সিন্ধুর জল নিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের রণ-হুঁশিয়ারিতে চড়ছে পারদ! তবে জম্মু-কাশ্মীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই নদীতে ভারত বাঁধ দেওয়ার আগেই ইসলামাবাদের পিঠে পড়তে শুরু করেছে ‘প্রকৃতির চাবুক’। হু-হু করে নেমে যাচ্ছে সিন্ধুর জলস্তর। উল্টে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে নষ্ট করছে জমির উর্বরতা। ফলে শিকেয় উঠেছে চাষ। এর জেরে ঘর ছাড়ছেন কৃষক পরিবারের লক্ষ লক্ষ মানুষ।
সম্প্রতি ঘোর জলসঙ্কট সংক্রান্ত বিস্ফোরক খবর এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে। এখানেই সমুদ্রে মেশার মুখে সিন্ধু নদীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটা বড় বদ্বীপ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দিন দিন এখানে নেমে যাচ্ছে নদীর জলস্তর। ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত জল বাধাহীন ভাবে চাষের জমিতে ঢুকতে শুরু করেছে। এতেই কপাল পুড়েছে কৃষির উপর নির্ভরশীল সিন্ধবাসীর।
কৃষির পাশাপাশি সিন্ধু বদ্বীপের বাসিন্দাদের দ্বিতীয় উপার্জনের বড় ক্ষেত্র হল মাছ শিকার। কিন্তু নদীতে সাগরের নোনা জল অত্যধিক মাত্রায় মিশতে থাকায় সেখানে মাছ পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নতুন রোজগারের আশায় ধীরে ধীরে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে করাচির দিকে যেতে শুরু করেছেন। এই পরিবেশগত বদলের বড় আর্থ-সামাজিক প্রভাব পাকিস্তানের উপর পড়তে চলেছে বলে ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের মার্চে বিষয়টি নিয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘জিন্না ইনস্টিটিউট’। পাকিস্তানের এক সাবেক জলবায়ুমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই সংস্থার দাবি, সিন্ধু নদীর জলস্তর নেমে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট বদ্বীপ এলাকার অন্তত ১২ লক্ষ বাসিন্দা অন্যত্র সরে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে সেখানকার গ্রামগুলি খালি হয়ে যাচ্ছে। গোটা এলাকাটির মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেননি তাঁরা।
সিন্ধুর বদ্বীপ নিয়ে ২০১৮ সালে আরও একটি গবেষণামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘ইউএস-পাকিস্তান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ় ইন ওয়াটার’। সেখানে আবার বলা হয়, ১৯৫০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৬৮ বছরে বদ্বীপ এলাকায় নদীটির জলস্তর ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে। এর জন্য ইসলামাবাদের অবিবেচকের মতো সেচখাল কাটা ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণকে দায়ী করা হয়েছে।
সিন্ধুর জলস্তর কমার দ্বিতীয় কারণ হিসাবে হিমবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলেছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের দাবি, আগের তুলনায় তুষারগলা জলের মাত্রা এই নদীতে অনেকটা কমে গিয়েছে। অন্য দিকে, বদ্বীপ এলাকাটিতে ভয়াবহ ভাবে অনুপ্রবেশ ঘটছে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের। ফলে ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৫-এর মধ্যে সেখানকার নদীর জলে নুনের মাত্রা প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন স্থানীয় পরিবেশবিদ তথা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ বা ডব্লিউডব্লিউএফের সদস্য মহম্মদ আলি আনজ়ুম। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা সিন্ধু বদ্বীপ ডুবে যাচ্ছে, সঙ্কুচিত হচ্ছে রোজ। সমুদ্র সম্পূর্ণ এলাকাটিকে গিলে খাবে বলেই মনে হয়।’’ সাগরের নোনা জলের জন্য ফসল উৎপাদন অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। নদীতে চিংড়ি ও কাঁকড়া প্রায় মিলছে না বললেই চলে।
এলাকাবাসীদের দাবি, একটা সময়ে সিন্ধুর বদ্বীপে ছিল ৪০টির বেশি গ্রাম। সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সেগুলির অধিকাংশই বর্তমানে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পাক সরকারের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১ সালে সেখানকার বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল ২৬ হাজার। ২০২৩ সালে সেটাই ১১ হাজারে নেমে আসে। শেষ দু’বছরের এই সূচকে আরও পতন দেখা গিয়েছে।
সিন্ধুর বদ্বীপের হালহকিকত জানতে কিছু দিন আগে সেখানে পৌঁছোয় সংবাদসংস্থা এএফপির একটি দল। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুল্লা খট্টি তাঁদের জানিয়েছেন, ‘‘সমুদ্রের নোনা জলের চক্রব্যূহের মধ্যে পড়ে গিয়েছি আমরা। ফলে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই। আগে অন্তত ১৫০ পরিবার ছিল মৎস্যজীবী। সেটা এখন কমে হয়েছে চার। বাকিরা দর্জি, ছোট ব্যবসা বা অন্য কাজ খুঁজে নিয়েছেন। প্রায় সকলেই গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে যেতে চাইছেন।’’
সিন্ধ প্রদেশের ওই বদ্বীপের সমস্যা মেটাতে ২০১৯ সালে একটি সমীক্ষা করে পাকিস্তান সরকার। সেই রিপোর্টে বলা হয়, সমুদ্রের জল ঢোকার কারণে ১৬ শতাংশের বেশি কৃষিজমি বন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া কেটি বন্দর শহর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা ঢাকা পড়েছে নুনের চাদরে। গোটা বদ্বীপে পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবের কথা ওই রিপোর্টে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল।
পাক সরকারের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, সিন্ধু বদ্বীপের বাসিন্দাদের পানীয় জল সংগ্রহ করতে নিত্যদিন পাড়ি দিতে হচ্ছে কয়েক মাইল রাস্তা। কেউ কেউ নৌকায় নদীর গতিপথ ধরে অন্য দিকে গিয়ে সেটা সংগ্রহ করছেন। কেউ আবার শহর থেকে কিনে আনছেন পানীয় জল। মূলত গাধার পিঠে চাপিয়ে সেই জল গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। পরিস্থিতি বদলাতে কী করা উচিত, তা অবশ্য ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।
সিন্ধু বদ্বীপের এই দুরবস্থার সূত্রপাতটা অবশ্য হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। অবিভক্ত পঞ্জাবের কৃষির উন্নতি করতে প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে নদীটি থেকে কাটা হয় একাধিক সেচখাল। শুধু তা-ই নয়, বাঁধ দিয়ে সিন্ধুর গতিপথও কিছুটা বদলে দেন ইংরেজ শাসকেরা। দেশভাগের পর সংশ্লিষ্ট নদীটিতে কয়েক ডজন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলে পাক সরকার। তারই প্রভাবে সিন্ধুর নিম্ন অববাহিকায় ধীরে ধীরে জলস্তর কমতে শুরু করে।
২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচখাল কাটার সিদ্ধান্ত নেয় পাক সরকার। ঠিক হয় সিন্ধু এবং তার শাখানদী শতদ্রু থেকে মোট ছ’টি খাল কেটে পঞ্জাব, সিন্ধ এবং বালোচিস্তান, এই তিন প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় পৌঁছোনো হবে চাষের জল।
কিন্তু চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্পের জন্য পঞ্জাবের বাসিন্দারা বেশি উপকৃত হবেন বলে অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামে সিন্ধ প্রদেশের কৃষকেরা। অচিরেই জনরোষ হিংসাত্মক রূপ নিতে শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে গত ২৪ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ করে পাক সরকার। উল্লেখ্য, ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছিল ওই খাল কাটার কাজ।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট তথা ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জলবণ্টন নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। দীর্ঘ ন’বছর আলোচনা চলার পর চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেছিল। এর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করে, যা নিয়ে বর্তমানে আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির।
সিন্ধু নদীর উৎপত্তি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতের মানস সরোবর সংলগ্ন একটি প্রস্রবণ থেকে। এর মূল উপনদী হল বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী ও বিপাশা। সিন্ধু জল চুক্তিতে এই নদীগুলির জলের ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও চুক্তিতে শতদ্রু নদীর জলের ব্যবহারের কথাও বলা রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।
পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছচাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
এ বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। এর পরেই ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, সিন্ধু অববাহিকার সংযোগকারী নদীগুলিতে সেচখাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। তার জন্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে সমীক্ষা। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে সিন্ধুর বাঁ দিকের উপনদী চন্দ্রভাগার জল পাক পঞ্জাব প্রদেশে যাওয়া বন্ধ করতে চাইছে মোদী সরকার।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিন্ধু চুক্তি স্থগিত হওয়ায় এর উপরে বাঁধ তৈরিতে কেন্দ্রের কোনও বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে আরও তীব্র হবে পাকিস্তানের জলসঙ্কট। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনির। ‘দ্য প্রিন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্কিন মুলুকের ফ্লরিডায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘ভারত বাঁধ তৈরি করুক, আমরা অপেক্ষা করব। যখন বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখনই ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সেটা ধ্বংস করে দেব। সিন্ধু নদী ওদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আর আমাদের কাছেও ক্ষেপণাস্ত্রের কোনও অভাব নেই।’’
এর পাশাপাশি গত ৮ অগস্ট সিন্ধু চুক্তি নিয়ে সালিশি আদালতের দেওয়া রায়কে স্বাগত জানিয়েছে ইসলামাবাদ। ইসলামাবাদের দাবি, সেখানে বলা হয়েছে ভারতকে পশ্চিমের নদীগুলি থেকে জল ছাড়তে হবে, যাতে সেটা পাকিস্তান ‘অবাধে ব্যবহার’ করতে পারে। যদিও সালিশি আদালতের রায়কে স্বীকৃতি দেয়নি নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, মুনিরের হুঁশিয়ারির কড়া বিবৃতি দিয়েছে মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক।