারণে অসুস্থদের চিকিৎসা করাও কঠিন ছিল।
জাপানিরা চেয়েছিল রেলপথটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করতে। প্রস্তাবিত রুটের পুরো দৈর্ঘ্য জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক বন্দিকে নিয়ে এক একটি ইউনিট গড়া হয়েছিল। ঘন জঙ্গল ও অসমতল পাথুরে জমিকে সমান করে রেলপথ বসানোর মতো হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হত যুদ্ধবন্দিদের। বেশির ভাগ কাজে অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
নদী এবং গিরিখাতগুলিতে সেতুনির্মাণ করতে হয়েছিল। পাহাড়ের কিছু অংশ কেটে ন্যারো গেজ ট্র্যাকটি বসানোর জন্য সোজা এবং সমতল মাটি তৈরি করতে হয়েছিল। রেলপথের দীর্ঘতম এবং গভীরতম খাঁজগুলি তাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি থেকে ৭২ কিমি উত্তর-পশ্চিমে কোন্যুতে তৈরি করতে হয়েছিল। কোন্যুতে প্রথম খাঁজটি প্রায় ১,৫০০ ফুট (৪৫০ মিটার) লম্বা এবং ২৩ ফুট (৭ মিটার) গভীর ছিল। দ্বিতীয়টি প্রায় ২৫০ ফুট (৭৫ মিটার) লম্বা এবং ৮০ ফুট (২৫ মিটার) গভীর ছিল।
জাপানি কৌশল এবং যুদ্ধবন্দি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য সত্ত্বেও বর্মা রেলওয়ের কাজের গতি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পিছিয়ে যায়। ১৯৪৩ সালের জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে ‘স্পিডো’ নামের একটি কুখ্যাত নিয়ম চালু হয়। দৈনিক ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হত শ্রমিকদের। না পারলে চলত অকথ্য অত্যাচার। এই সময়কালে শ্রমিকদের অবস্থার আরও দ্রুত অবনতি ঘটে।
জাপানিরা মিত্রবাহিনীর বন্দিদের কাজের গতিতে সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে বন্দিদের নৃশংস শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হত। ‘হেলফায়ার পাস’ নামের একটি অংশ তৈরি করতে প্রায় ৭০০ বন্দির মৃত্যু হয়েছিল। সময় নষ্ট না করে রেলপথকে সঠিক সময়ে শেষ করার মরিয়া প্রচেষ্টায় দিনরাত কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁদের।
স্পিডোর সময়কালে খুব কমই এমন একটি দিন কাটত যেখানে বন্দির মৃত্যু হত না। হতাহতের হার তীব্র ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বন্দিদের দিকে জাপানি রক্ষীদের আক্রমণাত্মক ভাবে ‘স্পিডো! স্পিডো!’ বলে চিৎকার করতে শোনা যেত। আরও কঠোর শাস্তি দিয়ে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করা হত।
রেলপথ নির্মাণে কাজ করতে বাধ্য করা ৬০ হাজারেরও বেশি যুদ্ধবন্দির মধ্যে প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মিত্রবাহিনীও নির্মাণকাজ ব্যাহত করার জন্য বিমান হামলা চালায়। ফলে আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই পরে জাপানের কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন দীর্ঘকাল। সেখানেও তাঁদের সঠিক চিকিৎসা মেলেনি।