ফের পাকিস্তানের গণতন্ত্রে পড়তে চলেছে দাঁড়ি? আইন মোতাবেক এ বার যাবতীয় ক্ষমতা পেতে চলেছেন ইসলামাবাদের ফিল্ড মার্শাল ‘সিপাহসালার’ আসিম মুনির? সূত্রের খবর, সেই লক্ষ্যে নাকি সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। যদিও সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে এখনও পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে আছে তাঁর সরকার। অন্য দিকে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির খবরে নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। বলা বাহুল্য এতে জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বাড়ল উদ্বেগ।
পাক পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে সংবিধান সংশোধনী বিল আনতে চলতি বছরের ৬ নভেম্বর জোট শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়’ বা পিএমএল-এনের নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। প্রস্তাবিত বিলে মোট তিনটি বিষয় বদলানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। শেষ পর্যন্ত সেটা পাশ হলে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে পাকাপাকি ভাবে রাজনৈতিক শাসন ‘শীতঘুমে’ যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
পশ্চিমি গণমাধ্যম ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নিয়ে ২৭তম বার সংবিধান সংশোধন করতে চলেছে পাকিস্তান। প্রস্তাবিত বিলে আইনের বইটির ২৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদ পাল্টে ফেলার উল্লেখ রয়েছে। ইসলামাবাদের সংবিধানের এই অংশটি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাদের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা দিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। পাশাপাশি, বিচার বিভাগ এবং প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা কাটছাঁটের কথাও বলা হয়েছে সেখানে।
পাক সংবাদসংস্থাগুলি জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হলে ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ বা সিডিএসের সমতুল্য পদ তৈরি করবে সরকার। তাতে নিয়োগ পাবেন স্বয়ং সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনির। তখন তিন বাহিনীরই প্রধান হয়ে উঠবেন তিনি। একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার এবং নেতৃত্ব দেওয়ার যাবতীয় চাবিকাঠি থাকবে তাঁর হাতে। শুধু তা-ই নয়, ইসলামাবাদের যাবতীয় পরমাণু হাতিয়ারও মুনিরের হাতে তুলে দিতে পারে শরিফ সরকার।
বর্তমানে সাংবিধানিক ভাবে ভারতের মতোই তিন সেনার মাথায় রয়েছেন পাক প্রেসিডেন্ট। ‘কমান্ডার-ইন-চিফ’ নামের একটি আলঙ্কারিক পদ দেওয়া হয়েছে তাঁকে। প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ হলে সেটা হারাবেন তিনি। ইসলামাবাদের পরমাণু হাতিয়ারের দেখভাল করে প্রতিরক্ষা দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘স্ট্যাটেজ়িক প্ল্যান ডিভিশন’। নতুন আইনে তা চলে যাবে সিডিএস বা তার সমতুল্য পদাধিকারীর হাতে। সে ক্ষেত্রে ফের বাড়তে পারে ফিল্ড মার্শালের কার্যকালের মেয়াদ।
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের সংঘর্ষে ভারতীয় ফৌজের হাতে মার খাওয়ার পরই সেনাপ্রধান আসিফ মুনিরের পদোন্নতি করে শাহবাজ় শরিফ সরকার। জেনারেল থেকে ফিল্ড মার্শালে উত্তীর্ণ হন তিনি। পাকিস্তানের ইতিহাসে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে এই পদ পেয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির এই শীর্ষ সেনাকর্তা। প্রথম জন ছিলেন দেশটির প্রথম সেনাশাসক আয়ুব খান। ফিল্ড মার্শাল পদ প্রাপ্তির সময়েই মুনিরের কার্যকালের মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সাল করেছিল ইসলামাবাদ।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন লন্ডন কিংস কলেজের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভাগের সিনিয়র ফেলো আয়েশা সিদ্দিকি। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’কে তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান সংশোধনী পাশ হলে ফিল্ড মার্শাল মুনিরের কার্যকালের মেয়াদ আমৃত্যু হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সেনাপ্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন তিনি। কারণ, তিন বাহিনীর মাথায় থাকলে ওই পদ আঁকড়ে থাকার মানে নেই। যদিও এ ব্যাপারে ধোঁয়াশা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাহিনীতে তিনি কাদের বিশ্বাস করছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’’
‘দ্য প্রিন্ট’ আরও জানিয়েছে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বিচার বিভাগে বড় বদল আনছে ইসলামাবাদ। এতে পাক সুপ্রিম কোর্টের কোনও রকম অনুমোদন ছাড়াই ইচ্ছামতো বিচারক এবং বিচারপতিদের বদলির ক্ষমতা পাবে কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি, প্রস্তাবিত বিলটিতে প্রাদেশিক সরকারের শক্তি এবং ব্যয়বরাদ্দ হ্রাসের ইঙ্গিত রয়েছে। উল্টো দিকে বাড়ানো হবে ফৌজি বাজেট। তবে সেটা কত শতাংশ, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
বর্তমানে চার প্রদেশের জন্য গড়ে কেন্দ্রীয় বাজেটের ৫৭ শতাংশ ব্যয়বরাদ্দ ধার্য করে থাকে পাক সরকার। সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত বাজেটে সেটা কমিয়ে ৪৫ শতাংশের নীচে নামিয়ে আনার নীলনকশা ছকে ফেলেছে শাহবাজ় প্রশাসন। ফলে সংবিধান সংশোধন হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্পের খরচ কাটছাঁট হবে বলে জানিয়েছে একাধিক স্থানীয় গণমাধ্যম। এতে অবশ্য ইসলামাবাদের প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ মাথাচাড়া দেওয়ার আশঙ্কা বাড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত বিলে একটি সাংবিধানিক আদালত তৈরির কথা বলা হয়েছে। এতে অবশ্য আগের চেয়ে বেশি ক্ষমতা পাবেন পাক সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। পাশাপাশি, জেলাস্তরের আদালতে ছোটখাটো অপরাধের বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের আধিকারিক নিয়োগের উল্লেখ রয়েছে সংবিধান সংশোধনী বিলে। নিম্ন আদালতের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার উদ্দেশ্যে এটা করতে চাইছে শাহবাজ় সরকার, খবর সূত্রের।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, প্রস্তাবিত বিলটি পাশ হলে বকলমে সেনাশাসনে চলে যাবে পাকিস্তান। তখন আর ক্ষমতা দখলের জন্য প্রয়োজন হবে না অভ্যুত্থানের। অতীতে ইসলামাবাদের কুর্সিতে বসা প্রতিটি ফৌজি জেনারেলের আমলেই ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধে জড়িয়েছে ইসলামাবাদ। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সংবিধানের ২৭তম সংশোধনে সেই আশঙ্কা কয়েক গুণ বাড়ল বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
উদাহরণ হিসাবে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের কথা বলা যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার থেকে শাসনক্ষমতা ছিনিয়ে নেন তিনি। এই ঘটনার সাত বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৬৫ সালে) কাশ্মীর আক্রমণ করে ইসলামাবাদের ফৌজ। তাদের অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ এবং ‘অপারেশন গ্র্যান্ড স্লাম’। এক মাস দু’সপ্তাহ চার দিন ধরে লড়াই চলার পর পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির পঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরের কাছে পৌঁছে যায় ভারতীয় বাহিনী।
১৯৬৫-র যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত কাশ্মীর জয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর অবশ্য বেশি দিন কুর্সিতে ছিলেন না আয়ুব। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ফিল্ড মার্শাল সরলেও সেনাশাসন থেকে মুক্তি পায়নি পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালে ফের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন ইসলামাবাদের তৎকালীন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান। তিনি কুর্সিতে বসার দু’বছরের মাথায় শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফের এক বার ভারতের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘাতে জড়ায় পাক সেনা।
১৯৭১ সালের লড়াইয়ে এ দেশের বাহিনীর হাতে পুরোপুরি ভাবে পর্যুদস্ত হয় ইসলামাবাদ। মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার পাক ফৌজ। যুদ্ধবন্দি হিসাবে তাঁদের নিয়ে আসা হয় ভারতে। পাশাপাশি, রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের চিরতরে হাতছাড়া হয় পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। এতে অবশ্য নয়াদিল্লির সঙ্গে পশ্চিমের প্রতিবেশীর বিদ্বেষ আরও বেড়েছিল।
১৯৭১ সালের সংঘর্ষ শেষে কুর্সি ছাড়েন জেনারেল ইয়াহিয়া। এর পর কিছু দিন অবশ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতেই ছিল পাকিস্তান। ১৯৭৮ সালে ফের একই চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি দেখে ইসলামাবাদ। এ বার ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জ়িয়া উল হক। কুর্সিতে বসে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল বদলে ফেলেন তিনি। পরবর্তী বছরগুলিতে তাঁরই নির্দেশে কাশ্মীর এবং পঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদে মদত দিতে থাকে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআই।
জেনারেল জ়িয়ার সেই মডেল ২০২৫ সালেও অনুসরণ করে যাচ্ছে পাকিস্তান। ১৯৮৮ সালে অবশ্য রহস্যজনক ভাবে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। এর ১১ বছরের মাথায় পরবর্তী সেনাশাসক হিসাবে ইসলামাবাদের কুর্সিতে বসেন জেনারেল পারভেজ মুশারফ। সালটি ছিল ১৯৯৯। তবে ক্ষমতা দখলের আগেই ওই বছরের মে মাসে তাঁর নির্দেশে কার্গিল, বাটালিক দ্রাস-সহ ভূস্বর্গের বিস্তীর্ণ এলাকা কব্জা করে ফেলে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজ।
প্রায় দু’মাসের লড়াইয়ের পর পাক ফৌজের থেকে ওই এলাকা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনা। এই লড়াইয়ে জওয়ান এবং অফিসার মিলিয়ে ৫২৭ জনকে হারায় এ দেশের বাহিনী। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন মুশারফ। তাঁর শাসনকালে ঘন ঘন জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে কাশ্মীর। আর তাই ফিল্ড মার্শাল মুনির অতিরিক্ত ক্ষমতা পেলে জম্মু-কাশ্মীর ও পঞ্জাব-সহ সীমান্ত লাগোয়া রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পরিস্থিতি জটিল হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
যদিও প্রস্তাবিত বিলটি পাশ হওয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় খটকা রয়েছে। পাক পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের আসনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৩৬ এবং ৯৬। সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করতে হলে এর দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন চাই শাহবাজ় সরকারের। কিন্তু জোটে থাকা শরিফের কাছে অঙ্কের হিসাবে নেই সেই সংখ্যা। আর তাই শরিক দল বিলাবল ভুট্টো জারদারির ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’র (পিপিপি) খোলাখুলি সমর্থন পেতে চাইছেন তিনি।
অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট বিলটির প্রবল বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ বা পিটিআই। তাঁদের যুক্তি, নিজের কুর্সি বাঁচাতে দেশকে পুরোপুরি সেনার হাতে তুলে দিচ্ছেন শাহবাজ় শরিফ। পিপিপি নেতা বিলাবলের আবার প্রাদেশিক সরকারের ব্যয়বরাদ্দে কাটছাঁট এবং ক্ষমতা হ্রাস নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে। এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) এই নিয়ে একটি পোস্টও দিয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের ইতিহাসে যে যে রাজনৈতিক নেতা সেনাকর্তাদের মাথায় তুলেছেন, কিছু দিনের মধ্যেই চরম বিপদে পড়তে হয়েছে তাঁদের। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে সামরিক আইন জারি করে আয়ুবকে ‘মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর’ হিসাবে নিয়োগ করেন ইস্কান্দার মির্জা। কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষমতা হারিয়ে দেশ থেকে পালাতে হয় তাঁকে। এ ছাড়া অন্যদের সরিয়ে জেনারেল জ়িয়াকে সেনাপ্রধান করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো। ক্ষমতায় এসে তাঁকেই প্রথমে ফাঁসিতে ঝোলান ওই সেনাশাসক। একই পরিণতির দিকে এগোচ্ছেন শাহবাজ়? উত্তর দেবে সময়।