Japan’s Railgun

কামানের নল দিয়ে বেরোবে না গোলা, তবু ধ্বংস হবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র! আতঙ্কের নাম জাপানি ‘রেলগান’

তিন দিনের প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে নতুন প্রজন্মের হাতিয়ার প্রকাশ্যে আনল জাপান। ওই অস্ত্রের সাহায্যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে বলে দাবি করেছে টোকিয়ো।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ ০৭:৩৩
Share:
০১ ১৮

এক দিকে চিনা নৌবাহিনীর দৌরাত্ম্য। অন্য দিকে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার নামে উত্তর কোরিয়ার উৎপাত। জোড়া ফলায় জাপানের কাহিল দশা। এ-হেন চাপের মুখে আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের প্রযুক্তি তৈরি করে ফেলল প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দ্বীপরাষ্ট্র। নতুন প্রজন্মের অস্ত্রটিকে রণতরী রক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে টোকিয়ো। শুধু তা-ই নয়, প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির একটি মডেল প্রকাশ্যে এনে গোটা বিশ্বকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’।

০২ ১৮

জাপানি প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের তৈরি ওই অস্ত্রের নাম ‘রেলগান’। এতে অবশ্য কোনও বারুদের ব্যবহার করেননি তাঁরা। তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির সাহায্যে এই হাতিয়ার চোখের নিমেষে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করবে বলে দাবি করেছে টোকিয়ো। পাশাপাশি, ড্রোন এবং ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকেও আটকে দেবে উচ্চ গতি সম্পন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই ‘রেলগান’।

Advertisement
০৩ ১৮

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, বর্তমানে শুধুমাত্র জাপানের হাতে এই প্রযুক্তি রয়েছে, তা ভাবলে ভুল হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি-সহ বেশ কিছু দেশ এই ধরনের হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই দেশগুলিতে সংশ্লিষ্ট অস্ত্রটির আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। যদিও এই তথ্য মানতে নারাজ ‘সূর্যোদয়ের দেশ’। টোকিয়োর দাবি, বিশ্বে প্রথম এ ব্যাপারে ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছে তারা।

০৪ ১৮

২০২৪ সালে যুদ্ধজাহাজের প্রতিরক্ষায় ‘রেলগান’-এর সফল পরীক্ষা করেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এ বছরের প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে হাতিয়ারটির মডেল প্রথম বার প্রকাশ্যে এনে সবাইকে চমকে দেয় টোকিয়ো। সেখানেই অস্ত্রটিকে নিয়ে মুখ খোলেন জাপানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক পদস্থ আধিকারিক। সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘রেলগান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অত্যাধুনিক বন্দুক। এটা দিয়ে কোনও বুলেট বা কামানের গোলা ছোড়া যায় না। বৈদ্যুতিন শক্তির সাহায্যে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সিদ্ধহস্ত এই হাতিয়ার।’’

০৫ ১৮

চলতি বছরের ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত চলা প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে ‘রেলগান’ ছাড়াও একাধিক অত্যাধুনিক হাতিয়ারকে প্রকাশ্যে আনে জাপান। গত কয়েক বছর ধরেই ক্রমাগত চিন এবং উত্তর কোরিয়ার ‘উৎপাতে’ অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ হঠাৎ করেই বৃদ্ধি করেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দ্বীপরাষ্ট্র। পাশাপাশি, অস্ত্র রফতানি করে রোজগারের পরিকল্পনাও রয়েছে টোকিয়োর। প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে সেই লক্ষ্যেও সেখানকার সংস্থাগুলিকে এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে।

০৬ ১৮

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ়ের কথা বলা যেতে পারে। অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট শ্রেণির যুদ্ধজাহাজের বরাত পেতে জার্মানির থাইসেন ক্রুপ মেরিন সিস্টেমসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে এই জাপানি প্রতিরক্ষা সংস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে মিৎসুবিশির নাম ছিল দুনিয়াজোড়া। যদিও শেষ দু’দশকে সেই সুনাম তারা ধরে রাখতে পারেনি। ক্যানবেরার থেকে রণতরী নির্মাণের বরাত পেলে ধীরে ধীরে টোকিয়োর সংস্থাটি পুরনো অবস্থান ফিরে পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

০৭ ১৮

অন্য দিকে জাপানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, তাদের তৈরি ‘রেলগান’ গোলা ছুড়তে না পারলেও ‘প্রজেক্টাইল’ উৎক্ষেপণ এবং নিক্ষেপে সক্ষম। এর জন্য বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করবে ওই হাতিয়ার। ফলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে রুখে দেওয়ার মতো গতি পাবে এর ‘প্রজেক্টাইল’। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির পাল্লা বা সেটি একসঙ্গে কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্রকে নিশানা করতে পারবে, তা জানা যায়নি।

০৮ ১৮

‘রেলগান’-এর পাশাপাশি নৌ-ড্রোন, টাইপ-১২ ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সংস্করণ, লড়াকু জেট এবং ইউনিকর্ন ইন্টিগ্রেটেড অ্যান্টেনা সিস্টেমের মতো হাতিয়ারকে ওই প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিশ্বের সামনে আনে জাপানে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি ক্রমাগত লেজ়ার অস্ত্রের সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সেই ধরনের একটি হাতিয়ারও প্রদর্শনীটিতে দেখা গিয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিমাংশের দ্বীপগুলির নিরাপত্তাকে মজবুত করতে সেটি ইতিমধ্যেই মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে টোকিয়ো।

০৯ ১৮

জাপানি ওই লেজ়ার অস্ত্রটির নাম গ্রাউন্ড সেল্‌ফ ডিফেন্স ফোর্স। এর স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর সক্ষমতা রয়েছে। টোকিয়োর দাবি, এটি ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল খরচ। নামমাত্র ব্যয়ে লেজ়ার রশ্মি ব্যবহার করে পর পর ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করা যাবে বলে দাবি করেছে টোকিয়ো। তবে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে এটি কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

১০ ১৮

এ ছাড়া প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীতে হাইপার-ভেলোসিটি গ্লাইডিং প্রজেক্টাইল নামের একটি অস্ত্রের ভিডিয়ো দেখিয়েছে জাপান। ২০২৬ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে সুপারসনিক এই অস্ত্রটি তৈরি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছে টোকিয়ো। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এর সঙ্গে ভারতীয় বায়ুসেনার ব্যবহৃত হ্যামার বোমার বেশ মিল রয়েছে। বাতাসে বেশ কিছু ক্ষণ ভেসে থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে হামলা চালাতে পারবে এই গ্লাইডিং প্রজেক্টাইল। উল্লেখ্য, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিদের গুপ্তঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে হ্যামার বোমা ব্যবহার করেছিল ভারতীয় বিমানবাহিনী।

১১ ১৮

‘রেলগান’-এর পাশাপাশি জাপানের তৈরি আর একটি হাতিয়ারও সকলের নজর কেড়েছে। সেটি হল উভচর ড্রোন। মানববিহীন ওই যানের পোশাকি নাম ‘শিনমায়ওয়ার এক্সইউ-এম’ রেখেছে টোকিয়ো। উপকূল সংলগ্ন যে কোনও নৌঘাঁটিতে হামলা চালানোর লক্ষ্যে এর নকশা তৈরি করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের একাংশ একে ডুবোজাহাজ ড্রোন বলেও উল্লেখ করেছেন।

১২ ১৮

লিথিয়াম ব্যাটারিযুক্ত সংশ্লিষ্ট উভচর ড্রোনের সাহায্যে যে কোনও রণতরীতে হামলা চালানো যাবে। তবে ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজে এর সাহায্যে বড় ক্ষতি করা সম্ভব। আবার প্রয়োজনে সাঁজোয়া গাড়ি বা শত্রুর ট্যাঙ্ককে নিশানা করতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। টোকিয়োর দাবি, তাদের তৈরি বিশেষ ধরনের এই মানববিহীন যানটি নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে।

১৩ ১৮

সংশ্লিষ্ট প্রদর্শনীটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির থেকে নাম না করে চিনকে নিশানা করেন জাপানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী নাকাতানি। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ কেউ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক শান্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। টোকিয়ো সেটা কখনওই বরদাস্ত করবে না।’’ তবে প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য ঝিমিয়ে পড়া হাতিয়ার ব্যবসাকে চাঙ্গা করা বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

১৪ ১৮

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির নিরাপত্তার দায়িত্ব একরকম নিজের কাঁধে নিয়ে রেখেছে আমেরিকা। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কুর্সিতে আসার পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে। বেশ কয়েক বার তাঁকে প্রকাশ্যেই জাপানের নিরাপত্তা দেওয়া সংক্রান্ত চুক্তি ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে। ফলে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’টির রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগ্রাসী চিনকে নিয়ে আতঙ্ক কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৫ ১৮

দীর্ঘ দিন ধরেই দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের বেশ কয়েকটি দ্বীপকে কব্জা করার চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। জাপান সাগরের উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সুপ্ত বাসনাও রয়েছে বেজিঙের। তা ছাড়া তাইওয়ানকে স্বাধীন সতন্ত্র দেশ হিসাবে মানতে নারাজ ড্রাগন সরকার। সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপকে চিনেরই অংশ বলে বার বার ঘোষণা করেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

১৬ ১৮

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আগামী দিনে তাইওয়ানকে কব্জা করতে ওই দ্বীপরাষ্ট্রে হামলা চালাবে চিন। এতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই এলাকার পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। কারণ, নিরাপত্তার স্বার্থেই তখন আর চুপ করে বসে থাকবে না জাপান। বেজিঙের আগ্রাসন বন্ধ করতে গত বছরই আমেরিকার কাছে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের আর্জি জানিয়েছিল টোকিয়ো। যদিও তা পত্রপাঠ খারিজ করে দেয় ওয়াশিংটন।

১৭ ১৮

ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চতুঃশক্তি জোট কোয়াডের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল জাপান। এই গোষ্ঠীর দেশগুলির একসঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি গড়ে তোলা উচিত বলে মনে করে টোকিয়ো। যদিও তাতে সায় নেই নয়াদিল্লির। সেই কারণে সামরিক শক্তিজোট হিসাবে এখনও আত্মপ্রকাশ করেনি কোয়াড।

১৮ ১৮

বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, চিনা আগ্রাসন যে ভাবে বাড়ছে তাতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি না করে জাপানের কাছে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। ফলে ভারতের সঙ্গে আলাদা করে অস্ত্র চুক্তি করতেই পারে টোকিয়ো। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর নয়াদিল্লির একাধিক হাতিয়ারের কদর বিশ্ব বাজারে বেড়েছে। সেগুলি বাহিনীর হাতে তুলে দিতে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি এগিয়ে আসে কি না, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement