২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় বরফে ঢাকা হিমালয়ের বুকে গুপ্তচরদের অভিযানে বিপত্তি। আচমকাই একটি পরমাণু-চালিত নজরদারি যন্ত্র হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। সেই ঘটনার ৫৬ বছর পর ভয়াবহ বন্যায় ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় দু’টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রাণ হারান ৮০ জন, নিখোঁজ ১২৪। ওই আণবিক নজরদারি যন্ত্রের জন্যেই কি বিপর্যয়? গলেছে বরফ, নেমেছে তুষারধস? প্রশ্নগুলি উঠতেই শুরু হয়ে গিয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সময়টা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি। ভয়াবহ বন্যায় ভেসে যায় উত্তরাখণ্ড। পরবর্তী কালে এর কারণ খুঁজতে গিয়ে বিস্ফোরক তত্ত্বের উল্লেখ করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, রন্টি শৃঙ্গের কাছে একটি ঝুলন্ত হিমবাহে ধসের ফলে ঘটেছে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এর পরেই ১৯৬৫ সালে নন্দা দেবীতে ভারত-মার্কিন যৌথ অভিযানে হারিয়ে যাওয়া পরমাণু নজরদারি যন্ত্রকে কেন্দ্র করে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা।
বিজ্ঞানীদের যুক্তি ছিল, বিরাট একটা পাথর খসে গিয়ে রন্টি শৃঙ্গ সংলগ্ন হিমবাহের উপরে পড়লে সমস্যার সূত্রপাত হয়। ঠিক ওই সময়েই নামে তুষারধস। জোড়া ধাক্কা সংশ্লিষ্ট হিমবাহটি সহ্য করতে পারেনি। এতে যথেষ্ট তাপ নির্গত হয়েছিল। ফলে হিমবাহের গলনে হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায় ঋষিগঙ্গা ও ধৌলিগঙ্গার জলস্তর। এর জেরে দু’টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় হড়পা বান। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে দেখা দেয় বন্যা।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলেই বার বার আমজনতার আলোচনায় ফিরে আসে নন্দা দেবীর হারিয়ে যাওয়া প্লুটোনিয়াম মিশনের প্রসঙ্গ। এর আগে ২০২১ সালের দুর্যোগ বা ২০১৮ সালে মেঘভাঙা বৃষ্টির সময়েও এই নিয়ে ওই এলাকায় তীব্র হয় জল্পনা। জোশীমঠে ভূমিধসের ক্ষেত্রেও একই রকমের প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে।
সূত্রের খবর, চিনের পরমাণু কর্মসূচির উপরে নজরদারির উদ্দেশ্যে বিশ্বের ২৩তম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নন্দা দেবীতে ওই আণবিক যন্ত্রটিকে বসানোর পরিকল্পনা করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ এবং ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বা আইবি। এর জন্য যৌথ ভাবে একটি গোপন অভিযান পরিচালনা করে তারা। যদিও তাতে শেষ পর্যন্ত সাফল্য আসেনি।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, ১৯৬৫ সালে তুষারঝড়ে হারিয়ে যাওয়া পরমাণু নজরদারি যন্ত্রটিকে পরবর্তী কালে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ভারত। এর পর তাতে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং করে নয়াদিল্লি। এ দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য ছিল যন্ত্রটির গঠনতন্ত্র বুঝে নেওয়া। যদিও এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কখনওই কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্র।
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘শীত যুদ্ধ’-এ জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। ওই সময়ে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিল কমিউনিস্ট চিন। ১৯৬৪ সালে জিনজিয়াংয়ের লোপ নুর শহরে প্রথম পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা চালায় বেজিং। এতে প্রমাদ গোনে পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই ড্রাগনের হাতে থাকা গণবিধ্বংসী হাতিয়ারের ক্ষমতা জানতে উঠেপড়ে লেগেছিল সিআইএ।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের হাতে পর্যুদস্ত হওয়ায় বেজিঙের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক চলে যায় তলানিতে। ফলে ড্রাগনের পরমাণু বোমার পরীক্ষাকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি এ দেশের গোয়েন্দারা। এই পরিস্থিতিতে মান্দারিনভাষীদের উপরে নজরদারির প্রশ্নে ধীরে ধীরে কাছাকাছি আসে ভারত ও আমেরিকা। দু’পক্ষই চিনের পরমাণু পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত ভূ-কম্পন এবং রেডিয়োলজিক্যাল তথ্য সংগ্রহে মরিয়া ছিল।
ওই সময়ে কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা ততটা উন্নত হয়নি। আর তাই তিব্বত সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ‘রেডিয়ো আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর’ বা আরটিজি বসানোর নীলনকশা ছকে ফেলে আমেরিকা। পরমাণুচালিত ওই যন্ত্রের কোড নাম ছিল ‘গুরু রিনপোচ’। ৭,৮১৭ মিটার উচ্চতার নন্দা দেবী শৃঙ্গের কাছে একটি শৈলশিরায় একে বসানো হবে বলে ঠিক করেন তাঁরা।
‘গুরু রিনপোচ’কে বসানোর ব্যাপারে ভারতের সম্মতি ছিল ষোলো আনা। মার্কিন গুপ্তচরদের সঙ্গে এই যৌথ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মোহন সিংহ কোহলি। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘শেরপাস, দ্য হিমালয়ান লেজেন্ডস’ বইয়ে এর পুঙ্খনুপুঙ্খ উল্লেখ করেন তিনি। পর্বতারোহণে দক্ষতা পেতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ’ বা আইটিবিপিতে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন মোহন।
নিজের লেখা বইয়ে ক্যাপ্টেন মোহন জানিয়েছেন, ১৯৬৫ সালের ২৩ জুন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে নয়াদিল্লি ফিরে আসেন তিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নন্দা দেবীর গোপন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়ার নির্দেশ পান। নৌসেনার এই দুঁদে অফিসার জানতে পারেন ভারত ও আমেরিকার শীর্ষ স্থানীয় কয়েক জন পর্বতারোহী, গোয়েন্দাকর্তা, পরমাণু বিজ্ঞানী এবং সাহসী বিমানচালকদের একটি দল এই অভিযানে থাকবে। ফলে এর গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁর।
সংশ্লিষ্ট অভিযান শুরুর আগে আইবির শীর্ষ গোয়েন্দাকর্তা বলবীর সিংহের সঙ্গে আলাপ হয় ক্যাপ্টেন মোহনের। বলবীর তাঁকে রামেশ্বর নাথ কাওয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আইবির ‘অ্যাভিয়েশন রিসার্চ সেন্টার’-এ কর্মরত ছিলেন তিনি। কাওয়ের ব্যবহার, তীক্ষ্ম বুদ্ধি এবং কর্মপদ্ধতি ক্যাপ্টন মোহনের নজর কেড়েছিল। সংশ্লিষ্ট অভিযানের তিন বছরের মাথায় ১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠা পায় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা র। কাও ছিলেন তার প্রথম ডিরেক্টর।
আইবি কর্তা বলবীরের সঙ্গে আলাপ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন মোহন জানতে পারেন জরুরি কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে তাঁকে। সেই সময়ে কোনও পাসপোর্ট ছিল না তাঁর। কিন্তু, রাতারাতি সেটা তাঁর হাতে তুলে দেন গোয়েন্দা কর্তারা। আমেরিকা গিয়ে অভিযানের যাবতীয় খুঁটিনাটি সম্পর্কে অবগত হন মোহন। বুঝতে পারেন নন্দা দেবীর শৈলশিরায় স্থাপন করতে হবে আরটিজি-কে, যার মূল কাজ হল তাপ, ভূমিকম্পের তরঙ্গ এবং বিকিরণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ।
এ-হেন নজরদারিতে ব্যবহৃত ‘গুরু রিনপোচ’কে বছরের পর বছর রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই সজীব রাখতে তাতে তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা। কারণ ওই এলাকায় কোনও বিদ্যুৎ ছিল না। যন্ত্রটার ওজন ছিল ৫০ কেজির বেশি। সেটিকে টেনে তুলতে এক ডজনের বেশি লোকের প্রয়োজন ছিল। সেইমতো গোটা অভিযানের পরিকল্পনা করেন ক্যাপ্টেন মোহন এবং সিআইএ-র গুপ্তচরেরা।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সিআইএ এবং আইটিবিপি এবং শেরপাদের একটি দল নিয়ে নন্দা দেবীর কাছে পৌঁছোন কোহলি। তাঁদের সঙ্গে ছিল ওই নজরদারি যন্ত্র। ঠিক হয়, প্রথমে একটি দল নন্দা দেবীর উপরে উঠে যন্ত্রটির সরঞ্জামগুলিকে একত্রিত করবে। এর পর দ্বিতীয় দলটি সেখানে পৌঁছে চালু করবে সংশ্লিষ্ট যন্ত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে সব কিছুই চলছিল পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু হঠাৎ করেই বাদ সাধে প্রকৃতি।
১৬ অক্টোবরের মধ্যে নন্দা দেবী সংলগ্ন চার নম্বর বেস ক্যাম্পে পৌঁছে যায় অভিযাত্রীদের দল। ঠিক তখনই শুরু হয় প্রবল তুষারঝড়। ফলে যখন-তখন তুষারধস নামতে পারে বুঝতে পেরে অভিযান বাতিল করেন ক্যাপ্টেন কোহলি। ওই সময়ে দৃশ্যমানতাও মারাত্মক ভাবে কমে গিয়েছিল।
এই অবস্থায় ৫০ কেজির বেশি ওজনের পরমাণু শক্তিচালিত নজরদারি যন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে ফেরা অভিযাত্রীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে বাধ্য হয়ে পাহাড়ের গায়ে একটি ফাটলের মধ্যে সেটিকে আটকে দেন ক্যাপ্টেন কোহলি। ঠিক হয় তুষারঝড় থামলে সেটি উদ্ধার করবেন তাঁরা। পরের বছরের (পড়ুন ১৯৬৬ সাল) আগে অবশ্য ওই এলাকায় আর কোনও অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি ভারত ও আমেরিকা।
মজার বিষয় হল, ১৯৬৬ সালে নন্দা দেবীতে ফিরে গিয়ে যন্ত্রটির আর কোনও হদিস পায়নি অভিযাত্রীদের দল। কোহলি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘‘আরটিজি-কে খুঁজে পেতে শেরপারা কম চেষ্টা করেননি। তবে আমার বিশ্বাস মারাত্মক তুষারঝড় এবং তুষারধস সেটিকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কয়েক দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর তাই আমাদের শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়।’’
নন্দা দেবীর এই গোপন অভিযানে ব্যর্থতার কথা সরকারি ভাবে স্বীকার করে আমেরিকা। সিআইএ-র নথি অনুযায়ী, যন্ত্রটিকে খুঁজে পেতে ওই এলাকায় মোট দু’বার যৌথ ভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনওটাতেই সাফল্য আসেনি। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ভাবে কোনও তথ্য দেয়নি ভারত।
২০০৩ সালে ক্যাপ্টেন কোহলির বই প্রকাশিত হলে গোটা দুনিয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ঘটনার কথা জানতে পারে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দারাও। এর পর থেকেই তাঁদের মধ্যে ছড়িয়েছে চাপা আতঙ্ক। তাঁরা মনে করেন সংশ্লিষ্ট যন্ত্রটি থেকে পরমাণু বিকিরণের জেরেই বিভিন্ন হিমবাহে শুরু হয়েছে গলন। বার বার নামছে তুষারধস। ফলে হড়পা বান, বন্যা বা ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। যদিও ওই এলাকায় পরমাণু বিপর্যয়ের কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি।