Jaishankar on US-Pakistan Ties

‘লাদেনকে ভুলে গেলেন নাকি!’ ইতিহাস মনে করিয়ে ‘পাক-প্রেমী’ যুক্তরাষ্ট্রের যন্ত্রণা বাড়ালেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর

ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে শীতলতার মধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন আমেরিকা। এই আবহে কুখ্যাত জঙ্গি নেতা ওসামা বিন-লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০২৫ ১৬:৪৩
Share:
০১ ২০

‘কৌশলগত অংশীদার’ হওয়া সত্ত্বেও ভারত-মার্কিন সম্পর্কে এসেছে শীতলতা! অন্য দিকে, পাকিস্তানকে নিয়ে ‘দরদ’ উথলে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের। এই পরিস্থিতিতে ফের এক বার কুখ্যাত জঙ্গি নেতা ওসামা বিন-লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে আমেরিকাকে খোঁচা দিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ওয়াশিংটন ও ইসালামাবাদের ‘ইতিহাস বিস্মৃতি’র রোগ আছে বলেও বিস্ফোরক মন্তব্য করেন তিনি।

০২ ২০

চলতি বছরের ২৩ অগস্ট একটি অনুষ্ঠানে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা এবং পাকিস্তানের মধ্যে চলা ‘প্রেমের সম্পর্ক’ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন জয়শঙ্কর। তখনই নাম না-করে লাদেনের কথা বলতে শোনা যায় তাঁকে। বিদেশমন্ত্রী বলেন, ‘‘ওদের একে অপরের সঙ্গে চলার একটা ইতিহাস রয়েছে। আবার ইতিহাসকে উপেক্ষা করেও চলতে ভালবাসে ওয়াশিংটন ও ইসালামাবাদ। এটা আমাদের কাছে একেবারেই নতুন নয়।’’

Advertisement
০৩ ২০

এর পর যুক্তরাষ্ট্রকে কটাক্ষ করে জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘মজার বিষয় হল, মাঝেমাঝে মার্কিন সামরিক বাহিনীর তরফে কাউকে দরাজ শংসাপত্র দিতে দেখা যাবে। এটা সেই একই ফৌজ যারা অ্যাবটাবাদে ঢুকেছিল এবং সেখানে কে থাকছেন, তা জানতে পেরেছিল। যখন কোনও দেশ সুবিধাবাদী রাজনীতির উপরে বেশি জোর দেয়, তখন তারা এটা করে থাকে। এটা কৌশলগত পদক্ষেপও হতে পারে।’’

০৪ ২০

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালায় কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়দা। ছিনতাই করা যাত্রিবাহী বিমানের ধাক্কায় নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (পড়ুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) জোড়া অট্টালিকাকে ধূলিসাৎ করে দেয় তারা। একই কায়দায় হামলা হয় পেনসিলভ্যানিয়া এবং আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনেও।

০৫ ২০

৯/১১ জঙ্গি হামলায় নিহত হন তিন হাজারের বেশি মানুষ। আহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ছ’হাজার। এই ঘটনার মূল চক্রী হিসাবে উঠে আসে আল কায়দার প্রতিষ্ঠাতা বিন-লাদেনের নাম। ২০১১ সালের ২ মে উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের অ্যাবটাবাদের গুপ্তঘাঁটিতে ঢুকে তাঁকে নিকেশ করে মার্কিন কম্যান্ডো বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সামরিক অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’।

০৬ ২০

বিন-লাদেনের মৃত্যুর পর ওয়াশিংটন ও ইসালামাবাদের সম্পর্কে ব্যাপক পতন দেখেছিল বিশ্ব। মার্কিন কমান্ডো বাহিনীর ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’-এর কড়া সমালোচনা করে পাকিস্তান। এতে দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়েছে বলে সুর চড়ান পশ্চিমের প্রতিবেশীর রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা। পাশাপাশি, অ্যাবটাবাদে আল-কায়দার শীর্ষনেতার লুকিয়ে থাকার খবর তাদের অজানা ছিল বলেও জানিয়েছিল ইসলামাবাদ।

০৭ ২০

যদিও পাকিস্তানের এই যুক্তি মানতে চায়নি আমেরিকা। উল্টে লাদেনকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার নেপথ্যে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের হাত ছিল বলে দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী দশকগুলিতে ইসলামাবাদকে দেওয়া আর্থিক অনুদানের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস করে মার্কিন সরকার। পাশাপাশি, ওয়াশিংটনের চাপে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ ও আর্থিক অনুদান পাওয়া পাক সরকারের পক্ষে কঠিন হয়েছিল।

০৮ ২০

বর্তমানে পাক-মার্কিন সম্পর্কে মাখোমাখো ভাবের নেপথ্যে কোন ‘কৌশলগত’ হিসাব কাজ করছে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি জয়শঙ্কর। তবে কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত হবে পশ্চিম এশিয়া। সেই সংঘাতে ইহুদিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে আমেরিকা। সংঘর্ষের সময় ইসলামাবাদকে কাজে লাগাতে চায় ওয়াশিংটন।

০৯ ২০

দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তানের সঙ্গে ইরানের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, যুদ্ধের সময়ে ওই এলাকা যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে মার্কিন সেনা অফিসারদের। সেই কারণেই ইসলামাবাদকে হাতে রাখতে চাইছে ওয়াশিংটন। এ বছর তেহরান এবং তেল আভিভের মধ্যে চলা সংঘর্ষের সেই সুবিধা যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা পেয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেয় দুই দেশ।

১০ ২০

গত জুনে ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে হওয়া ওই সামরিক অভি‌যানের নাম ছিল ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, সাবেক পারস্য দেশে ঢোকার আগে বালোচিস্তানের আকাশে সংশ্লিষ্ট বোমারু বিমানগুলিকে চক্কর কাটতে দেখা গিয়েছিল।

১১ ২০

এ বছরের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, সেখানেই আমেরিকার বিমানবাহিনীর জন্য বালোচিস্তানের আকাশসীমা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন মুনির। ফলে ইরানে আক্রমণের আগে ‘রেকি’ করতে কোনও সমস্যা হয়নি ওয়াশিংটনের।

১২ ২০

ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতে আমেরিকার প্রবেশে পাক ফৌজের ভূমিকা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মধ্যে দু’ধরনের মতামত রয়েছে। এক দলের দাবি, মুনিরকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে তাঁকে ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প। তাঁর নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোনও অবস্থাতেই যুদ্ধে জড়াবেন না বলে নিশ্চিত ছিল ইসলামাবাদ। সেই কারণে বালোচিস্তানের আকাশে মার্কিন যুদ্ধবিমানের প্রবেশে কোনও বাধা দেননি রাওয়ালপিন্ডির ‘সিপাহসালার’।

১৩ ২০

কিন্তু, এই যুক্তি মানতে নারাজ বিশ্লেষকদের অপর অংশ। তাঁদের দাবি, ইরানে মার্কিন বিমানবাহিনী যে হামলা করতে চলেছে, মধ্যাহ্নভোজের অনুষ্ঠানেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যান মুনির। ফলে জেনেবুঝেই ‘ইসলামিক ভাই’ তেহরানের পিঠে ছুরি বসিয়েছেন তিনি। এই বিশ্বাসঘাতকতায় পাক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পাশে পেয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেল। বিনিময়ে মোটা টাকায় মুনিরের পকেট অবশ্য ভরিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

১৪ ২০

এ বছরের ৩১ অগস্ট অবসরগ্রহণ করবেন মার্কিন ফৌজের সেন্ট্রাল কমান্ডের শীর্ষ আধিকারিক জেনারেল মাইকেল কুরিল্লা। তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে দু’মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বার আমেরিকা সফর করেন মুনির। পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর সীমান্তপার সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যখন ইসলামাবাদের উপরে নয়াদিল্লি চাপ বাড়াচ্ছে, ঠিক তখনই জঙ্গি দমনে পাকিস্তানের ভূয়সী প্রশংসা করে শোরগোল ফেলে দেন এই কুরিল্লা।

১৫ ২০

কিছু দিন আগে পেন্টাগনের দেওয়া গোয়েন্দা তথ্যকে কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস-খোরাসানের পাঁচ জঙ্গিকে আটক করে পাক সেনা। ওই ঘটনায় বেশ খুশি ছিল আমেরিকা। এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন কুরিল্লা। এর পরেই তাঁকে অন্যতম সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ়’-এ ভূষিত করে পশ্চিমের প্রতিবেশী।

১৬ ২০

যুক্তরাষ্ট্রের ‘পাক-প্রেম’-এর নেপথ্যে আরও কিছু কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। গত জুলাইয়ে ইসলামাবাদের ‘বিশাল তৈলভান্ডার’ নিয়ে যৌথ ভাবে কাজ করার বার্তা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর অবশ্য দাবি, তেলের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশি আগ্রহ রয়েছে বালোচিস্তানের অনাবিষ্কৃত বিরল খনিজ ভান্ডারের উপর, যা বৈদ্যুতিন এবং সামরিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৭ ২০

দেশের এই বিরল খনিজ সম্পদ নিয়ে কিছু দিন আগে গণমাধ্যমে লেখা একটি নিবন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। সেখান তিনি লেখেন, ‘‘আমাদের কাছে যে বিরল খনিজ সম্পদ রয়েছে তাতে জাতীয় ঋণ কমানো সম্ভব। এর সাহায্যে শীঘ্রই সমৃদ্ধ বিশ্বের মধ্যে জায়গা পাবে ইসলামাবাদ।’’

১৮ ২০

এপ্রিলে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানকে শিক্ষা দিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে ভারতীয় সেনা। সঙ্গে সঙ্গেই সন্ত্রাসীদের রক্ষায় নয়াদিল্লির উপর পাল্টা প্রত্যাঘাত শানায় ইসলামাবাদের ফৌজ। কিন্তু, রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা এ দেশের বাহিনীর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেননি। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাক বায়ুসেনার একাধিক ছাউনি উড়িয়ে দেয় ভারত।

১৯ ২০

ওই পরিস্থিতিতে সংঘর্ষবিরতি চেয়ে এ দেশের ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন’ বা ডিজিএমও-র সঙ্গে ফোনে কথা বলেন পাক সেনার সম পদমর্যাদার এক অফিসার। ওই কথোপকথনের পর বন্ধ হয় লড়াই। যদিও সংঘাত থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছেন বলে বার বার দাবি করে চলেছেন ট্রাম্প। নয়াদিল্লি সেই দাবি খারিজ করে দিলেও বিষয়টি মেনে নেয় ইসলামাবাদ। এর জন্য ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত বলেও দাবি করেছেন মুনির ও প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ।

২০ ২০

ট্রাম্প আবার পাকিস্তানে তাঁর ক্রিপ্টো মুদ্রা ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন ফিল্ড মার্শাল মুনিরকে। সেই কারণেই ইসলামাবাদের দিকে ঝুঁকে আছেন তিনি। এতে ভারত-মার্কিন ‘কৌশলগত সম্পর্ক’-এর ফাটল ক্রমশ চওড়া হচ্ছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement