কোরীয় উপদ্বীপে অশান্তির কালো মেঘ। মাঝেমধ্যেই যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে পিয়ংইয়ং। সেখানকার ‘সুপ্রিম লিডার’ কিম জং-উনের হাতে রয়েছে দূরপাল্লার পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র। এই পরিস্থিতিতে দুর্ভেদ্য বর্মে দেশের আকাশকে ঢেকে ফেলতে অত্যাধুনিক ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরিতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে সোল। বিখ্যাত ইজ়রায়েলি হাতিয়ার ‘আয়রন ডোম’-এর আদলে সেটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে মিলেছে খবর।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির অন্যতম হল হানওয়া গ্রুপ। তাদের তত্ত্বাবধানে কম উচ্চতার ক্ষেপণাস্ত্রকে ঠেকাতে উপযোগী বিশেষ ধরনের একটি রেডারের নমুনা বা প্রোটোটাইপ তৈরির চেষ্টা করছে সোল। হাতিয়ারটির নাম ‘কোরীয় লৌহকবচ’ (কোরিয়ান আয়রন ডোম) রেখেছে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র। যদিও এর সঙ্গে ইহুদি সেনার ‘আয়রন ডোম’-এর বেশ পার্থক্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
‘কোরিয়ান আয়রন ডোম’-এর খবর সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আনে স্থানীয় সংবাদ সংস্থা ‘কোরিয়াইট টাইমস’। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ১৩১৫০ কোটি কোরিয়ান ওন খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সোল। মার্কিন মুদ্রা ডলারের নিরিখে খরচের অঙ্ক প্রায় ৯ কোটি ২০ লক্ষ। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে হানওয়া গ্রুপ ‘কোরিয়ান আয়রন ডোম’-এর নমুনা তৈরি করে ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, স্বল্পপাল্লার বিপুল সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে সোলের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা সংশ্লিষ্ট রেডারভিত্তিক আকাশ প্রতিরোধী ব্যবস্থাটির নকশা তৈরি করছেন বলে জানা গিয়েছে। ই়জ়রায়েলি ‘আয়রন ডোম’-এর থেকে এর সক্ষমতা অনেক বেশি হবে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। যে কোনও পরিবেশে কাজ করতে পারবে কোরিয়ার এই ‘লৌহকবচ’।
সোলের সাবেক সেনাকর্তারা মনে করেন, সংশ্লিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি তৈরি হয়ে গেলে রাজধানীর নিরাপত্তায় তা মোতায়েন করা হবে। এর মাধ্যমে একসঙ্গে কতগুলি ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করা সম্ভব, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণের ক্ষেত্রে হানওয়া গ্রুপের বেশ নামডাক রয়েছে। গত বছর পশ্চিম এশিয়ায় ‘চেওংগুং-টু’ নামের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রফতানি করে তারা। ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র সমৃদ্ধ ওই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটি ইতিমধ্যেই আরবভূমিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ইজ়রায়েলের হাতে যে ‘আয়রন ডোম’ রয়েছে, তা অবশ্য কৃত্রিম উপগ্রহ পরিচালিত নয়। স্বল্পপাল্লার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, মর্টার ও কামানের গোলা আটকাতে এর নকশা তৈরি করেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে প্যালেস্তাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে চলা যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়েছে ইজ়রায়েলের এই ‘লৌহকবচ’। তাঁদের ছোড়া ৯৮ শতাংশ রকেটকে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে এর ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র।
২০১১ সালে প্যালেস্তাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রথম বার ‘আয়রন ডোম’ ব্যবহার করে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। ওই লড়াইয়ে সাফল্য মেলায় হাতিয়ারটির উন্নত সংস্করণ তৈরিতে মন দেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। তাঁদের এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের পাল্লা ৭৫ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। অস্ত্রটির মোট তিনটি অংশ রয়েছে।
ইজ়রায়েলি ‘লৌহকবচ’-এ রয়েছে শক্তিশালী রেডার। এর সাহায্যে শত্রুর ছোড়া স্বল্পপাল্লার রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র এবং মর্টারের গোলাকে চিহ্নিত করতে পারে আইডিএফ। দ্বিতীয় অংশটির নাম ব্যাটেল ম্যানেজ়মেন্ট অ্যান্ড ওয়েপন কন্ট্রোল বা বিএমসি। এর সাহায্যে আগত ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা মর্টারের গোলাকে কোথায় ধ্বংস করা হবে, তা স্থির করা হয়। তৃতীয় অংশটি হল মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট। সেখান থেকে ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে গিয়ে মাঝ-আকাশে শত্রুর ছোড়া হাতিয়ারগুলিকে ধ্বংস করে।
রাফাল অ্যাডভান্স ডিফেন্স সিস্টেম্স এবং ইজ়রায়েলি অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়ের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ‘আয়রন ডোম’। ২০০৫ সালে এর নকশা তৈরি করেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির এক একটি ব্যাটারিতে থাকে তিন থেকে চারটি করে লঞ্চার। প্রতি লঞ্চারে আবার রয়েছে ২০টি করে ‘তামির’ ক্ষেপণাস্ত্র।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেও ইজ়রায়েলি ‘লৌহকবচ’-এর বেশ কিছু খামতি সকলের চোখে পড়েছিল। যুদ্ধের সময়ে লাগাতার শয়ে শয়ে রকেট পাঠিয়ে হামলা চালিয়েছিল হামাস। ফলে কিছু ক্ষেত্রে সেগুলি আটকাতে ব্যর্থ হয় ইহুদিদের এই ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। এই খামতি মুছে ফেলে ‘কোরিয়ান আয়রন ডোম’ তৈরি করতে চাইছেন সোলের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
সম্প্রতি নতুন প্রজন্মের ট্যাঙ্ক তৈরির দিকে নজর দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। সূত্রের খবর, তাতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চাইছে সোল। সংশ্লিষ্ট ট্যাঙ্কটি তৈরির বরাত পেয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থা হুন্ডাই রোটেম। ২০৩১ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন প্রজন্মের ট্যাঙ্কের নাম ‘কে-৩’ রাখা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বাহিনী সেটা হাতে পেলে ধীরে ধীরে বাতিল করবে বর্তমানে ব্যবহৃত ‘কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থার’ ট্যাঙ্ক।
গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল পরিমাণে ট্যাঙ্ক হারিয়েছে রাশিয়া। মূলত ড্রোন এবং মার্কিন জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েই মস্কোর একের পর এক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে কিভের ফৌজ। সেই ঘটনার উপর কড়া নজর ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা গবেষকদের। সেই কারণে ‘কে-৩’কে বজ্রকঠিন করে গড়ে তুলতে চাইছেন তাঁরা। ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হাতিয়ারটি যাতে অক্ষত থাকে, সেটাই তাঁদের লক্ষ্য।
এ ছাড়া ‘কে-৩’কে হাইব্রিড মডেলের ট্যাঙ্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে হুন্ডাই রোটামের। প্রাথমিক ভাবে এতে থাকবে হাইড্রোজ়েন চালিত প্রপালশান সিস্টেম। তবে ২০৪০ সালের মধ্যে একে পুরোপুরি হাইড্রোজ়েন শক্তিচালিত হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সোলের ওই সংস্থার। যুদ্ধের সময় সংশ্লিষ্ট ট্যাঙ্ক যাতে রেডারে ধরা না পড়ে তার জন্য একে ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির করে গড়ে তুলতে চাইছেন তাঁরা।
নতুন প্রজন্মের ‘কে-৩’ ট্যাঙ্ক নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন হুন্ডাই রোটেমের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আজকের দিনে বিশ্বের তাবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনী যে মেন ব্যাটেল ট্যাঙ্ক বা এমবিটি ব্যবহার করে তার সক্ষমতাকে এটি ছপিয়ে যাবে। ভবিষ্যতে যুদ্ধের ময়দানে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকায় একে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’
সূত্রের খবর, ভবিষ্যৎ যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে ‘কে-৩’-এর সমরসজ্জা করছে হুন্ডাই রোটেম। এতে থাকবে একটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় টারেট, যা প্রকৃতপক্ষে ১৩০ মিলিমিটারের স্মুথবোর বন্দুক। কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থারে ১২০ মিলিমিটারের বন্দুক ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মার্কিন এম-১ আব্রামস ট্যাঙ্কের মতো নেটোভুক্ত দেশগুলির ব্যবহৃত গোলা কে-৩ ট্যাঙ্ক থেকে ছোড়া যাবে বলে জানা গিয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা সংস্থাটি জানিয়োছে, যুদ্ধের সময় স্বয়ংক্রিয় অবস্থায় গোলা ভরার জন্য মাত্র সাড়ে তিন সেকেন্ড সময় নেবে ‘কে-৩’ ট্যাঙ্ক। এর সামনের দিকে একটি সাঁজোয়া ক্যাপসুলের মতো অংশ রাখা হয়েছে। এই ট্যাঙ্কটিকে চালাতে প্রয়োজন হবে মাত্র তিন জন সৈনিকের। কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি থাকায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সোলের ‘কে-৩’।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিমানবাহিনীর সঙ্গে ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’-এ সই করেছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বায়ুসেনা। এর পরই সোলের তৈরি ‘কেএফ-২১ বোরাম’ যুদ্ধবিমান নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে আরব মুলুকটি যথেষ্ট আগ্রহী বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, সমঝোতার চুক্তিতে সই করেন রিপাবলিক অফ কোরিয়া এয়ারফোর্সের (আরওকেএফ) প্রধান জেনারেল লি-ইয়ং সু এবং আমিরশাহীর বায়ুসেনা ও বিমান প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার মেজর জেনারেল রাশেদ মহম্মদ এ আল শামসি।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা শিল্প বেশ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র ক্ষেত্রে মার্কিন অস্ত্রের উপর এখনও নির্ভরশীল সোল। সম্প্রতি এমআরআইসি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কিনতে আমেরিকার মেরিন কোরের সঙ্গে একটি চুক্তি করে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। এই অস্ত্রের ব্যাটারিতে ১১টি ফায়ারিং গ্রুপ রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এ ছাড়া হাতিয়ারটির সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে এএন/টিপিএস-৮০ রেডার স্টেশন।