দেশের জনসংখ্যা ২৩ কোটি। তার মধ্যে প্রায় ৪ কোটি মানুষই ভিক্ষান্নে প্রতিপালিত হন। ভিক্ষাবৃত্তি পাক জনতার মধ্যে জনপ্রিয় ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানের প্রতি ছ’জনের মধ্যে এক জন ভিক্ষাজীবী। তাঁদের প্রতি দিনের আয় অন্যান্য পেশার চাকরিজীবীর আয়ের প্রায় সমান।
কম আয়াসে অধিক লাভের জন্য শুধু দেশ নয়, বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছেন পাকিস্তানি জনতার একাংশ। তীর্থযাত্রার ছুতোয় পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে ভিড় জমাচ্ছেন তাঁরা। সৌদি আরব, ইরাক, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো দেশগুলিতে পা দিয়েই নিজেদের স্বরূপ দেখাতে শুরু করছেন পাক নাগরিকেরা।
উন্নত দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে ভিক্ষাবৃত্তিকে উপার্জনের সহজ পন্থা হিসাবে বেছে নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ভিক্ষার টাকা জমিয়ে কেউ ফিরে আসছেন, আবার কেউ পাকাপাকি ভাবে থানা গেড়ে বসছেন বিদেশে। পাক নাগরিকদের ভিক্ষাবৃত্তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি।
আরও মারাত্মক অভিযোগ তুলেছে সৌদি আরব। সে দেশের প্রশাসনের অভিযোগ, হজের অজুহাতে প্রতি বছর পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ ভিখারি ঢুকে পড়ছে মক্কায়। দেশি-বিদেশি তীর্থযাত্রীদের থেকে ভিক্ষার নামে জোর করে টাকা আদায়ও করেন তাঁরা। প্রতি বছর পাক নাগরিকদের জন্য ধর্মীয় স্থানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।
পাক সরকারের কাছে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি ব্যাপক ধরপাকড়ের পর হাজার হাজার পাকিস্তানিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে দেশগুলি। পাক নাগরিকদের বিদেশে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির কারণে এই সমস্ত দেশের কাছে মুখ পুড়েছে ইসলামাবাদের। সরকারকে দেশ ও তার নাগরিকদের ভাবমূর্তি সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ভিক্ষুককে ফেরত পাঠিয়েছে ছ’টি দেশ। পাকিস্তানের আইনসভায় এমনটাই জানিয়েছিলেন সে দেশের অভ্যন্তরীণমন্ত্রী মহসিন নকভি। এই দেশগুলি থেকে ফেরত পাঠানো ভিক্ষুকদের মধ্যে অধিকাংশই সিন্ধ প্রদেশের বাসিন্দা। সংখ্যার নিরিখে তার পর যথাক্রমে রয়েছে পঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান, পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং ইসলামাবাদ।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সংবাদপত্র দ্য ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি, যার মধ্যে ৩.৮ কোটি পেশাদার ভিক্ষাজীবী। তাঁদের দিন গুজরান হয় ভিক্ষার আয়ে। সে দেশের এক ভিক্ষাজীবীর গড় আয় দিনে ৮৫০ পাকিস্তানি টাকা।
তিন কোটি আশি সম্প্রতি পাকিস্তানের সংবাদপত্র দ্য ডনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৩ কোটি, যার মধ্যে ৩.৮ কোটি পেশাদার ভিক্ষাজীবী। তাঁদের দিন গুজরান হয় ভিক্ষার আয়ে। সে দেশের এক ভিক্ষাজীবীর গড় আয় দিনে ৮৫০ পাকিস্তানি টাকা।লক্ষ ভিক্ষাজীবীর মোট দৈনিক আয় হিসাব করলে যে সংখ্যাটা আসবে তা চমকে দেওয়ার মতোই। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি দিন সকলের আয় মিলিয়ে ১১ কোটি ২৫ লক্ষ ডলার রোজগার হয় এই পেশা থেকে। ডলারের নিরিখে বার্ষিক হিসাব করলে সেই পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৪২০০০০০০০০০ কোটি।
এশিয়ান হিউম্যান রাইট্স কমিশনের সমীক্ষা অনুসারে, পাকিস্তানের জনসংখ্যার ২.৫ থেকে ১১ শতাংশ জীবিকা নির্বাহের জন্য ভিক্ষা করে থাকেন। ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রধান শহরগুলির রাস্তায় প্রায় ১২ লক্ষ শিশু ঘুরে বেড়ায় ভিক্ষা করে রোজগার করার জন্য।
পাকিস্তানের প্রথম সারির সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, প্রায় চার কোটি মানুষ কোনও কাজ না করেই বিপুল আয় করছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্রবণতাটি ভিতরে ভিতরে ফোঁপরা করে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশের বাকি জনসংখ্যার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
নাগরিকদের ভিক্ষার পেশা বেছে নেওয়াকে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হিসাবেও ধরা হয়েছে। পাকিস্তানের ‘বিজনেস অ্যান্ড সোসাইটি সেন্টার’-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা বাড়ছে কারণ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত পাকিস্তানিরা যে কোনও অদক্ষ শ্রমিকের তুলনায় অনেক বেশি রোজগার করেন।
বিদেশের একাধিক দেশ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পর শাহবাজ় শরিফের সরকার স্বীকার করে নিয়েছেন সমস্যার গভীরতা। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ জানিয়েছেন, সমস্যাটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ফলে অন্যান্য দেশে পাকিস্তানিদের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত মোট ৫,৪০২ জন পাকিস্তানি নাগরিককে বহিষ্কার করেছে সৌদি আরব-সহ উপসাগরীয় দেশগুলি। ২০২৫ সালে ফেরত পাঠানো হয়েছে আরও ৫৫২ জনকে। সব মিলিয়ে গত আড়াই বছরে ৪৪ হাজারের বেশি ভিক্ষাজীবীকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে।
২০২৩ সালে সেনেট কমিটির বৈঠকে পাকিস্তানের তৎকালীন বিদেশসচিব জুলফিকর হায়দার জানিয়েছিলেন, বিদেশে গ্রেফতার হওয়া ভিক্ষুকদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ পাকিস্তানি নাগরিক।
পাক সংবাদসংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশে ভিক্ষাবৃত্তি চালানোর জন্য আটঘাট বেঁধে কাজে নেমেছে একটি চক্র। এদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলিতে। সেই তদন্ত চালাতে গিয়ে গোটা কয়েক ট্যুর অপারেটর এবং পদস্থ সরকারি কর্তার নাম উঠে আসে।
তাঁদের বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছে প্রশাসন। ধর্মীয় যাত্রার নামে ভিখারি মাফিয়া নেটওয়ার্ক চালাচ্ছিলেন তাঁরা। ‘কমিশনের’ মাধ্যমে মোটা টাকা তাঁদের পকেট ভরাত বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা।
২০২৩ সালে বিদেশে গিয়ে ভিক্ষা করা দু’হাজার নাগরিকের পাসপোর্ট স্থগিত করে দেয় পাক সরকার। তাঁদের সাত বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। সরকার জানিয়েছিল, ওই পাকিস্তানিরা বিদেশে গিয়ে ভিক্ষা করে নিজেদের দেশের নাম ডোবাচ্ছেন।