ফের পাকিস্তানে ‘বকলমে’ সামরিক শাসন। সংবিধানের ২৭তম সংশোধনের মাধ্যমে পাক সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের হাতে যাবতীয় ক্ষমতা তুলে দিয়েছে ইসলামাবাদ। ফলে এখন থেকে আর শুধু ফৌজ নয়, ঘরোয়া রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বিদেশনীতি— সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন তিনি। ‘পুতুল’ প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফকে চালনা করার সুতোটিও থাকছে তাঁরই হাতে। এ-হেন পরিস্থিতিতে সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ় মুশারফের সঙ্গে শুরু হয়েছে মুনিরের তুলনা। অনেকেই বলছেন, পূর্বসূরির দেখানো রাস্তায় হাঁটছেন বর্তমান ফিল্ড মার্শাল।
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষে মার খাওয়ার পর থেকেই উল্কার গতিতে উত্থান হতে থাকে মুনিরের। পরবর্তী ছ’মাসে পাক সেনার দুর্বলতা ঢাকতে একাধিক বিদেশ সফর করেন তিনি। মূলত, তাঁর চেষ্টাতেই আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয় ইসলামাবাদের। বিরল খনিজ এবং অপরিশোধিত খনিজ তেলের ‘লোভ’ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একরকম নিজের দিকে টেনে এনেছেন রাওয়ালপিন্ডির এই ফৌজি জেনারেল।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে মুনিরের এ-হেন মাখামাখির প্রভাব পাক-চিন সম্পর্কে পড়বে বলে মনে করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে ইসলামাবাদকে পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেটের মতো অত্যাধুনিক হাতিয়ারের সরবরাহ বজায় রেখেছে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসি (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করতে বিপুল লগ্নির কথাও ঘোষণা করেছে ড্রাগন সরকার।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর যুযুধান আমেরিকা এবং চিনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে বিদেশনীতি ঠিক করার ষোলো আনা কৃতিত্ব অবশ্যই মুনিরের প্রাপ্য। সব শেষে অবশ্যই বলতে হবে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’র (স্ট্র্যাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট) কথা। গত সেপ্টেম্বরে রিয়াধের রাজপ্রসাদে আরব দেশটির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনের সঙ্গে যাতে সই করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। সেখানেও হাজির ছিলেন রাওয়ালপিন্ডির ফিল্ড মার্শাল।
পাক-সৌদি ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’তে বলা হয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, রিয়াধের সঙ্গে এই সমঝোতার মাধ্যমে পুরু বর্মে ইসলামাবাদকে ঢেকে ফেলছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির, ভারতের জন্য যা বেশ উদ্বেগের। এর জেরে আগামী দিনে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মতো জঙ্গিদমন অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে দু’বার ভাবতে হবে নয়াদিল্লিকে।
এ-হেন ‘ধূর্ত’ মুনিরের সঙ্গে পূর্বসূরি পাক সেনাপ্রধান জেনারেল মুশারফের চিন্তাভাবনার প্রভূত মিল খুঁজে পেয়েছেন সাবেক সেনাকর্তা থেকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। ১৯৯৯ সালে সিয়াচেনকে ভারতের থেকে আলাদা করতে জম্মু-কাশ্মীরে লাদাখের বিস্তীর্ণ এলাকা কব্জা করার চেষ্টা করে ইসলামাবাদের বাহিনী। এই সামরিক অভিযানের ‘মূল চক্রী’ ছিলেন মুশারফ, যা কার্গিল যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হলেও ফৌজে বৃদ্ধি পায় তাঁর জনপ্রিয়তা। ফলে দু’বছরের মাথাতেই সম্পূর্ণ অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সাবেক সেনাপ্রধান।
২০০১ সালের জুনে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের কুর্সিতে বসেন মুশারফ। নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করেন তিনি। এর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করেন ইসলামাবাদের ফৌজি জেনারেল। ওই বছর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আফগানিস্তান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকা, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুয়েরিং ফ্রিডম’। এতে ওয়াশিংটনের বাহিনীকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন মুশারফ। স্থলবেষ্টিত ‘কাবুলিওয়ালার দেশ’ পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা তাঁদের দিয়েছিলেন তিনি।
মুশারফের সময় পাক-চিন সম্পর্কও ছিল যথেষ্ট মজবুত। মূলত তাঁর আমলেই বেজিঙের সঙ্গে হাতিয়ার সংক্রান্ত একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করা শুরু করে ইসলামাবাদ। সাবেক সেনাকর্তার এই ‘ভারসাম্যের খেলা’ মুনির হুবহু অনুসরণ করছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, এগুলির পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ নিয়েও দু’জনের চিন্তাভাবনার বেশ মিল রয়েছে। এরই ফলস্বরূপ বিভিন্ন সময় নাশকতার জেরে রক্তাক্ত হতে হচ্ছে ভারতকে।
’৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধে পরাজয়ের পর চুপ করে বসে থাকেননি মুশারফ। ভারতের প্রতিক্রিয়া পরখ করতে তাঁর নির্দেশেই ২০০০ সালে নয়াদিল্লির লালকেল্লায় দুই কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় পাক মদতপুষ্ট কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার সন্ত্রাসীরা। ২০০১ সাল থেকে জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাব এবং মহারাষ্ট্রে বৃদ্ধি পায় ‘ফিদায়েঁ’ হামলা। ফলে ওই বছর কেবলমাত্র উপত্যকায় ২০৮৪টি জঙ্গিহামলার ঘটনা ঘটেছিল, যাতে প্রাণ হারান অন্তত চার হাজার জন।
গোয়ান্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, লশকর-ই-ত্যায়বা, জইশ-ই-মহম্মদ, হিজ়বুল মুজ়াহিদিন এবং ইন্ডিয়ান মুজ়াহিদিনের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন মুশারফ। তাঁর ক্ষমতা দখলের মাত্র ছ’মাসের মাথায় (পড়ুন ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর) নয়াদিল্লির সংসদ ভবনে হামলা চালায় পাক সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া ২০০৬ সালে মুম্বইয়ের যাত্রিবাহী ট্রেনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। তাতে দুশোর বেশি নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। গোটা ঘটনা মুশারফ সরকারের ‘সিপাহসালার’ জেনারেল আশফাক পারভেজ় কিয়ানির মস্তিষ্কপ্রসূত বলে জানা গিয়েছিল।
২০০৮ সালের অগস্টে ক্ষমতা হারান মুশারফ। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ফের মুম্বই শহরকে নিশানা করে লশকর। আজ়মল আমির কাসভ-সহ বাণিজ্য নগরীতে ১০ সন্ত্রাসীকে পাঠায় ওই জঙ্গিগোষ্ঠী। নির্বিচারে গুলি করে ১৬৬ জনকে হত্যা করে তাঁরা। শেষে কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে লশকর সন্ত্রাসীদের এক এক করে নিকেশ করে তৎকালীন সরকার। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া কাসভের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ২০১৫ সালে পঞ্জাবের গুরুদাসপুরে এবং ২০১৬ সালে পঠানকোটেও জঙ্গিহামলা চালিয়েছিল ইসলামাবাদ।
ভারতকে ক্ষত-বিক্ষত করতে পরমাণু অস্ত্রকে হাতিয়ার করেন মুশারফ। সন্ত্রাসী হামলার পর নয়াদিল্লি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালে আণবিক আক্রমণের ভয় দেখানোই ছিল তাঁর সরকারের মূল নীতি। তাঁর উত্তরসূরি জেনারেল রাহিল শরিফ এবং জেনারেল কমর জাভেদ বাজ়ওয়া এর থেকে একচুলও সরে আসেননি। ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে অবশ্য কিছুটা অন্য পথ ধরতে হয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, পরমাণু হামলার আতঙ্কের কারণেই ২৬/১১ জঙ্গি আক্রমণের কোনও জবাব ইসলামাবাদকে দিতে পারেননি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। কিন্তু, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর সেই নীতি থেকে অনেকটাই সরে আসে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, আগামী দিনে কোনও ‘আণবিক আক্রমণের ব্ল্যাকমেল’ সহ্য করবে না ভারত। পাশাপাশি, যে কোনও সন্ত্রাসী ঘটনাকে ‘যুদ্ধ’ হিসাবে দেখা হবে বলে স্পষ্ট করে দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই ঘোষণায় বিপাকে পড়েন মুনির। পাক ‘ফিল্ড মার্শাল’ বুঝে যান, আগামী দিনে পরমাণু হামলার হুমকি দিলে চুপ করে বসে থাকবে না ভারত। আর তাই সৌদি আরবের সঙ্গে তড়িঘড়ি ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ সেরে নিয়েছেন তিনি। অপরিশোধিত খনিজ তেলের জন্য পশ্চিম এশিয়ার উপসাগরীয় রাষ্ট্রটির উপর নয়াদিল্লির বেশ নির্ভরশীলতা রয়েছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়াই মুনিরের লক্ষ্য বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে আত্মঘাতী গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ ঘটনায় এক জইশ জঙ্গি। তাতে ৪০ জন আধা সেনার মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময় পাক গুপ্তচর বাহিনী ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের ডিরেক্টর-জেনারেল পদে ছিলেন মুনির। গোটাটাই তাঁর পরিকল্পনা বলে সন্দেহ রয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের।
এ বছরের এপ্রিলে জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ফের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। পাক মদতপুষ্ট লশকরের শাখা সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট’-এর জঙ্গিরা ধর্মীয় পরিচয় জিজ্ঞাসা করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে খুন করে পর্যটক-সহ ২৬ জনকে। এরই প্রতিশোধ নিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চালায় কেন্দ্র। এতে পাকিস্তানের সামরিক লোকসানও হয়েছে চোখে পড়ার মতো। যদিও সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করার রাস্তায় যে মুনির হাঁটছেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
গত ১০ নভেম্বর লালকেল্লার সামনে গাড়ি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় ১৩ জনের। ঘটনাটিকে সন্ত্রাসবাদী হামলার অ্যাখ্যা দিয়েছে মোদী সরকার। অবসরপ্রাপ্ত মেজর মানিক জলি এই ঘটনার সঙ্গে ২০০১ সালের হামলার তুলনা টেনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অপারেশন সিঁদুরের পর এই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জল মাপার চেষ্টা করছেন মুনির। ’৯৯-এর যুদ্ধের পর ঠিক যেমনটা করেছিলেন মুশারফ। তাঁর অস্ত্র ছিল পরমাণু হাতিয়ার আর মার্কিন-চিনের বন্ধুত্ব। প্রথমটির বদলে বর্তমান ফিল্ড মার্শাল অবশ্য পাচ্ছেন রিয়াধের সামরিক সমঝোতা।’’
তবে মুশারফের পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভাল হয়নি। দেশ থেকে নির্বাসন নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। পরবর্তী সময়ে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ে পাকিস্তান। প্রতিবেশী আফগানদের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় শত্রুতা। হাওয়া লাগে বালোচিস্তান এবং খাইবার-পাখতুনখোয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে। মুনিরের ভাগ্যেও রয়েছে একই চিত্রনাট্য? উত্তর দেবে সময়।