গল্পে নেই ফেলুদা-তোপসে-জটায়ু। হেমাঙ্গ হাজরা এবং মন্দার বসুর উপস্থিতিও মেলেনি। তবে, চার বছরের বালিকার সঙ্গে যেন সাদৃশ্য ছিল ‘সোনার কেল্লা’র মুকুলের। ‘পূর্বজন্মের কথা’ অনর্গল বলে যেত সেই বিস্ময় বালিকা। তাকে নিয়ে এমন চর্চা শুরু হয়েছিল যে, মহাত্মা গান্ধীও তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এমনকি, ছোট্ট মেয়েটির কথার সত্যতা যাচাই করতে বিশেষ কমিটি গঠনের নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি।
১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে জন্ম শান্তি দেবীর। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে ভরে থাকত মা-বাবার সংসার। ছোটবেলা থেকে কোনও রকম দুরন্তপনা ছিল না শান্তির। এমনকি, মুখ ফুটে কথাও বলত না সে। তা নিয়ে খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন শান্তির বাবা-মা।
চার বছর বয়স থেকে কথা বলতে শুরু করেছিল শান্তি। তবে ইহজীবনের চেয়ে ‘পূর্বজন্মের কথা’ই বেশি বলত সে। শান্তির দাবি ছিল, তার নাকি ‘পুনর্জন্ম’ হয়েছে। বার বার শ্বশুরবাড়ি, সংসারের কথা বলত সে। মনগড়া কাহিনি ভেবে শান্তির বাবা-মা এই ঘটনাটিকে প্রথমে বিশেষ আমল দিতে চাননি। কিন্তু দিনের পর দিন শান্তির মধ্যে এই নিয়ে আলোচনা করার প্রবণতা বাড়তেই থাকে।
চিন্তিত হয়ে চিকিত্সকের পরামর্শ নেন শান্তির বাবা। শান্তি তখন সেই চিকিত্সককে জানায় যে, আগের জীবনে নাকি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিল সে। এমনকি, চিকিত্সা চলাকালীন কী কী সমস্যা হয়েছিল তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেয় শান্তি। বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া এই বিষয়গুলি জানা অসম্ভব, দাবি করেন সেই চিকিত্সক।
শান্তি নিজের পরিচয় দিত ‘চৌবের স্ত্রী’ হিসাবে। দাবি করত, ‘পূর্বজন্মে’ তার শ্বশুরবাড়ি ছিল মথুরায়। তার স্বামী সেখানকার একটি কাপড়ের দোকানের মালিক। স্বামীর পদবি উল্লেখ করলেও কিছুতেই তাঁর নাম মুখে আনত না শান্তি। কেউ তার স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করলেই লজ্জায় রাঙা হয়ে যেত শান্তির মুখ।
মথুরায় যাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই জেদ ধরত শান্তি। স্বামীর নাম মুখে না আনলেও মথুরা গেলে সে যে সরাসরি সকলকে তার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানায় নিয়ে যেতে পারে, সেই দাবিও করত শান্তি। ‘পূর্বজন্মে’ সে কী ধরনের পোশাক পরত, কী কী খেতে ভালবাসত— সে সমস্ত জানিয়ে মাকে অতীত জীবনের গল্প শোনাত শান্তি।
শান্তির দাবি ছিল, তার স্বামীর মথুরায় এক মন্দিরের সামনে কাপড়ের দোকান রয়েছে। তাঁর গায়ের রং ফর্সা, এমনকি তাঁর ডান কানের কাছে গালের উপর একটি বড় তিল রয়েছে সে কথাও জানিয়েছিল শান্তি। পরে শান্তির এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় তাকে মথুরা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে তার জন্য একটি শর্তও রাখেন তিনি।
দিল্লির এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন বাবু বিষনচাঁদ। শান্তির পরিবারের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন তিনি। শান্তি যে বার বার তার ‘পুনর্জন্মের কথা’ বলছে তা শুনে অবাক হয়ে যান বিষনচাঁদ। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চান তিনি। শান্তিকে তিনি প্রস্তাব দেন যে, সে যদি তার স্বামীর নাম-ঠিকানা বলে ফেলে তা হলে অবিলম্বে তাকে মথুরা নিয়ে যাবেন তিনি।
স্বামীর সঙ্গে দেখা করার লোভ সংবরণ করতে পারে না শান্তি। শেষ পর্যন্ত স্বামীর নাম উল্লেখ করে সে। শান্তি জানায় যে, তার স্বামীর নাম কেদারনাথ চৌবে। সম্পূর্ণ ঠিকানাও জানায় সে। ন’বছরের বালিকার মুখে সব শুনে সত্যতা যাচাই করতে সেই ঠিকানায় কেদারনাথের উদ্দেশে চিঠি লেখেন বিষনচাঁদ। সেই চিঠির উত্তরও পান তিনি। চিঠির উত্তর দেন শান্তির ‘পূর্বজন্মের স্বামী’ কেদারনাথ।
শান্তি তার ‘পূর্বজন্ম’ নিয়ে যে সব ঘটনার উল্লেখ করেছে, সব কিছুই চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলেন বিষনচাঁদ। সেই ঘটনার বৃত্তান্ত যে সমস্তই সত্যি তা জানান কেদারনাথ। তবুও মনে সন্দেহ ছিল তাঁর। তিনি নিজে দিল্লি যাওয়ার আগে তাঁর এক আত্মীয়কে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য শান্তির বাড়িতে পাঠান।
কাঞ্জিমল নামে দিল্লিতে এক আত্মীয় থাকতেন কেদারনাথের। কথামতো শান্তির বাড়ি যান তিনি। কাঞ্জিমলকে দেখেই চিনতে পারে শান্তি। সে জানায়, কাঞ্জিমল নাকি কেদারনাথের তুতো ভাই। সে কথা সত্য বলে স্বীকার করেন কাঞ্জিমল। সব শুনে কেদারনাথও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে মথুরা থেকে দিল্লি যান।
শান্তির ‘পূর্বজন্মের’ নাম ছিল লুগদি দেবী। ১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে মথুরায় জন্ম হয়েছিল লুগদির। ১০ বছর বয়সে কেদারনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। কেদারনাথের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেছিলেন তিনি। লুগদি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী।
বিয়ের পর ধর্মকর্মে মন দিয়েছিল লুগদি। ভারতের অধিকাংশ তীর্থস্থান কম বয়সেই দর্শন করে ফেলেছিল সে। এক বার তীর্থযাত্রায় গিয়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছিল লুগদি। সে কারণে মথুরা এবং আগরায় চিকিত্সা চলেছিল তার।
জন্ম নেওয়ার পরমুহূর্তেই প্রথম সন্তানের মৃত্যু হয়েছিল লুগদির। দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সময়ে আগরার এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল তাকে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিল লুগদি। কিন্তু সন্তানের জন্ম দেওয়ার ন’দিন পর মারা গিয়েছিল সে।
লুগদির মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করেছিলেন কেদারনাথ। তাঁর বর্তমান স্ত্রী এবং পুত্র নবনীতলালকে নিয়ে মথুরা থেকে দিল্লিতে শান্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেদারনাথ। প্রথম সাক্ষাতে নিজেকে কেদারনাথের বড় ভাই বলে শান্তির কাছে পরিচয় দিয়েছিলেন কেদারনাথ। কিন্তু কেদারনাথকে দেখে চিনতে পারে শান্তি। কেদারনাথের প্রিয় খাবার রাঁধার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে।
নবনীতলালকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে শান্তি। এমনকি, কেদারনাথ পুনরায় বিয়ে করেছে দেখে মান-অভিমানের পালা চলে। কেদারনাথ নাকি তাকে কথা দিয়েছিলেন যে, লুগদির মৃত্যুর পর অন্য কাউকে বিয়ে করবেন না তিনি। কথা দিয়েও তা রাখেননি বলে কেদারনাথের উপর অভিমান করে বসে শান্তি।
শান্তির সঙ্গে একান্তে কথা বলে কেদারনাথ দাবি করেন যে, সে-ই আসলে লুগদি। এমন কিছু কথা যা কেবল লুগদির পক্ষেই জানা সম্ভব তা কেদারনাথকে অকপটে বলে ফেলে শান্তি। কেদারনাথের সঙ্গে মথুরায় ফিরতে চাইলে শান্তিকে বাধা দেন তার বাবা-মা।
শান্তিকে নিয়ে তুমুল চর্চা শুরু হয়। বালিকা যে সাক্ষাত্ ‘জাতিস্মর’ সে কথা পৌঁছে যায় মহাত্মা গান্ধীর কানেও। শান্তিকে নিজের আশ্রমে ডেকে আলাপ করেছিলেন তিনি। তার পর ঘটনার সত্যতা বিচার করতে তিনি একটি কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে শান্তিকে নিয়ে মথুরার উদ্দেশে রওনা হন তদন্ত কমিটির সদস্যেরা। কেদারনাথের বাড়ি, লুগদির বাপের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় শান্তিকে। সেখানে গিয়ে হাতের তালুর মতো সব কিছু চিনে ফেলে শান্তি। এমনকি, শ্বশুরবাড়িতে কোন ফুলদানির তলায় লুগদি টাকা জমিয়ে রেখেছিল, তা-ও স্পষ্ট বলে দেয় শান্তি।
কেদারনাথ জানান যে, লুগদির মৃত্যুর পর তিনি সত্যিই ফুলদানির তলায় টাকা পেয়েছিলেন। মথুরার স্থানীয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে শুরু করে শান্তি। তাকে দেখার জন্য স্থানীয়েরা ভিড় জমাতে শুরু করেন। সেই ভিড়ের মধ্যে অনেক আত্মীয়কেও চিনতে পারে শান্তি। সকলেই ছিলেন লুগদির নিকটাত্মীয়।
১৯৩৬ সালে কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টে লেখা ছিল, লুগদি দেবী আসলে শান্তি দেবী নামে পুনর্জন্ম নিয়েছেন। সেই সময় আরও দু’টি পৃথক রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছিল। দু’টি রিপোর্টই মহাত্মা গান্ধীর গঠন করা কমিশনের রিপোর্টকে খণ্ডন করেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, শান্তি দেবীর দাবির প্রেক্ষিতে এমন কোনও মজবুত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা তার পুনর্জন্মের তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।
আজীবন অবিবাহিত থেকে গিয়েছিলেন শান্তি দেবী। জীবদ্দশায় অসংখ্য বার ‘পুনর্জন্মের গল্প’ শুনিয়েছিলেন তিনি। এমনকি, মৃত্যুর চার দিন আগেও সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন শান্তি।
১৯৮৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর মারা যান শান্তি। তাঁর ‘পুনর্জন্মের গল্প’ আজও লোকমুখে চর্চিত। পুনর্জন্মে বিশ্বাসী লোকজন শান্তির কাহিনি বিশ্বাস করলেও পুনর্জন্মের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি শান্তির বাস্তবের ‘মুকুল’ হয়ে ওঠা নিয়েও রহস্য থেকে গিয়েছে।