প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় শান্তি ফেরাতে এ বার সৈনিক ভাড়া দেবে পাকিস্তান! এই জন্য চৈত্র সেলের মতো ইজ়রায়েলের সঙ্গে চলছে তুমুল দরদস্তুর। সূত্রের খবর, জওয়ানপ্রতি ১০ হাজার ডলার দাম হেঁকেছেন ইসলামাবাদের ‘সিপাহসালার’ আসিম মুনির। অন্য দিকে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজের জন্য এতটা খরচ করতে নারাজ ইহুদি সরকার। বরং মাথাপিছু বড়জোর ১০০ ডলার দিতে চাইছে তেল আভিভ। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও তথ্য দেয়নি দু’পক্ষ।
সংবাদসংস্থা সিএনএন-নিউজ় ১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজ়ায় বাহিনী পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা ‘মোসাদ’ এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ-র সঙ্গে বৈঠক করেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনির। সেখানে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে তেল আভিভের সঙ্গে দরদস্তুরে লেগে পড়েন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন ইসলামাবাদের সাংবাদিক আসমা শিরাজি।
চলতি নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ফিল্ড মার্শাল মুনিরের সৈনিক ভাড়ার বিষয়টি নিয়ে সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে একটি পোস্ট করেন আসমা। সেখানে তিনি জানান, জওয়ানপ্রতি ৮.৮৬ লক্ষ পাকিস্তানি টাকা দর দিয়েছেন সেনাপ্রধান, যা শুনেই পত্রপাঠ খারিজ করে দেন ইজ়রায়েলি কর্তৃপক্ষ। বরং মাথাপিছু মাত্র ৮,৮৬০ পাকিস্তানি টাকা পাওয়া যাবে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা। এর পর ইসলামাবাদের ‘সিপাহসালার’ দাম কমিয়েছেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সূত্রের খবর, গাজ়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ২০ হাজার সৈনিক মোতায়েন করতে চাইছে পাকিস্তান। অর্থাৎ একলপ্তে ২০ কোটি ডলার রোজগারের নীলনকশা ছকে ফেলেছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইহুদি রাষ্ট্র হওয়ায় ইজ়রায়েলকে কখনও সরকারি ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি ইসলামাবাদ। তার পরেও তেল আভিভের থেকে টাকা নিয়ে গাজ়ায় সেনা পাঠাতে রাওয়ালপিন্ডির সেনাপ্রধান যে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
‘ভাড়াটে বাহিনী’ হিসাবে পাক ফৌজের কাজ করার লম্বা ইতিহাস রয়েছে। অতীতে আফগানিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে নিজেদের সৈনিকদের মোতায়েন করতে দেরি করেনি ইসলামাবাদ। এর জন্য রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের কোটি কোটি ডলার দিয়েছিল আমেরিকা। পরবর্তী কালে তার কিছু অংশ ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে তাঁদের।
‘ভাড়াটে বাহিনী’ হিসাবে পাক ফৌজের সর্বাধিক বেশি সময় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে সৌদি আরবে। আঞ্চলিক সংঘাত বা বিদ্রোহ পরিস্থিতি তৈরি হলেই রিয়াধের থেকে ডাক পেয়েছে তারা। এর সূত্রপাত হয় ১৯৭৯ সালে। ওই বছর মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ কব্জা করে ফেলে ৩০০ থেকে ৬০০ জন জঙ্গি। এদের নেতৃত্বে ছিলেন জ়ুহায়মান আল-ওতাইবি নামে এক সাবেক সেনাকর্মী। সৌদি রাজপরিবারের শাসন মেনে নেওয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি ছিল তাঁর।
এর পর জঙ্গিদের থেকে মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ পুনরুদ্ধারে আসরে নামে পাক ফৌজ। সেই অভিযানে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রশংসনীয়। জ়ুহায়মানকে গ্রেফতার করে সৌদি সরকারের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয় তারা। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় ওই বিদ্রোহী সাবেক সেনাকর্মীর। ১৯৮০ সালে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে তা কার্যকর করে রিয়াধ। অন্য দিকে এই ঘটনার জেরে পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করে ফেলে ইসলামাবাদ।
১৯৭০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জর্ডনের রাজশাহিকে উৎখাত করে ক্ষমতাদখলে তৎপর হয় শরণার্থী প্যালেস্টাইনিদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রমাদ গোনেন আরবের বাদশা। তড়িঘড়ি পাক সেনাকর্তা জ়িয়া উল হককে তলব করেন তিনি। তাঁর কাঁধেই বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব দেন জর্ডনের রাজা। সেই হুকুম তামিল করতে গিয়ে প্যালেস্টাইনিদের লাশের পাহাড় গড়ে তোলেন জ়িয়া। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘কালো সেপ্টেম্বর’ (ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর) হিসাবে পরিচিত। এর পর কুখ্যাত জ়িয়া পেয়ে যান ‘প্যালেস্টাইনি হত্যাকারী’র তকমা।
১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধ থেকে সমস্যার সূত্রপাত। সে বার চক্রব্যূহে ঘিরে ধরে অতর্কিতে ইজ়রায়েলকে আক্রমণ করে তিনটি আরব দেশ। ইহুদিবিরোধী সেই জোটে মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে ছিল জর্ডনও। কিন্তু মাত্র ছ’দিনের মধ্যে সব বাজি পাল্টে দেয় তেল আভিভ। যুদ্ধে আরবদের যৌথ বাহিনীকে শুধুমাত্র পর্যুদস্ত করাই নয়, শত্রুপক্ষের বিপুল জমিও কব্জা করে ফেলে ইজ়রায়েল। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুজ়ালেম হাতছাড়া হয় জর্ডনের। ছত্রভঙ্গ দশা হয় তাদের সেনাবাহিনীর।
১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত চলেছিল ছ’দিনের যুদ্ধ। লড়াই থামতে না থামতেই জর্ডন নদী পেরিয়ে প্রায় তিন লক্ষ প্যালেস্টাইনি আশ্রয় নেন আরব দেশটির রাজধানী আম্মানে। এ ছাড়া আশপাশের আরও কয়েকটি জায়গায় শরণার্থী শিবির তৈরি করেন তাঁরা। জর্ডনের রাজা হুসেন বিন-তালালের তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা! এক দিকে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা। অন্য দিকে দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছে বলা চলে। তার মধ্যে প্যালেস্টাইনি শরণার্থী সমস্যা তাঁর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
১৯৭০ সালের ৩ জুন থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। ওই তারিখে ইজ়রায়েলি শহর লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায় প্যালেস্টাইনি শরণার্থীদের ফিদায়েঁ যোদ্ধারা। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা বিমানহানায় জর্ডনের ইরবিদ শহর একরকম গুঁড়িয়ে দেয় ইহুদি বায়ুসেনা। এতে শরণার্থী প্যালেস্টাইনিদের ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে। বাদশা হুসেনের যে তেল আভিভকে ঠেকানোর কোনও ক্ষমতা নেই, তা বুঝে যান তাঁরা। ৯ জুন এবং ১ সেপ্টেম্বর জর্ডনের রাজাকে খুন করার চেষ্টা করে প্যালেস্টাইনপন্থী উগ্রপন্থীরা। দু’বারই অবশ্য ব্যর্থ হয় তারা।
এই পরিস্থিতিতে ৭ সেপ্টেম্বর আচমকাই তিনটি বিমান ছিনতাই করে বসে প্যালেস্টাইনি ফিদায়েঁ যোদ্ধারা। এর মধ্যে ছিল জর্ডনের আজ়রাকে অবতরণ করা সুইস এয়ারলাইন্স এবং ট্রান্স-ওয়ার্ল্ড এয়ারলাইন্সের দু’টি উড়োজাহাজ। তৃতীয়টি হল মিশরের রাজধানী কায়রোগামী প্যান আমেরিকান বিমান। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক চাপের মুখে পড়ে আম্মান। ফলে কালবিলম্ব না করে সামরিক আইন (মার্শাল ল’) জারি করেন রাজা হুসেন। এর পরই ডাক পড়ে পাক সেনা অফিসার জ়িয়ার।
১৯৬৭ সাল থেকে তিন বছরের জন্য জর্ডনে ছিলেন জ়িয়া। ওই সময় তিনি পাক সেনায় ব্রিগেডিয়ার পদে ছিলেন। মূলত, আম্মানের বাহিনীকে অত্যাধুনিক রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। জর্ডনের রাজা হুসেনের তলব পেয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর সামনে হাজির হন জ়িয়া। তত ক্ষণে অবশ্য ছিনতাই হওয়া বিমানগুলি থেকে পণবন্দিদের মুক্তি দিয়েছে প্যালেস্টাইনি ফিদায়েঁরা, যার পুরোটাই সম্প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে। পাশাপাশি ইরবিদ শহর কব্জা করেছে তারা।
সাবেক সিআইএ কর্তা ব্রুস রিডলের কথায়, এর পর জর্ডনের রাজার নির্দেশ পেয়ে প্যালেস্টাইনি হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়েন জ়িয়া। ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধ। প্যালেস্টাইনিদের কোণঠাসা করতে আম্মানের ট্যাঙ্কবাহিনীকে কাজে লাগান তিনি। ১৮ সেপ্টেম্বর সিরিয়ার ট্যাঙ্কের একটি ছোট দলের সাহায্য পায় প্যালেস্টাইনি যোদ্ধারা। তাতেও লাভ তেমন কিছু হয়নি। ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ইরবিদ পুনর্দখল করে ফেলে জর্ডনের সেনা।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জর্ডনের এই গৃহযুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন জ়িয়া। বিদ্রোহীদের শিক্ষা দিতে নিরীহ প্যালেস্টাইনি শিবিরগুলি লক্ষ্য করে কামান থেকে গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিতে গলা কাঁপেনি তাঁর। ফলে ফিদায়েঁ যোদ্ধাদের তুলনায় বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তবে গোটা ঘটনায় আগাগোড়া রাজা হুসেনের পাশে ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ তথা মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের। তাঁর উদ্যোগেই ২৬ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয় দু’পক্ষ।
এ ছাড়া ২০২২ সালে পুরুষদের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করে কাতার। সেখানেও নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন হয়েছিল পাক ফৌজ। সূত্রের খবর, এর জন্য ওই সময় দোহার থেকে ২০০ কোটি ডলার পায় ইসলামাবাদ, যা আর্থিক সঙ্কট এবং জাতীয় ঋণের অঙ্ক কমাতে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিকে সাহায্য করেছিল বলে জানা গিয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলে হামলা চালায় গাজ়ার শাসনক্ষমতায় থাকা প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ফলে দু’পক্ষে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসে সেখানে শান্তি স্থাপনে উদ্যোগী হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত অক্টোবরে তাঁর প্রস্তাবিত ২০ দফা শর্ত মেনে নেয় পশ্চিম এশিয়া-সহ ইসলামিক দুনিয়ার একাধিক দেশ। সেখানে গাজ়ার জন্য একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীল বাহিনী (ইন্টারন্যাশনাল স্টেবিলাইজ়েশন ফোর্স বা আইএসএফ) তৈরির কথা বলেছেন তিনি।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজ়ার পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেবে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। এ ছাড়া হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে তাঁদের। মিশর এবং ইজ়রায়েলের সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বও পাবে আইএসএফ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব মেনে নিয়ে ওই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে সৈনিক পাঠিয়ে মোটা টাকা পকেট পুরতে চাইছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
গাজ়ায় সৈনিক পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ। জিয়ো নিউজ়কে তিনি বলেন, ‘‘প্রস্তাবিত শান্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণ ইসলামাবাদের জন্য গর্বের বিষয় হতে চলেছে।’’ প্যালেস্টাইনবাসীর স্বার্থে এই পদক্ষেপ বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের প্রস্তাব মেনে গাজ়ার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস অবশ্য হাতিয়ার ত্যাগ করতে নারাজ। ফলে নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ায় পাক ফৌজ জড়িয়ে পড়লে সেখানে সংঘর্ষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে পূর্বসূরি জ়িয়ার মতো প্যালেস্টাইনবাসীদের গণহত্যার দাগ লাগতে পারে মুনিরের উর্দিতেও। আবার মাত্র ১০০ ডলারের জন্য হামাসের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ যেতে পারে ইসলামাবাদের সৈনিকদেরও!