‘অপারেশন সিঁদুর’-এ অভাবনীয় সাফল্য পেলেও রাতে ঘুম নেই ভারতীয় বায়ুসেনার। কারণ একটাই। বাহিনীর বহরে মারাত্মক ভাবে কমে গিয়েছে যুদ্ধবিমানের সংখ্যা। এই পরিস্থিতিতে ফের এক বার নয়াদিল্লির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ দিনের ‘বন্ধু’ রাশিয়া। পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির লড়াকু জেট এসইউ-৫৭ সরবরাহের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে মস্কো। কিন্তু ক্রেমলিনের যুদ্ধবিমান কিনলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো ঘাড়ে চাপবে না তো নিষেধাজ্ঞা? সংশয়ে ভুগছে কেন্দ্র।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ ফৌজ ইউক্রেন আক্রমণ করলে মস্কোর বিরুদ্ধে এককাট্টা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। পূর্ব ইউরোপের ‘বাদামি ভালুকের দেশ’টির উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে দেয় তারা। ফলে আন্তর্জাতিক মহলে ‘একঘরে’ হয়ে পড়ে ক্রেমলিন। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠিন ‘বেড়া’ টপকাতে হচ্ছে তাদের। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে লড়াকু জেটের চুক্তি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ এ ব্যাপারে বার বার টেনে আনছেন অপরিশোধিত খনিজ তেলের উদাহরণ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হতেই অর্থনীতি বাঁচাতে ভারতকে সস্তায় ‘তরল সোনা’ বিক্রির মেগা অফার দেয় রাশিয়া। মস্কোর প্রস্তাব লুফে নিতে নয়াদিল্লি বেশি দেরি করেনি। এতে অবশ্য বেজায় চটে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকার বাজারে এ দেশের পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন তিনি। পাশাপাশি, ক্রেমলিনের খনিজ তেল ‘উরাল ক্রুড’ আমদানি বন্ধের হুমকি দিতেও শোনা গিয়েছে তাঁকে।
প্রথম পর্যায়ে ট্রাম্পের হুমকি গায়ে মাখেনি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। জাতীয় স্বার্থে রুশ তেল আমদানি চালিয়ে যেতে থাকে নয়াদিল্লি। কিন্তু, অক্টোবরে মস্কোর দুই বৃহত্তম তেল শোধক সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে সেখান থেকে ‘তরল সোনা’ কেনা যথেষ্ট ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। এর পরই বাধ্য হয়ে ক্রেমলিনের তেল সরবরাহের বরাত বাতিল করে ইন্ডিয়ান অয়েল-সহ এ দেশের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি সংস্থা। এই একই সমস্যা লড়াকু জেটের ক্ষেত্রে হওয়ার যে ষোলো আনা আশঙ্কা রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
ভারতের এই উদ্বেগ ভালই আন্দাজ় করেছে রাশিয়া। আর তাই ইতিমধ্যেই নয়াদিল্লিকে সব ধরনের ‘ইতিবাচক’ আশ্বাস দিয়েছে মস্কো। ক্রেমলিনের দাবি, মোদী সরকারের যাবতীয় শর্ত মেনে হবে এসইউ-৫৭-এর প্রতিরক্ষা চুক্তি। লড়াকু জেটটির যাবতীয় প্রযুক্তি হস্তান্তরে আপত্তি নেই তাদের। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে ঘরের মাটিতে সম্পূর্ণ নিজস্ব যুদ্ধবিমান তৈরি করতে পারে কেন্দ্র। যদিও এই পদ্ধতিতে নিষেধাজ্ঞাকে সম্পূর্ণ ‘বুড়ো আঙুল’ দেখানো যাবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
সম্প্রতি এই ইস্যুতে সংবাদসংস্থা এএনআইয়ের কাছে মুখ খোলেন রুশ সরকারি প্রতিরক্ষা সংস্থা রস্টেকের সিইও সের্গেই চেমেজ়ভ। তাঁর কথায়, ‘‘মস্কো ও নয়াদিল্লির অংশীদারি বহু বছরের। একটা সময়ে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছিল পশ্চিমি বিশ্ব। তখনও আমরা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে ভারতীয় ফৌজকে অস্ত্র সরবরাহ করে গিয়েছি। পুরনো সেই পদ্ধতি আজও অব্যাহত রেখেছে ক্রেমলিন। পারস্পরিক স্বার্থ নিশ্চিত করার ব্যাপার আমরা আন্তরিক ভাবে আগ্রহী।’’
চেমেজ়ভ জানিয়েছেন, ভারতকে দেওয়া মস্কোর প্রস্তাবের প্রাথমিক লক্ষ্য হল এসইউ-৫৭ সরবরাহ। তবে পর্যায়ক্রমে নয়াদিল্লির হাতে এই যুদ্ধবিমানের উৎপাদন স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। রাশিয়ার অস্ত্র রফতানিকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’-এর একজন পদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বললে পঞ্চম প্রজন্মের জেটটির যাবতীয় প্রযুক্তি হাতে পাবে কেন্দ্র। এর মধ্যে থাকবে ইঞ্জিন, অপটিক্স, এইএসএ রেডার, কৃত্রিম মেধার উপাদান এবং যুদ্ধবিমানটিতে ব্যবহৃত হাতিয়ারের প্রযুক্তিগত যাবতীয় খুঁটিনাটি।
অন্য দিকে রস্টেকের সহযোগী সংস্থা ‘ইউনাইটেড এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন’-এর ডিরেক্টর জেনারেল ভাদিন বাদেখা আবার বলেছেন, ‘‘এসইউ-৫৭-এর ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ এবং প্রযুক্তিগত দাবিগুলির ইতিবাচক সমাধান করা হয়েছে।’’ সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। যদিও এই নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি কেন্দ্র।
এসইউ-৫৭-এর মূল নির্মাণকারী সংস্থা হল এই ‘ইউনাইটেড এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন’। তবে ‘স্টেলথ’ ক্যাটেগরির দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট এই যুদ্ধবিমানের নকশা তৈরি করেছে বিখ্যাত রুশ লড়াকু বিমান কোম্পানি ‘সুখোই’। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে মস্কোর বিমানবাহিনী।
‘স্টেলথ’ ক্যাটেগরির হওয়ায় ‘এসইউ-৫৭’কে রাডারে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। মাঝ-আকাশে অন্য লড়াকু বিমানের সঙ্গে ‘ডগফাইট’ হোক বা আকাশপথে আক্রমণ শানিয়ে মাটির উপরে থাকা শত্রুঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া, সবেতেই এই যুদ্ধবিমানের জুড়ি মেলা ভার। এ ছাড়া ‘ইলেকট্রনিক যুদ্ধ’-এর সুবিধাও পাবেন এসইউ-৫৭-এর যোদ্ধা পাইলট।
ভারতীয় বায়ুসেনা দীর্ঘ দিন ধরেই এই সংস্থার তৈরি এসইউ-৩০এমকেআই নামের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে। এককথায়, সুখোইয়ের সঙ্গে এ দেশের ফাইটার পাইলটদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, এসইউ-৫৭ থেকে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নানা মারণাস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ থাকছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ‘ব্রহ্মস’ এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র তৈরি ‘অস্ত্র’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র।
সম্প্রতি এসইউ-৫৭ যুদ্ধবিমানে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তি যোগ করে তার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ক্রেমলিন। গত ফেব্রুয়ারিতে বেঙ্গালুরুর ‘অ্যারো ইন্ডিয়া’ শো-তে অংশ নিয়েছিল এই রুশ লড়াকু জেট। এর শব্দের দ্বিগুণ গতিতে (দুই ম্যাক) ছোটার ক্ষমতা রয়েছে। সর্বোচ্চ ১০ টন পর্যন্ত সমরাস্ত্র বহন করতে পারে মস্কোর ‘উড়ন্ত দৈত্য’।
গত জুনে এসইউ-৫৭-এর ব্যাপারে ভারতকে বড় অফার দেয় রুশ রফতানিকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’। মস্কোর লড়াকু জেটটির ব্যাপারে চুক্তি করলে নয়াদিল্লিকে ‘সোর্স কোড’ সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়ে দেয় তারা। প্রতিটি যুদ্ধবিমানে থাকে একাধিক সফ্টঅয়্যার। সেগুলির ভিত্তিতেই মাঝ-আকাশ থেকে লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করেন ককপিটের যোদ্ধা পাইলট। ছুড়তে পারেন ক্ষেপণাস্ত্র বা লেজ়ার গাইডেড বোমার মতো অস্ত্র।
বিশেষজ্ঞদের কথায়, যে কোনও সফ্টঅয়্যারের ‘প্রাণ’ হল ‘সোর্স কোড’। এর উপর ভিত্তি করে কাজ করে ওই প্রযুক্তি। আর তাই ‘সোর্স কোড’ হাতে পেলে যে কোনও লড়াকু জেটকে নিজের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারবে ভারতীয় বিমানবাহিনী। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানে জুড়ে নিতে কোনও সমস্যা হবে না তাঁদের। ফলে রাশিয়ার তরফে এসইউ-৫৭-এর ‘সোর্স কোড’ দিতে চাওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসায় দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল।
ওই ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় আরও এক ধাপ এগিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দুই আসন বিশিষ্ট লড়াকু বিমান নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। সংশ্লিষ্ট পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানটির উন্নত সংস্করণ দ্বিপাক্ষিক ভাবে তৈরি করার প্রবল ইচ্ছা রয়েছে মস্কোর। এককথায় নয়াদিল্লিকে তাঁদের প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের ছাড়পত্র দিতে চাইছে ক্রেমলিন।
কিছু দিন আগেই মস্কো সফরে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পুতিনের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা নিকোলাই পাত্রুশেভ। ঠিক তার পরেই এসইউ-৫৭ নিয়ে একের পর এক মেগা অফার দিয়েছে ক্রেমলিন, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
কিন্তু তার পরেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কাঁটা থেকেই যাচ্ছে। কারণ রুশ হাতিয়ার কিনলে ‘কাউন্টারিং আমেরিকাজ় অ্যাডভাইসরিজ় থ্রু স্যাংশনস অ্যাক্ট’ বা কাটসা প্রয়োগ করে নয়াদিল্লিকে ঝামেলায় ফেলতে পারে ওয়াশিংটন। গত জুনে এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন আমেরিকার বাণিজ্যসচিব হাওয়ার্ড লুটনিক। তিনি বলেন, ‘‘ওদের (পড়ুন ভারতের) বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের চামড়ার নীচে জ্বলুনি তৈরি করছে। বর্তমান সময়ে নয়াদিল্লির আমাদের থেকে অস্ত্র কেনা উচিত। কিন্তু, ওরা মস্কোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে বেশি আগ্রহী।’’
এ বছরের ডিসেম্বরে ভারত সফরে আসবেন পুতিন। মোদীর সঙ্গে একাধিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। তখনই এসইউ-৫৭-এর চুক্তি চূড়ান্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট জেটটি ছাড়াও এসইউ-৭৫ যুদ্ধবিমান, এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ ও এস-৫০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নত সংস্করণ তৈরি সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা চুক্তি হবে বলে ওয়াকিবহাল মহল থেকে মিলছে ইঙ্গিত।