যদি কোনও পদার্থ বা ম্যাটারের সংস্পর্শে এটি আসে তা হলে ধ্বংস অনিবার্য। দুই বিপরীতধর্মী একে অপরকে স্পর্শ করলেই বিষম বিস্ফোরণ। দুটোই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে শুধু শক্তি বা এনার্জি। আমরা আমাদের চারপাশে যা কিছু দেখতে পাই, সবই পদার্থ বা ম্যাটার। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ম্যাটারেরই যমজ ভাই হল অ্যান্টিম্যাটার।
প্রতিটি পদার্থের কণার জন্য, একটি অ্যান্টিম্যাটার সংস্করণ রয়েছে, যা হুবহু একই রকম আবার বিপরীতধর্মীও বটে। যমজ ভাইয়ের এক ভাইয়ের স্বভাব, চরিত্র, এ ক্ষেত্রে অন্য ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। দু’টি বুদবুদ যেন। অবিকল এক, তবে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে কি ‘ভ্যানিশ’। তাই জগৎ-সংসারে ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটার ঠোকাঠুকি হলেই ঘটে যাবে মহাবিপদ।
দৃশ্যত এই মহাবিশ্বে কোনও অ্যান্টিম্যাটার নেই। প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের সময়ে ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটার দুই-ই তৈরি হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই পরিমাণটাও সমান ছিল। বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক ১৯২৮ সালে তাঁর গবেষণায় আবিষ্কার করেছিলেন একটি তত্ত্ব। পদার্থের ইলেকট্রন, প্রোটন যেমন কণা, তেমন তাদের দোসর বা যমজ কণাও বিদ্যমান।
ইলেকট্রনের দোসর পজ়িট্রন। প্রোটনের দোসর অ্যান্টিপ্রোটন। কিন্তু সবটাই উল্টো, ম্যাটারের বিপরীতকে অ্যান্টিম্যাটার নাম দিলেন ডিরাক। ইলেকট্রন আর পজ়িট্রনে আলাদা কিছু নেই, তফাত কেবল আধান বা চার্জে। ইলেকট্রন ঋণাত্মক বা নেগেটিভ আধানবিশিষ্ট হয়, আর পজ়িট্রন পজ়িটিভ বা ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট। আবার এ দিকে প্রোটন পজ়িটিভ। অ্যান্টিপ্রোটন ঠিক তার উল্টো নেগেটিভ।
যে তাত্ত্বিক গবেষণা ডিরাকের মস্তিষ্কপ্রসূত, হাতেকলমে তারই অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেখান বিজ্ঞানী কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন। পরীক্ষায় শনাক্ত করেন পজ়িট্রনকে। প্রমাণ হল, গণিত ভুল সঙ্কেত দেয়নি ডিরাককে। এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়ার পরও অ্যান্টিম্যাটার চিরকালই বিজ্ঞানীদের মনে রহস্য হয়ে বাসা বেঁধে রয়েছে।
এক ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের ফলেই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম। সেই সৃষ্টিলগ্নে চারদিকে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটারের ছড়াছড়ি। জন্মের পর তাতে শুধু জ্যোতি। ক্ষণকাল পরে যখন সেই জ্যোতি থেকে ধীরে ধীরে আবির্ভাব ঘটছে কণার, তখন ঠিক যে পরিমাণে জন্মেছিল ইলেকট্রন-প্রোটন, সেই পরিমাণেই এসেছিল পজ়িট্রন, অ্যান্টিপ্রোটন ইত্যাদি। তার পরেও কী ভাবে সব অ্যান্টিম্যাটার উবে গিয়ে পড়ে রইল শুধু ম্যাটার, তা এখনও ধাঁধাই।
কারণ জন্মলগ্নে দুই যমজ ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের কণাদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়িতেও বাধা ছিল না কোনও। তা হলে তো জন্মের পর পর তাদের সকলেরই ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়ার কথা। সেই নিয়ম মানতে গেলে আজকের ব্রহ্মাণ্ডে তো পদার্থ বলে কোনও কিছু থাকার কথাই নয়। তবু কোন জাদুমন্ত্রে আজ ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে শুধুই ম্যাটার? জন্মকালের ম্যাটারের দোসর অ্যান্টিম্যাটার সব গেল কোথায়?
কেন অ্যান্টিম্যাটার উবে গিয়ে পড়ে রইল শুধু পদার্থ বা ম্যাটার। তবে কি এক ভাইয়ের প্রতি বিশেষ কোনও পক্ষপাতিত্ব রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের? অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্ব যেন মানতেই চায় না এই ব্রহ্মাণ্ড। পদার্থবিজ্ঞানীদের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি কেন পদার্থ বা ম্যাটারের প্রতি ব্রহ্মাণ্ডের এত বেশি পক্ষপাত।
তাঁদের ধারণা ছিল ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি ছাড়া এই ব্রহ্মাণ্ডে আর যা কিছু আছে তাঁর সবটাই পদার্থ বা ম্যাটার। আর পদার্থ বা ম্যাটারের প্রতি বরাবরই একটা পক্ষপাত আছে এই ব্রহ্মাণ্ডে। নিয়মমতো এই ব্রহ্মাণ্ডে পদার্থ বা ম্যাটার আর অ্যান্টিম্যাটারের পরিমাণ থাকা উচিত সমান সমান।
কোনও পদার্থ বা ম্যাটার এবং অ্যান্টিম্যাটারের পরমাণুর ভর একই। কিন্তু আধান বিপরীত। কোয়ান্টাম নম্বরও ভিন্ন। তাই অ্যান্টিম্যাটারকে ম্যাটারেরই ‘যমজ ভাই’ বলা হয়। এ-হেন ‘না-পদার্থ’-এর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে অবাধ পতন প্রথম চাক্ষুষ করেছিলেন ইউরোপের পদার্থবিদ্যা বিষয়ক গবেষণাগার সার্নের বিজ্ঞানীরা।
সার্নের আলফা কোলাবোরেশনের এক সদস্য বিজ্ঞানী জেফরি হ্যাংস্টের কথায়, ‘‘বিশ্বের অর্ধেকই নিরুদ্দেশ।’’ পদার্থবিদেরা বিশ্বাস করেন, ম্যাটারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল অ্যান্টিম্যাটারের। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের সময় একে অপরকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল তারা। এখন যা পড়ে আছে, তার অনুপাত এ রকম— বিশ্বের পাঁচ শতাংশ ম্যাটার, বাকিটা প্রায় অজানা ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি দিয়ে তৈরি। কিন্তু অ্যান্টিম্যাটার প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছে।
অ্যান্টিম্যাটার তৈরি করা অবিশ্বাস্য রকম কঠিন এবং সংরক্ষণ করা আরও কঠিন। কোনও পরমাণুর উপরে বাড়তি তাপ, চাপ বা চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করে তাকে বলশালী করে তুললে ইলেকট্রনগুলি উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখন পরমাণুর ভিতরের কক্ষপথ থেকে কণা চলে যায় বাইরে। বাইরের কক্ষপথে দৌড়তে থাকে কণাগুলি। কক্ষপথে বাড়তি শক্তি টেনে নেওয়াই থাকে উদ্দেশ্য।
আবার পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলে সেই বাড়তি শক্তি বাইরের কক্ষপথে ছেড়ে দেয় ইলেকট্রনগুলি। সেগুলি আলোর আকারে বেরিয়ে আসে। সুইৎজ়ারল্যান্ডে জেনিভার অদূরে সার্ন-এর ভূগর্ভস্থ আলফা গবেষণাগার। সেখানে লার্জ হ্যা়ড্রন কোলাইডারে সেই আলোরই বর্ণালী পরীক্ষা করে ২০১৬ সালে অ্যান্টিম্যাটারের হদিস পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ২০ বছর ধরে নিরলস অনুসন্ধান পর্বের পর শেষ পর্যন্ত হদিস মিলেছিল এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম কোনও অ্যান্টিম্যাটারের।
সার্নের গবেষণাগারে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ কয়েক বছরের অক্লান্ত গবেষণার ফসল কয়েক ন্যানোগ্রাম অ্যান্টিম্যাটার। সেই নিয়ে গবেষণা অবশ্য থেমে নেই। ‘নেচার’ পত্রিকার ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১০০ কোটি অ্যান্টিপ্রোটন নিয়ে গিয়ে তার নিউক্লীয় গঠনের কাটাছেঁড়া চলবে সার্নের গবেষণাগারে। ‘বেস-স্টেপ’ প্রকল্পে চলবে অ্যান্টিপ্রোটনের সূক্ষ্ম গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অল্প দূরত্বের যাত্রা সফল হলে অ্যান্টিপ্রোটন পাড়ি দিতে পারে সুদূর জার্মানিতেও।
প্রকল্পের মাথা, জার্মানির পদার্থবিদ আলেকজান্দ্রে ওবার্টেলি জানান, গাড়িতে চাপানোর আগে ‘ট্র্যাপ’ করা অ্যান্টিম্যাটারকে বিশেষ চুম্বকের পাত্রে ঠান্ডা পরিবেশে থিতিয়ে রাখা হবে। অতিপরিবাহী চুম্বক অ্যান্টিম্যাটারকে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখবে। সঙ্গে থাকা জেনারেটর যেমন চুম্বককে শক্তি জোগাবে, বজায় রাখবে মাইনাস ২৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অতিশীতল পরিবেশও। বিকল্প ‘কুল্যান্ট’ হিসাবে থাকবে হিলিয়াম।
মূল চ্যালেঞ্জটা হল অ্যান্টিম্যাটারের চারপাশে উচ্চ বায়ুচাপহীন অবস্থা বজায় রাখা। না হলে কণার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটলেই বিপদ। সেই ঝুঁকি কাটাতে অ্যান্টিম্যাটার তৈরির সময় থেকে গাড়িতে পরিবহণের সময় ঝাঁকুনি-নিরোধক ব্যবস্থা তৈরি, সবই মাথায় রাখতে হচ্ছে গবেষকদলকে।
এই বিরল অ্যান্টিম্যাটারের তুল্যমূল্য বিচার করলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সোনা, রুপো, হিরে, প্ল্যাটিনাম বা কোনও ধাতু নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হল এই ‘না-পদার্থ’। এর এক গ্রামের দাম ৫২৭,০০০০০০০০০০০০ টাকা! মাত্র এক গ্রাম দিয়ে ১ লক্ষ ৫৫ হাজারটি চূড়ান্ত বিলাসবহুল বিমান কেনার পরেও টাকা বেঁচে থাকবে। এই বিরল পদার্থের মাত্র এক গ্রাম দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি বিলাসবহুল নৌকা বা ইয়ট, প্রাসাদ এবং ব্যক্তিগত দ্বীপ কেনা সম্ভব।
যে বস্তু প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে তাকে নিয়ে এত কেন মাথা ঘামাচ্ছেন পৃথিবীজোড়া বিজ্ঞানীরা? কারণ অ্যান্টিম্যাটারকে তৈরি করা সম্ভব হলে তা জ্বালানি এবং মহাকাশ ভ্রমণের ভবিষ্যৎ রূপরেখা আমূল বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মাত্র এক গ্রাম অ্যান্টিম্যাটার দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণ ছাড়াই পারমাণবিক বোমার সমতুল শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম।