কখনও সিরিয়ায় রাতারাতি কুর্সিবদল। কখনও আবার দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ভুলে আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের করমর্দন। কোনও এক অদৃশ্য সুতোর টানে যেন বিশ্ব জুড়ে বার বার ঘটছে নাটকীয় পটপরিবর্তন। সব কিছুর নেপথ্যে কি ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকা ও রাশিয়া? দুই মহাশক্তির মধ্যে ফের শুরু হয়েছে ‘ঠান্ডা লড়াই’? ঘটনাপরম্পরার দিকে তাকিয়ে তেমনটাই বলছেন তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
বছর কয়েক আগে রাশিয়া ও আমেরিকার ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক নিয়ে একটি বই লেখেন কানাডার আইনজীবী জর্জ তাকাচ। সেখানেই প্রথম বার ‘দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধ’ শব্দবন্ধনীটি ব্যবহার করেন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বইটির নামও ‘কোল্ড ওয়ার ২.০’ রাখেন তাকাচ। এর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় চর্চা।
আইনজীবী তাকাচের দাবি, ‘দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধ’ শুরু হয় ২০১৪ সালে। ওই বছর আচমকাই সেনা অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনের হাত থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। ফলে পূর্ব ইউরোপে এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত দুই দেশের সম্পর্কে আসে জটিলতা। বিষয়টা নজর এড়ায়নি যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে পাল্টা মস্কোকে ঘেরার নীলনকশা তৈরি করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে ওয়াশিংটন।
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলাকালীন আমেরিকার রক্তচাপ সবচেয়ে বাড়িয়েছিল কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রের মোতায়েন। ঘটনাটা ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট’ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। ওই সময়ে সেটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গলায় ছুরি ধরার শামিল। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হতেই পুরনো আঘাতের হিসাব কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মার্কিন সরকার।
বিশ্লেষকদের বড় অংশই মনে করেন, ক্রিমিয়া পতনের পর থেকেই রাশিয়াকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নামানোর হিসাব কষতে থাকে আমেরিকার গুপ্তচরবাহিনী সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)। এর জন্য ইউক্রেনের ভিতরে মস্কো-বিরোধী প্রবল প্রচার চালায় তারা। ফলস্বরূপ, ২০১৯ সালে শপথ নিয়েই সেখানকার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোয় (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
কিভকে নেটোয় আনতে পারলে সেখানে পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েনের সুযোগ পেয়ে যেত যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মস্কো-সহ রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের যে কোনও জায়গায় হামলা করার সুযোগ থাকত তাদের হাতে। ঠিক যেমনটা ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট’-এর সময়ে করেছিল ক্রেমলিন। ফলে প্রমাদ গোনেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রাথমিক ভাবে জ়েলেনস্কিকে বুঝিয়ে শান্ত করার কম চেষ্টা করেননি তিনি। কিন্তু তাতে লাভ না হওয়ায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযানে (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) নামে তার বাহিনী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে আরও গতি আসে বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। পূর্ব ইউরোপের রণাঙ্গনে মস্কোর যাবতীয় শক্তি শেষ হোক, তা বরাবর চেয়েছে আমেরিকা। সেই উদ্দেশ্যে কিভকে বিপুল পরিমাণে অত্যাধুনিক হাতিয়ার দেওয়া শুরু করে ওয়াশিংটন। পাশাপাশি, ক্রেমলিনকে কোণঠাসা করতে এক এক করে তাঁর ‘বন্ধু’দের সরাতে থাকে ওয়াশিংটন।
সেই তালিকায় প্রথমেই আসবে সিরিয়ার নাম। ভূমধ্যসাগরের কোলের দেশটির কৌশলগত অবস্থানের কারণে সোভিয়েত আমল থেকে সেখানে সামরিক ঘাঁটি রেখেছিল রাশিয়া। দামাস্কাসের প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে থাকা বাশার অল-আসাদও ছিলেন পুতিনের ‘কাছের লোক’। কিন্তু গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) ডিসেম্বরে দুই সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করলে পতন হয় বাশার সরকারের। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসাদ আশ্রয় নেন মস্কোয়।
সিরিয়ায় পালাবদলের পর সে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমেদ আল-শারা। কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়দার সদস্য হওয়ায় তাঁর মাথায় দাম কয়েক কোটি ডলার ধার্য করেছিল আমেরিকা। কিন্তু, সময়ের চাকা ঘুরতেই শারার সঙ্গে করমর্দন করতে দেখা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। পাশাপাশি, দামাস্কাসের উপরে থাকা একাধিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেও রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়াকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে আমেরিকার দ্বিতীয় বড় সাফল্য হল আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজ়ানের সংঘাতের অবসান। ১৯৯১ সালের আগে পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার এই দুই দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর নাগোর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে একাধিক যুদ্ধে জড়ায় ইয়েরভান ও বাকু। সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্য কখনওই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেয়নি মস্কো।
রাশিয়ার এই ‘উদাসীনতা’কে কাজে লাগিয়ে আর্মেনিয়া এবং আজ়ারবাইজানের প্রেসিডেন্টকে ওয়াশিংটনে ডেকে এনে শান্তি সমঝোতায় সই করান ট্রাম্প। তাঁর দাবি, এর জেরে শেষ হয়েছে ৩৭ বছরের শত্রুতা। মধ্য এশিয়ার এই দুই দেশ এত দিন ছিল মস্কোপন্থী। ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কো ব্যস্ত থাকায় শান্তি চুক্তির মাধ্যমে তাদের নিজেদের দিকে টানতে আমেরিকা সক্ষম হল বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এই সব কিছুর মাঝে রাশিয়া যে চুপ করে থেকেছে, এমনটা নয়। মস্কোর বিরুদ্ধে রয়েছে ইরানের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির কর্মসূচিতে মদত দেওয়ার অভিযোগ। একে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার তেহরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ইজ়রায়েল। ফলে ইহুদিদের বাঁচাতে বার বার পশ্চিম এশিয়ার লড়াইয়ে হাত পোড়াতে হচ্ছে আমেরিকাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় আতঙ্কের জায়গা হল তাইওয়ান। প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্র দখলের জন্য বর্তমানে মরিয়া হয়ে উঠেছে চিন। ওই এলাকাটিকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে বেজিং। শেষ পর্যন্ত তাইওয়ান ড্রাগন সরকারের দখলে গেলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় কমবে আমেরিকার প্রভাব। জাপানে সামরিক ঘাঁটি রাখাও কঠিন হতে পারে ওয়াশিংটনের পক্ষে।
এই পরিস্থিতিতে চিনকে ঘিরতে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে আমেরিকা। এর জন্য বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি নৌসেনা ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু, এতে প্রবল আপত্তি জানান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর কিছু দিনের মধ্যেই প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে কুর্সি হারাতে হয় তাঁকে। ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, পর্দার আড়ালে থেকে গোটা বিষয়টিতে কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়ার দ্বিতীয় বড় চাল হল রিপাবলিক অফ কোরিয়ায় (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) অস্থিরতা তৈরি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দ্বীপে আমেরিকার জোরালো উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু গত বছর হঠাৎ করেই সামরিক আইন (মার্শাল ’ল) চালু করেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। এই নিয়ে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। তার পর থেকে কিছুতেই স্থায়ী সরকার তৈরি করতে পারছে না ওই গণতান্ত্রিক দেশ। এর জন্য মস্কোর গুপ্তচরদের হাতযশকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
আমেরিকা আবার ইরানকে চাপে রাখতে সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়িয়েছে ঘনিষ্ঠতা। এ বছরের জুন থেকে অগস্টের মধ্যে অন্তত দু’বার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ফলে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে এসেছে শীতলতা। এর জন্য চিনকে ঠেকাতে কোয়াড নামের যে চতুঃশক্তিজোট রয়েছে, তা ঠান্ডা ঘরে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। কোয়াডে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের পাশাপাশি রয়েছে জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াও।
‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলাকালীন একের পর এক সামরিক চুক্তি করে একে অপরকে ঘেরার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে রাশিয়া ও আমেরিকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ফের এক বার স্পষ্ট হচ্ছে সেই ছবি। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’র (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) সঙ্গে সৈন্য সমঝোতা করেছেন পুতিন। ফলে পিয়ং ইয়ঙের বাহিনীকে কিভের রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে দেখা গিয়েছে।
একই ভাবে বর্তমানে চিন এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়ে একটি শক্তিজোট গড়ে তুলতে চাইছে রাশিয়া। এর জন্য নয়াদিল্লি ও বেজিঙের সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিচ্ছে মস্কো। দুই প্রতিবেশী শেষ পর্যন্ত ওই ব্যারিকেড টপকাতে পারলে ক্রেমলিনের স্বপ্ন যে পূরণ হবে, তা বলাই বাহুল্য। তখন ‘রিক ট্রয়িকা’ (রাশিয়া-ভারত-চিন ত্রিশক্তি) তৈরিতে কোনও বাধাই থাকবে না।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে শুরু হয় মতাদর্শগত লড়াই। ইতিহাসবিদেরা একেই ‘ঠান্ডা লড়াই’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই সময়ে মস্কো ও ওয়াশিংটন সরাসরি লড়াইয়ে জড়ায়নি। তবে সহযোগী দেশগুলির মধ্যে সেটা দেখা গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে ওই ‘স্নায়ুর যুদ্ধে’ ইতি টানে দুই দেশ।
তবে বিশ্লেষকদের দাবি, ‘দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধে’র সঙ্গে প্রথমটির বেশ কিছু অমিল রয়েছে। আগের বার পুরোটাই ছিল আমেরিকা বনাম রাশিয়া। এ বার রঙ্গমঞ্চে রয়েছে চিন, ভারত ও ইজ়রায়েলের মতো একাধিক শক্তিশালী দেশ। অন্য দিকে, মতাদর্শের জায়গায় জাতীয় নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কোল্ড ওয়ার ২.০’-তে।