প্রায় আড়াই দশক আগে আলাদা হয়েছে হাঁড়ি। তার পরেও ‘ছোট ভাই’য়ের সংসারে মাঝেমধ্যেই নাক গলাত ‘দাদা’। ফলে দিন দিন বাড়ছিল ক্ষোভ। বর্তমানে সেই সংঘাত এতটাই তীব্র হয়েছে যে, একে অপরকে শেষ করতে দু’পক্ষই গোপনে ছুরিতে দিচ্ছে শান! এর প্রভাবে পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার সংযোগস্থলের দক্ষিণ ককেশাসে যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে পারে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে জন্ম হয় রাশিয়া-সহ ১৫টি রাষ্ট্রের। তার মধ্যে অন্যতম হল দক্ষিণ ককেশাস এলাকার আজ়ারবাইজান। সোভিয়েত পরিবারের অংশ থাকায় প্রথম দিকে মস্কো ও বাকুর মধ্যে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। কিন্তু, কয়েক বছরের মধ্যেই সেই প্রেমে চিড় ধরে। গত পাঁচ বছরে ফাটল এতটাই চওড়া হয়েছে যে দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
রাশিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে প্রায় ৩৭৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। সোভিয়েতের পতনের পর বাকুর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় মস্কো। পাশাপাশি, ইউরোপের বাজারে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির ব্যাপারেও পুরোপুরি ক্রেমলিনের উপরে নির্ভরশীল ছিল কাস্পিয়ান সাগরের কোলের এই দেশ। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই দুই বিষয়কে কেন্দ্র করেই তীব্র হয়েছে দু’পক্ষের সংঘাত, যেটা বর্তমানে হুমকি এবং পাল্টা হুমকিতে বদলে গিয়েছে।
প্রতিরক্ষাপ্রেমী রুশ ব্লগারেরা মনে করেন, আগামী দিনে কাস্পিয়ান সাগরের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বাকুর সঙ্গে সম্মুখসমরে জড়াবে মস্কো। এখন থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু করা উচিত বলে সুর চড়িয়েছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, সোভিয়েতের পতনে আজ়ারবাইজানের স্বাধীনতায় এই সংঘাতের বীজ বোনা হয়েছিল। ওই সময়ে বাকুকে আর্থিক সহায়তা দিত ক্রেমলিন। দক্ষিণ ককেশাসের দেশটিতে বিপুল পরিমাণে বিক্রি হত রুশ পণ্য। কিন্তু তাতেও বাকুর আর্থিক ভাবে আখেরে লাভ হয়নি।
গত শতাব্দীর ’৯০-এর দশকে বিপুল পরিমাণে রুশ আর্থিক সাহায্য পেলেও আজ়ারবাইজানের ৫০ শতাংশ আমজনতা ছিল দারিদ্রসীমার নীচে। পরিস্থিতির বদল আনতে কাস্পিয়ান সাগর থেকে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করে বাকু। তাদের জ্বালানির মূল ক্রেতা ছিল পশ্চিম ইউরোপ। মস্কোর সাহায্যে তা সেখানকার দেশগুলিকে বিক্রি করত দক্ষিণ ককেশাস এলাকার এই দেশ।
২০০৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে এই পরিস্থিতিতে আসে বড় বদল। আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে তেল এবং গ্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ শুরু করে আজ়ারবাইজান। এর জন্য তুরস্ক-সহ পশ্চিম ইউরোপ থেকে মোটা টাকা হাতে পায় বাকু। ফলে ধীরে ধীরে তার উপর কমতে থাকে রুশ প্রভাব। পাশাপাশি, আঙ্কারার হাত ধরে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে আরও মজবুত হয় তাদের সম্পর্ক।
পরবর্তী বছরগুলিতে কাস্পিয়ান সাগরের তেল পশ্চিম ইউরোপে নিয়ে যেতে দু’টি পাইপলাইন তৈরি করে আজ়ারবাইজান। এর মধ্যে প্রথমটি হল ‘বাকু-তিবিলিসি-সেহান’ বা বিটিসি। জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসি হয়ে যেটা তুরস্কের সেহানে গিয়ে শেষে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকাটি ভূমধ্যসাগর সংলগ্ন হওয়ায়, সেখান থেকে দক্ষিণ ইউরোপে আজ়ারবাইজাইনের পক্ষে জ্বালানি সরবরাহ করা সহজ হয়েছে।
দ্বিতীয় পাইপলাইনের নাম ‘সাউদার্ন গ্যাস করিডর’। তুরস্কের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এই পাইপলাইনের মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে বাকু। এই প্রকল্পটির সিংহভাগ অর্থ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-ভুক্ত ২৭টি দেশ। খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপারে রুশ নির্ভরতা কমাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। সেই কারণে আজ়ারবাইজানের কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন ডেনিজ গ্যাসক্ষেত্রের উপরে ভরসা করতে চাইছে ইইউ।
তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হতেই সেনাবাহিনীকে আধুনিক করার দিকে নজর দেয় আজ়ারবাইজান। সোভিয়েতের পতনের পর ওই এলাকায় জন্ম হয় আর্মেনিয়া নামের আরও একটি স্বাধীন দেশের। প্রথম দিন থেকেই তাদের সঙ্গে নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকাকে কেন্দ্র করে বাকুর বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এ ব্যাপারে বার বার রাশিয়ার সাহায্য চেয়েও কোনও লাভ হয়নি। উল্টে সেখানে শান্তি বাহিনীকে মোতায়েন রেখে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে মস্কো।
নাগোর্নো-কারাবাখ এলাকাটির অবস্থান আজ়ারবাইজানের মধ্যে। কিন্তু সেখানে আর্মেনীয় বাসিন্দার সংখ্যা বেশি হওয়ায় সোভিয়েতের পতনের পর একে ইয়েরেভানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এতে প্রবল আপত্তি জানায় বাকু। এই ইস্যুতে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক বার ছোটখাটো যুদ্ধও হয়েছে। সংঘাতের সময়ে আর্মেনিয়া এবং আজ়ারবাইজান— দু’টি দেশকেই বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার বিক্রি করত মস্কো। তা ছাড়া মধ্যস্থতার নামে যুযুধান দু’পক্ষকে এত দিন একরকম জোর করে সংঘর্ষবিরতিতে বাধ্য করছিল ক্রেমলিন।
রাশিয়ার এ-হেন আচরণে আজ়ারবাইজানের মধ্যে বাড়তে থাকে ক্ষোভ। আর তাই মস্কোর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে গোপনে গোপনে তুরস্ক এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির থেকে হাতিয়ার আমদানি করা শুরু করে বাকু। এর পর আটঘাট বেঁধে একদিন হঠাৎ ঝটিকা আক্রমণে নাগোর্নো-কারাবাখ দখল করে আজ়ারবাইজানের সেনা। ছ’সপ্তাহের লড়াইয়ে তাদের কাছে হার স্বীকার করে আর্মেনীয় বাহিনী। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই কৌশলগত জয় অনেকাংশেই বাড়িয়ে দেয় বাকুর মনোবল।
এই যুদ্ধে আজ়ারবাইজানকে হাতিয়ার দিয়ে সর্বাধিক সাহায্য করে তুরস্ক। আঙ্কার তৈরি ‘বের্যাক্টার টিবি-২’ হামলাকারী ড্রোন লড়াইয়ের গতি রাতারাতি বদলে দিয়েছিল। এ ছা়ড়া প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করে বাকুর পাশে দাঁড়ায় ইজ়রায়েলও। পশ্চিম এশিয়ায় আরব দেশ বেষ্টিত ইহুদিরা মুসলিম রাষ্ট্র আজ়ারবাইজানকে বন্ধু হিসাবে পাশে পেতে প্রবল আগ্রহী। এর মাধ্যমে ইসলাম বিরোধী ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তেল আভিভ।
আজ়ারবাইজানের রুশ বিরোধিতার সর্বশেষ কারণ হল মস্কোর আগ্রাসী মনোভাব। ২০০৮ সালে প্রতিবেশী জর্জিয়ার আবখাজিয়া এবং দক্ষিণ ওসেটিয়াকে স্বাধীন দেশ হিসাবে ঘোষণা করে ক্রেমলিন। শুধু তা-ই নয়, এই ইস্যুতে জোর খাটাতে তিবিলিসির সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতেও পিছপা হননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এর পর ২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ছিনিয়ে নেন তিনি। এককালের সোভিয়েত দেশগুলির উপরে মস্কোর এ-হেন ‘জোরজুলুম’ দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বাকু।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আগামী দিনে কাস্পিয়ান সাগরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে রাশিয়া। সেই আশঙ্কা থেকেই পশ্চিমি দুনিয়া এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করছে আজ়ারবাইজান। পাশাপাশি, সমান তালে চলেছে সামরিক আধুনিকীকরণ। কাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন এলাকা হাতছাড়া হলে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার হারাবে বাকু। সে ক্ষেত্রে দক্ষিণ ককেশাস এলাকার দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়তে দু’দিনও লাগবে না।
অন্য দিকে, এই যুদ্ধ শুরু করার নেপথ্যে রাশিয়ারও একাধিক কারণ রয়েছে। দক্ষিণ বাল্টিক সাগর এবং উত্তরে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত ইতিমধ্যেই সম্প্রসারিত হয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন)। ফলে একরকম চক্রব্যূহের ঘেরাটোপের মধ্যে পড়ে গিয়েছে মস্কো। এই অবস্থায় বাকুর উপরে পশ্চিমি শক্তির প্রভাব বাড়তে থাকলে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ক্রেমলিনের সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।
বিশ্লেষকদের দাবি, আজ়ারবাইজানকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সামনে রয়েছে চারটি রাস্তা। প্রথমত, ককেশাস এলাকার দাগেস্তান দিয়ে প্রতিবেশী দেশটিতে সেনা অভিযান চালাতে পারে মস্কো। দ্বিতীয়ত, কাস্পিয়ান সাগরে আগ্রাসী হতে পারে রুশ নৌসেনা। তৃতীয়ত, আর্মেনিয়াকে কাজে লাগিয়ে সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢালার সুযোগ রয়েছে ক্রেমলিনের সামনে। এ ছাড়া সেখানকার বিদ্রোহীদের মদত দিয়ে আড়ালে থেকে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
দক্ষিণ ককেশাস এলাকায় শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক এবং ইজ়রায়েলের পাশাপাশি পাকিস্তানের থেকেও হাতিয়ার পেতে পারে আজ়ারবাইজান। কারণ, আর্মেনিয়াকে কোনও দেশের মর্যাদা দিতে নারাজ ইসলামাবাদ। অন্য দিকে, রাশিয়ার পক্ষে অবশ্যই থাকবে বাকুর ঠিক নীচের দিকের দেশ ইরান। সে ক্ষেত্রে তেহরানের হাতে থাকা হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রগুলির আঘাত সহ্য করতে হতে পারে এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ওই দেশকে।
গত বছরের ডিসেম্বরে রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স) থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে আজ়ারবাইজানের একটি বিমান ধ্বংস হলে দু’পক্ষের মধ্যে বৃদ্ধি পায় উত্তেজনা। মস্কো একে দুর্ঘটনা বলে ক্ষমা চাইলেও বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার হুঁশিয়ারি দেয় বাকু। এর কয়েক দিনের মাথায় ইউক্রেনকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন আজ়ারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম হায়দার ওঘলু আলিয়েভ।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কিভের বিরুদ্ধে বিশেষ সামরিক অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে চলছে যুদ্ধ। এক সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থেকে ইউক্রেনও বর্তমানে পুরোপুরি পশ্চিমি দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। একটা সময়ে সেখান থেকে কিভকে বার করে আনার মরিয়া চেষ্টা করেছিল মস্কো। আজ়ারবাইজানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি একই দিকে গড়াচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে বাকু দখল প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। কারণ, দক্ষিণ ককেশাস এলাকাটি দুর্গম পাহাড় এবং ঘন জঙ্গলে ভরা। ফলে এই প্রাকৃতিক পরিবেশের সুযোগ নিয়ে মস্কো ফৌজের বড় ক্ষতি করতে পারে আজ়ারবাইজানের ফৌজ। গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয় নিতে পারে তারা। তবে রণাঙ্গনে ইরানের প্রবেশ ঘটলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।